আমার এক আত্মীয় ও বন্ধু, আত্মীয় মানেই যে বন্ধু হবে এমন নিশ্চয়তা সব সময়ে থাকে না, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ছিল; আমার সেই আত্মীয় চাকরি করতেন ছোটখাটো, আর অবসর সময়ে অথবা অবসর তৈরি করে নিয়ে ব্যবসা করতেন জীবন বীমার। ব্যবসাই, তবে পুঁজিহীন ব্যবসা। এ ব্যবসাতে পুঁজি লাগে না; আমাদের বীমা শিল্পে অগ্রপথিক একজন, প্রয়াত জনাব এমএ সামাদ সুন্দর করে বলে গেছেন এ কথা, তার এক বইতে। আমার সেই আত্মীয় ও বান্ধবটি আজ আর জীবিত নেই, কিন্তু তার কথা নানাভাবে মনে পড়ে, বিশেষ করে মনে আসে ব্যবসার কথা উঠলেই। এখন ব্যবসা চতুর্দিকে, যত্রতত্র এবং সর্বত্র। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র একদা দুঃখ করে বলেছিলেন যে, ‘বাঙালি কেবল কেরানি হতে জানে, ব্যবসা করতে জানে না, আর জানে না বলেই তার এমন অধঃপতন’। আজ যদি তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে বাংলাদেশে কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে দেখে হয়তো তাকে অশ্রুপাতই করতে হতো। হয়তো অতটা যেতেন না, শক্ত মানুষ, সহ্য করতেন, কিন্তু সহ্য করা যে শক্ত হতো সে বিষয়ে সন্দেহ কী! ব্যবসার নামে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী এখন খাদ্যপণ্যেও ভেজাল দিচ্ছে অহরহ।
ব্যবসা এবং বাণিজ্যের ভেতর অবশ্য পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের লোক ব্যবসাই করে, বাণিজ্য করে খুবই অল্প। আমদানির তুলনায় রফতানি কম। রফতানির ক্ষেত্রে অবশ্য তারা বাছবিচার করে না। খনিজ সম্পদ, প্রত্নসম্পদ যা কিছু আছে পাচার করে দিতে তাদের উৎসাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের মাননীয় এক স্পিকার অতীতে বলেছিলেন, ‘সংসদে যত ব্যবসায়ী দেখা যাচ্ছে, তত আইনজীবী দেখা যাচ্ছে না অথচ সংসদ হচ্ছে আইন প্রণয়নেরই সংস্থা।’ কিন্তু আইনজীবীদের যে ব্যবসার বাইরে রাখবেন তাও তো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা আইনও তো এখন ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী, সবারই প্রবণতা ব্যবসামুুখী। পারলে আপনি আমিও করতাম, সরাসরি না হোক, সাইড বিজনেসে কিছু এলে মন্দ কী? তবে হ্যাঁ, ব্যবসা জিনিসটা ভালো নয়, মন্দই বটে। বাণিজ্য আরো খারাপ। যাকে উপনিবেশবাদ বলি সে তো নৌবাণিজ্যেরই আরেক রূপ। তথাকথিত বণিকরা জাহাজে করে নতুন নতুন দেশে গেছে, সেখানে গিয়ে রঙিন কাচের বিনিময়ে হীরা সংগ্রহ করেছে, চালান দিয়েছে মানুষ। দস্যুতাই আসলে। ব্যবসাতেও ভালো কিছু নেই, মুনাফা করা ছাড়া। ঠকবে অথবা ঠকাবে। ক্রেতাই ঠকে সাধারণত, যে জন্য ব্যবসা চলে, নইলে উঠে যেত আর ওই যে পুঁজিহীন ব্যবসার কথা বলছিলাম সেটা বীমার ক্ষেত্রে ঠিকই প্রযোজ্য, এ ব্যবসাতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু পুঁজির প্রয়োজনবিহীন আরেকটি ব্যবসা আছে যেটা ভয়ঙ্কর। এটি হলো ধর্ম ব্যবসা। এই ব্যবসা নানা রকমের হয়। ভণ্ডপীররা করে থাকেন, তাদের কায়দাকানুন নানা প্রকারের; কিন্তু সেটা সামান্য ব্যাপার, রাজনীতির ব্যবসায়ীরা যখন ধর্মকে ব্যবহার করেন তার তুলনায়। রাজনীতিকদের ধর্ম ব্যবসাতেও পুঁজি লাগে না, উল্টো তারা সাধারণ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করেন। মূল পুঁজিটা অন্যের ধর্মানুভূতি, কিন্তু মুনাফার সবটাই রাজনীতিকদের। কোনো প্রকার ঝুঁকি নেই।
ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার কাজটা ইংরেজ আমলেই শুরু হয় এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার রূপ নেয় সাম্প্রদায়িকতার, যার দুর্ধর্ষ তৎপরতার জন্য ভাগ হয়ে যায় ভারতবর্ষ। এই ব্যাপারে বিশেষভাবে তৎপর ছিল হিন্দু মহাসভা, ধর্মকে তারা পণ্য থেকে অস্ত্রে রূপান্তরিত করেছিল। হিন্দু মহাসভাই পরে ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) পরিণত হয়েছে এবং ধর্মকে ব্যবহার করে একবার ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা পর্যন্ত দখল করে নেয়। সেই ক্ষমতা তারা ধরে রাখতে পারেনি এটা ঠিক। কিন্তু এবার (২০১৪) রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করে আবারো তারা ক্ষমতায় এসেছে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে ধর্মকর্মের ধার ধারতেন না। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করা সুবিধাজনক দেখে ওই ব্যবসাতে লিপ্ত হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িকভাবে দেশ ভাগ করার ব্যাপারে তার দায়িত্বটা কম নয়। নতুন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তেই অবশ্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, হবে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা তার কথা শুনবে কেন? তাদের সামনে তখন মুনাফা লাভের বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়েছে, তারা সেটির সদ্ব্যবহার করবে না এমন তো হতে পারে না। পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্রের সদস্যরা মানুষ হিসেবে ধার্মিক ছিল এমন কথা তাদের মিত্রদের পক্ষেও বলা সম্ভব নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তারা ধর্মকে ব্যবহার করার ব্যাপারে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা প্রথম সুযোগেই বিধর্মীশূন্য করেছে এবং তারপরে একাত্তরে বিধর্মীদের খোঁজে পূর্ববঙ্গে এসে হানা দিয়েছে। যাদের হাতের কাছে পেয়েছে হত্যা করেছে, অন্যদের তাড়িয়ে সীমান্তের অপর পারে পাঠিয়ে দিয়েছে, কিংবা বাধ্য করেছে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে। পরে যখন দেখল যে বিধর্মীরা নয়, স্বধর্মীরাই তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখন ক্রমেই বুঝতে পারল যে পারবে না, পালাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত পালালও।
ফিরে যাই অতীতে। আফগানিস্তানে তখন রাশিয়ার আধিপত্য চলছে, আমেরিকানরা চাইছিল সেখান থেকে রাশিয়ানদের সরিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করবে। এর জন্য কমিউনিস্টবিরোধী একটি বাহিনী দরকার। আর ওই রকমের বাহিনী তৈরিতে নাস্তিক কমিউনিস্টদের ঘৃণ্যতম শত্রু বলে বিবেচনা করবে এমন লোক চাই। আমেরিকার অর্থে তেমন লোক তৈরির কারখানা খোলার ধুম পড়ে গেল। একেবারে রমরমা ব্যবসা। এসব মাদ্রাসায় আফগানিস্তান তো বটেই পাকিস্তানের নিজের এলাকারও হাজার হাজার তরুণকে ভর্তি করা হলো, যাদের জীবনের ব্রত দাঁড়াল আফগানিস্তান থেকে রুশদের হটানো। রুশরা চলে গেল। চলে যাওয়ার পর ওই যে জেহাদি, নাম যাদের তালেবান, তারা আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিল। আমেরিকা তো আফগানিস্তানে তালেবান শাসন চায়নি, তারা চেয়েছিল আমেরিকার আধিপত্য। তাই তালেবান আমেরিকান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সম্মুখযুদ্ধে তালেবানরা পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইতোমধ্যে ধর্মকে তো তারা অস্ত্র করে তুলেছে এবং সেই অস্ত্রের যে ক্ষমতা তার স্বাদও পেয়ে গেছে; তাই তাদের তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক ব্যবসা। মাদকের। ধর্মের অস্ত্র এবং মাদকের ব্যবসা দুয়ের পোষকতা পেয়ে তালেবানরা ক্রমাগত দুর্ধর্ষ হয়ে উঠছে। আল-কায়দা যা তালেবানও তাই, কেবল যে আত্মীয় ও বন্ধু তা নয়, আসলে একই জিনিস, দুই নামে। আর ওই যে জজ বুশ, তিনিও যে এই জিনিস থেকে দূরে ছিলেন তা নয়; তিনিও ধর্মযোদ্ধাই ছিলেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুশেড ঘোষণা করেছিলেন, তারও ঠিক সেই মনোভাবই ছিল যা নিয়ে তালেবান আল-কায়দারা দিয়েছে জেহাদের ডাক।
এখন যদি তাকাই পাকিস্তানের দিকে তাহলে দেখা যাবে ধর্ম নিয়ে তারা যে ব্যবসা শুরু করেছিল তার ফল পাকিস্তানি শাসকরা হাতেনাতে পেতে শুরু করেছে। পূর্ববঙ্গে তাদের যে শিক্ষালাভ ঘটেছিল তারপরেও কিছু প্রাপ্য ছিল বৈকি। সেই শিক্ষাটা এখন লাভ করছে। কিন্তু যতই শিক্ষা পাক তাদের পক্ষে ধর্ম ব্যবসা পরিত্যাগ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। পাকিস্তান একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে এমন কথা তারা কিছুতেই বলতে পারবে না। কারণ সেটা বলতে গেলে তাদের রাষ্ট্রের ভেতরটাই ভেঙে পড়বে। তখন সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান ও মোহাজেরদের ওপর যে কর্তৃত্ব তারা করছে সেটা করার মূল যুক্তিটাই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশে তো ঘটনা ভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। ধর্মভিত্তিক জাতীয়বাদকে তো বাঙালিরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই ত্যাগ করেছে। এ ক্ষেত্রে জিন্নাহর কাজের সঙ্গে বাঙালিদের কাজের একটা মিল দেখা যাচ্ছে। জিন্নাহও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ পরিত্যাগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ওই একবারই। তারপরে তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের ঐক্য বিষয়ে বলার কোনো ঘাটতি ঘটাননি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার এই যে, পূর্ববঙ্গের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন। যুক্তি ছিল উর্দু মুসলমানদের ভাষা। বাঙালিদের পদানত করার উদ্দেশ্যে ধর্মের জায়গায় নতুন একটি অস্ত্র ব্যবহার উদ্যত হয়েছিলেন তিনি, সেটি ভাষার।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে তা ধর্মকে অস্ত্র ও পুঁজি হিসেবে ব্যবহারকারীদের তৎপরতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তবেই। খুবই স্বাভাবিক ছিল যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। আমরা সে পথেই এগোচ্ছিলাম। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৎপরতার ফলে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মূলনীতির সংক্ষিপ্ত তালিকাটি থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনা শুরু হলো পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। জবরদখল করা ক্ষমতায় টিকে থাকাকে বৈধতাদান এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ থেকে অব্যাহতি লাভের উদ্দেশ্যেই ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করার পুরনো কাজ আবার শুরু করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং সেই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো কাজ করার অনুমতিও পেয়ে গেছে। এই যে কবরের ভেতর থেকে প্রেতাত্মার বেরিয়ে আসা এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পেছনে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকারী তো আছেই, রয়েছে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সক্রিয় সমর্থন। এরা ভয় পাচ্ছিল বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তাই ক্ষমতা দখলকারীদের পৃষ্ঠপোষকতাই কেবল দেয়নি, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ সাহায্যও করেছে এবং ধর্মভিত্তিক শিক্ষার পেছনে অকাতরে টাকা ঢেলেছে। ব্যবসাটা তাই খুবই জমে উঠেছে। পাকিস্তান আমলেও পূর্ববঙ্গে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দাবির কথা শোনা গেছে। কিন্তু তখনকার সেই দাবির সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবসