অনেক রকমের অসম্ভব ঘটনা ঘটেছে একাত্তরে। শহর থেকে বিত্তবান, উচ্চ সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ পরিবার চলে গেছে গ্রামে, গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে গরিব কৃষকের গৃহে। কৃষকের ঘর একটাই, কৃষক সেটা ছেড়ে দিয়েছে; ছেড়ে দিয়ে রাতযাপন করেছে হয়তো রান্না ঘরে, কিংবা গোয়াল ঘরে। আপ্যায়ন করবে এমন সামর্থ ছিল না। মুরগি ছিল একটা, সেটাকে জবাই করেছে। পরের দিন অতিথিরা চলে গেছে অন্যত্র। হয়তো বা সীমান্ত পার হয়ে। হানাদার পাকিস্তানিরা এসেছে এরপর। এসে খবর নিয়েছে। নিয়ে ওই কৃষক পরিবারের পর চড়াও হয়েছে। হত্যা না করলেও বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, দুষ্কৃতকারীদের আশ্রয় দানের অপরাধে। কিন্তু তারপরেও ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার পর কৃষক এসেছে শহরে, সঙ্গে তার ছেলে।
ঢাকা শহর দেখবে তারা। সেই অতিথি পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে, ধরা যাক কোনো বিপণী কেন্দ্রে। গ্রামের মানুষটিই চিনেচে প্রথমে। এগিয়ে এসেছে সোৎসাহে। শহরের মানুষটি যে চেনেনি তা নয়। জড়িয়ে না ধরুক হাত মিলিয়েছে। কুশল জানতে চেয়েছে। ‘গ্রামের খবর কী’, প্রশ্ন করেছে। কিন্তু অনির্দিষ্ট একটা অস্বস্তি যায়নি। গ্রামের লোকটি না জানি কি চেয়ে বসে। হাত পাতে। ভিক্ষা চায়। না, তেমন বিপদ ঘটেনি। গ্রামের লোকটি বুঝেছে যে দু’পক্ষের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের আর কোনো সুযোগ নেই। প্রসঙ্গ নেই, ভাষা নেই। বিদায় নিয়েছে তারা পরস্পরের কাছ থেকে। শহরের ভদ্রলোক বলেননি কাউকে, নিজেকেও নয়, যে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। যেন হানাদার এসেছিল, চলে গেছে। দুটিই সত্য, উভয় ঘটনাই। যেমন মিলন তেমনি বিচ্ছেদ। কিন্তু কোনোটি বেশি সত্য, কোনোটি দীর্ঘস্থায়ী? সন্দেহ কি যে, মিলনের ঘটনাটি ছিল সাময়িক, দূরত্বই হচ্ছে গভীর ও স্থায়ী। শহরের মানুষ বিপদে পড়েছিলেন, তাই আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি ভাঙা ঘরে। সে তো এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু কৃষক? সে কেন আশ্রয় দিল ওই অজানা, অচেনা, বিপজ্জনক পরিবারটিকে? একটা কারণ অবশ্যই এই যে, গ্রামের মানুষ সরল ও অতিথিপরায়ণ। আরেকটা কারণ, গ্রামের মানুষ শহরের মানুষকে সমীহ করে। এসবই আবেগের ব্যাপার। কিন্তু আরো একটি কারণ ছিল যে জন্য সেদিন গ্রামের মানুষ শহরের মানুষকে বিপদের মধ্যেও আশ্রয় দিয়েছে, দ্বিধা করেনি। সেটা হলো স্বার্থ। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছিল সবাই। শত্রু ছিল চিহ্নিত। সে লড়াইয়ের সবাই ছিল। আশ্রয় দান এবং লড়াইয়ে অংশগ্রহণ ছিল অভিন্ন ব্যাপার। আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল সমস্বার্থে। শত্রু যখন পরাজিত হয়েছে, পালিয়ে গেছে লেজ গুটিয়ে তখন স্বার্থের ঐক্যটা আর নেই, তখন ঘটনা প্রবাহিত হয়েছে উল্টো দিকে। প্রত্যেকে শত্রু হয়ে উঠেছে প্রত্যেকের এবং সবার শত্রু প্রত্যেকের। এখন গুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই.
সব মানুষের মধ্যেই পশু আছে, পশুই প্রাথমিক এবং মানুষ মাত্রেই স্বার্থপর। কিন্তু পশুত্বের কারণে মানুষ মানুষ হয়নি, মনুষ্যত্বের কারণেই হয়েছে। এই মনুষ্যত্বকে বিকশিত করা এবং তাকে রক্ষা করার যে কাজ সেটা সহজ নয়। খুবই কঠিন। এ কাজ কেউ একলা করতে পারে না, সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এ মনুষ্যত্বের জন্য অনুকূল রাষ্ট্র চাই, সমাজ চাই। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ওই ব্যাপারে বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়েছিল। তারা জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, বৈষম্যহীন সমাজও গড়ে তুলেছিল। কিন্তু বিকশিত মনুষ্যত্বকে ধরে রাখার জন্য যে সংস্কৃতি আবশ্যক সেটা সৃষ্টি করতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই যে মানুষের ভেতরকার পশু সে তো ছিল। তার স্বার্থপরতা একটি আমলাতন্ত্র গড়ে তুলেছিল। যে আমলাতন্ত্র পার্টির নামে চলত, আদর্শবাদের কথা বলত এবং সে জন্য বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। তার স্পর্শকাতরতা, স্বচ্ছতা ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে আবার বাইরে থেকে পুঁজিবাদী বিশ্ব তার সংস্কৃতি নিয়ে উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। ভেতরের আমলাতন্ত্র বাধা হয়নি বরং খুশি হয়েছে। মানুষের ভেতরকার স্বার্থপরতা উসকে উঠেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। বলা হচ্ছিল ওই ব্যবস্থায় মানুষকে ব্যক্তি স্বাধীনতা দেয়া হয় না। তার স্বাতন্ত্র ও নিজস্বতা হরণ করে নেয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা ধরা যাক। সেখানে বেকারত্ব ছিল না, ভিক্ষুক ছিল না। মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলোর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, পরিধেয়, শিক্ষা এসব সব মানুষই পেত। এখন দৃশ্যপট বদলে গেছে। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন খণ্ড খণ্ড।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল যে কিছু পশুর বিরুদ্ধে ছিল তা তো নয়। ছিল পশুত্বের বিরুদ্ধেই। আমরাও চেয়েছিলাম দস্যুতার অবসান ঘটবে। শোষণ থাকবে না। অন্তত মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মিটবে। তানিয়ারা আর লাঞ্ছিত হবে না। তারা কাঁদবে না। তারা আশ্রয়হীন হবে না। স্বপ্ন ছিল অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার। স্বপ্ন ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ এবং শেষ পর্যন্ত একটি সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলার। সে কাজে আমরা সফল হইনি। আমরা একদল পশুকে হাঁকিয়ে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু পশুত্বকে পরাভূত করতে পারিনি। পারিনি যে তার নানা প্রমাণ ও লক্ষণ বিদ্যমান। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি দীর্ঘদিন। যদিও শেষ পর্যন্ত গণদাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে এখন দরকার তা দ্রুত সম্পন্ন করা। আমরা অনেকেই মৌলবাদের নিন্দা করি। গালমন্দ দেই।
কিন্তু তাতে মৌলবাদ যে লেজ গুটাবে তেনমটা ঘটছে না। বরং কেবল যে বাংলাদেশে তা নয় পৃথিবীর নানা দেশেই পাখা বিস্তার করছে। এর কারণটা ভেবে দেখার মতো। আসলে মৌলবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদেরই একটি অভিশাপ। পুঁজিবাদ মানুষকে মুক্তি দিতে পারছে না, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানটাকে বাড়িয়ে তুলছে, ক্ষুব্ধ মানুষ পথ খুঁজে পাচ্ছে না মুক্তির। পুঁজিবাদকে আরো বেশি পুঁজিবাদ দিয়ে পরিবর্তিত করা যাবে না। তার বিকল্প প্রয়োজন হবে। যথার্থ বিকল্প রয়েছে বাম দিকে, রয়েছে সমাজতন্ত্রে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে বাম বিকল্প আর দৃশ্যমান নয়, দৃশ্যমান হচ্ছে ডানদিকের পথ। ওই পথটাই হলো মৌলবাদের পথ। তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছিল কামাল আতাতুর্কের সময়। তার সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করা নিষিদ্ধ করা আছে। কিন্তু তাতে কী হবে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো এমনই দুর্নীতিপরায়ণ ও সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন যে লোকে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। তুরস্কে যারাই ক্ষমতায় এসেছে বামপন্থিদের ওপর নির্যাতন করেছে। ফলে বামশক্তি সেখানে বিকল্প সরকার গঠনের আশা দিতে পারেনি। তাছাড়া বল প্রয়োগে তো লোকের মনোভাব বদলায় না। হিতে বিপরীত হয়। ভারতে একটি সাম্প্রদায়িক দল রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করেছে। জোর করে আসেনি, নির্বাচিত হয়েই এসেছে। পৃথিবীর বৃহত্তর গণতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুশীলনের পরেও সেই দল ক্ষমতায় এলো। কিন্তু তারা কেন নির্বাচিত হলো সেটা দেখতে হবে। তাদের জয়ের কারণ মৌলবাদের প্রতি লোকের আকর্ষণ নয়, কারণ ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক কংগ্রেসের প্রতি সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণা। কংগ্রেস এমনই দুর্নীতিপরায়ন ও ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত যে, লোকে বিকল্প খুঁজেছিল। সে বিকল্প বামপন্থিরা হতে পারত। কিন্তু সর্বভারতীয় পটভূমিতে তারা ততটা সংগঠিত হতে পারেনি যে বিকল্প হিসেবে লোকের আস্থা অর্জন করবে। ফলে ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এসবই হচ্ছে বাস্তবতা। বাংলাদেশে মৌলবাদ যে গলা ছাড়ছে তার কারণ হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারক ও বাহকরা জনগণকে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারেনি। ওদিকে বামপন্থিরাও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। একের ব্যর্থতা এবং অন্যের অনুপস্থিতি এই দুয়ের ফাঁকেই মৌলবাদের হাকডাক। তাছাড়া বিশ্বজুড়েই তো পুঁজিবাদের ব্যর্থতায় মৌলবাদ নতুন শক্তি পাচ্ছে। যদি বেছে নিতে হয় তবে পুঁজিবাদীরা মৌলবাদকেই বেছে নেবে, সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে। নিচ্ছেও। কারণটা সহজ। কারণ হচ্ছে এই যে, সমাজতন্ত্র তার সামনে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করে, মৌলবাদ তেমনটি করে না। মৌলবাদও প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ ও ব্যবস্থার সমর্থক বটে, পুঁজিবাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বটা বৈরী নয়, অবৈরী। আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। একের পর এক আমরা সামরিক শাসনের অধীনে ছিলাম। কিন্তু তারপরেও নির্বাচিত সরকার পেলাম ঠিকই, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার পেলাম কি? সরকার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সত্যি সত্যি চিন্তিত বলে বিশ্বাস করার কারণ নেই। সরকার উদাসীন। সরকারি হোক কি বিরোধীদলীয় হোক যারা নির্বাচিত হয়েছেন সবাই ধনী। কি বিপুল পরিমাণ অর্থ যে নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে তা সাধারণ মানুষের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন। একদিকে ধনীদের উল্লাস অন্যদিকে অসহায় মানুষের নীরব ক্রন্দন এ হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অথচ এই অসহায়দের দেখিয়েই ঋণ এসেছে, সাহায্য এসেছে। সেই ঋণ লুটপাট করেন এবং করেছেন ক্ষমতাবানরা। দারিদ্র্য-বিমোচনের কর্মসূচি নিয়েছে, কিছু দরিদ্রকে সাহায্য করেছে, কিন্তু তারপরও দারিদ্র্য নামক ব্যাধি নির্মূল করা যায়নি।
তিন.
তাহলে আমরা যাচ্ছি কোনদিকে, ক্রন্দনের দিকে, নাকি সুখের অভিমুখে। কারো কারো সুখ তো বৃদ্ধি পাচ্ছেই। অবশ্যই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে অবস্থাটা?
পরিসংখ্যান বলছে যে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন পঞ্চাশটি করে নতুন গাড়ি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, পাশাপাশি শহরে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসছে, গ্রাম থেকে। গাড়ি এখন যা আছে তাতেই যানজটে চলাফেরা অসম্ভব হয়েছে, এরপরে মাসে যদি দেড় হাজার গাড়ি বৃদ্ধি পায় তবে শহরে অচিরেই এমন অবস্থা দাঁড়াবে গাড়ির পেছনে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে। কোনো গাড়িই চলবে না। হাজার হাজার মানুষ যে চলে আসছে ঢাকায় তাতে বোঝা যায় গ্রামের অর্থনৈতিক জীবন কি ভীষণ দুর্দশা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। অবস্থা কি তাহলে আরো খারাপ হবে? এসবই অন্তহীন প্রশ্ন বটে। এ দেশের মানুষ আত্মসমর্পণ করেনি, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। পথ আসলে সেটাই। এই প্রতিরোধে ঐক্য প্রয়োজন হবে। কার সঙ্গে কার ঐক্য? না, বড় মাছের সঙ্গে ছোট মাছের ঐক্য নয়, তাতে ছোট মাছের নির্বংশ হওয়ার আশঙ্কা। এই বড়-ছোটর ঐক্যের কথাই খুব করে বলা হয়। বলা হয় সহনশীলতা চাই, সমঝোতা প্রয়োজন, সমন্বয় আবশ্যক। অথচ সত্য হচ্ছে দ্বন্দ্ব। গোটা ব্যবস্থাই বৈরী দেশবাসীর কাছে। সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। ধনী-দরিদ্রের সম্পর্কে পরিবর্তন আসেনি। অথচ স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের জন্য নয়, কিছু লোকের জন্য ধনী হওয়ার পথ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নয়, প্রয়োজন হয়েছিল নতুন সমাজ গড়ে তোলার জন্য। সেই রকমের সমাজ যেখানে মানুষ মানুষের সঙ্গে শত্রুতা করবে না, পরস্পর পরস্পরের মিত্রে পরিণত হবে। পশুত্বকে পরাভূত করে মনুষ্যত্ব বড় হয়ে উঠবে। আমরা একটি উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হব। স্বর্গে পৌঁছাব না, কিন্তু মানবিক হব। শহরের পরিবারটি হাত ধরবে গ্রামের পরিবারটির। অস্বস্তির সঙ্গে নয়, ক্ষণকালের জন্যও নয়, আন্তরিকতা নিয়ে স্থায়ীভাবে। একাত্তরের হানদাররা কেউ কেউ পরে বলেছে যে, তারা ভুল করেছিল, উচিত ছিল শুধু আওয়ামী লীগের লোকদের আক্রমণ করা, তা না করে তারা সবার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার ফলেই পরাজিত হলো। কিন্তু তারা বোঝেনি যে প্রতিরোধটা ততদিনে দলের ছিল না, পরিণত হয়েছিল গোটা জনসাধারণের আন্দোলনে। মুষ্টিমেয় কতিপয় ছাড়া হানাদারদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো লোক ছিল না বাংলাদেশে। মানুষ তখন লুণ্ঠনকারীদের চিনে ফেলেছে, তারা তাদের হাত থেকে মুক্তি চাইছে, এই ছিল তখনকার বাস্তবতা। আসলে হানাদার দস্যুরা শত্রু চিনতে মোটেই ভুল করেনি। সে জন্যই তারা প্রথমে চড়াও হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শহরের বস্তিগুলোর ওপর। শিক্ষকরা, ছাত্ররা তাদের শত্রু ছিল, শত্রু ছিল বস্তিবাসী সাধারণ মানুষও। পরে তারা গ্রামে গেছে। গিয়ে দেখে গ্রামবাসীও তাদের শত্রু বটে। গ্রামবাসীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমে আশ্রয় দিয়েছে এবং পরে নিজেরাই মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। শহরের শিক্ষিত যুবক মিলিত হয়েছিল গ্রামের সাধারণ কৃষকের সঙ্গে তার ফলেই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল হানাদের আত্মসমর্পণ যারা অত্যন্ত পরিপূর্ণভাবে সুসজ্জিত ছিল অস্ত্রশস্ত্রে এবং যারা দম্ভ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর একটি বলে।
মুক্তির পথ ওইটাই। ঐক্য। মধ্যবিত্তের সচেতন ও সমাজবিপ্লবী অংশের সঙ্গে শ্রমজীবীর ঐক্য। কিন্তু সামাজিক ঐক্য নয়, তেমনটি নয় যেটি অল্প দিন পরেই ভেঙে যাবে এবং অস্বস্তির কারণ হবে উভয় পক্ষের জন্য; তেমন ঐক্য যা স্থায়ী ও দৃঢ় হবে, যার সামনে লক্ষ্য থাকবে সমস্বার্থের। সেই স্বার্থটি হলো অনিয়ম-অব্যবস্থার অবসান ঘটানো। লক্ষ্য হবে অপরাধীকে তো বটেই অপরাধের আশ্রয় যে রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে বদলে ফেলা, তাকে মানুষের শত্রু থেকে মিত্রে পরিণত করা। আমাদের অতীতের আন্দোলনগুলো মধ্যবিত্তই শুরু করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের যুদ্ধ-সব কিছুরই সূচনা মধ্যবিত্তের চেতনা ও তৎপরতায়। কিন্তু প্রতিটি আন্দোলনেই সাধারণ মানুষ ছিল। সাধারণ মানুষ ছিল বলেই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মধ্যবিত্তেরই দাবি। অসতর্কভাবে দেখলে মনে হবে-ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। হ্যাঁ, সেভাবেই আরম্ভ। কিন্তু সেইখানে থামেনি, থেমে গেলে তাকে উপেক্ষা করা যেত, পরে তাকে দমন করাও সম্ভব হতো, কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে আন্দোলন ছাত্রদের গণ্ডি ভেঙে জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হলো। ছাত্র শহীদ হয়েছে, সাধারণ মানুষও শহীদ হয়েছে। ছাত্র চলে গেছে জনতার কাতারে এবং তখন ওই স্রোতকে আটকে রাখবে এমন কোনো মুক্তি অবশিষ্ট থাকেনি দেশে। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানেও ওই একই ঘটনা। সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিন্তু পরিণতি গোটা বাংলাদেশে, বিশেষ করে গ্রামে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও ছাত্রদের হাতেই, স্বাধীনতার পতাকা তারাই প্রথম উত্তোলন করে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তারাই নিয়ে যায় নতুন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার দাবির দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু সাধারণ মানুষ এসেছে আশ্রয় দিয়েছে। যোগ দিয়েছে, তাতেই বিজয় অর্জিত হয়েছে, বাঙালির। বাঙালির ইতিহাসে এত বড় বিজয় আর নেই। আনন্দ অবশ্যই আছে। কিন্তু ক্রন্দনও রয়েছে। সে ক্রন্দন কেবল যে অতীত দুঃখভোগের স্মৃতি থেকে আসছে তা নয়, ক্রন্দন রয়েছে বর্তমানেও। হাজার হাজার তরুণ এখন বেকার, লাখ লাখ শিশু-কিশোর ভবিষ্যৎহীন অন্ধকারে নির্লিপ্ত। অপরাধ বাড়ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা সুবিধাবাদী প্রাণীর প্রস্তুতি সম্ভব করছে, মানুষ তৈরি করছে না। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে মানুষ পরস্পর থেকে। এসব ক্রন্দনের শব্দে কিন্তু আশাও আছে। অতীতে আমরা আত্মসমর্পণ করিনি ভবিষ্যতেও করব না। মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরে শুরু হয়নি। শেষও হয়নি। একাত্তরে তার একটা পর্ব শেষ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে, চলবে। তাকে থামতে দিলেই বিপদ। থামিয়ে দিলে আমরা বাঁচব না। অতীতের সব আন্দোলনেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বড় গুণ। তাতে প্রাণ থাকে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার একটা সীমাও আছে। যে আন্দোলন কেবলই স্বতঃস্ফূর্ত সে অগোছালো, তার পক্ষে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন এবং সর্বোপরি সে স্বল্পে সন্তুষ্ট। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা অবশ্যই প্রয়োজন, মানুষ প্রাণের তাগিদে আসবে, এসে ধরা প্রবাহকে প্রাণবন্ত ও বেগবান রাখবে। কিন্তু কেবল স্বতঃস্ফূর্ত হলে চলবে না, সুসংগঠিতও হতে হবে। অতীতের আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে যে, ঐক্যবদ্ধ হলে বিজয় অর্জন অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
(মানব কন্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন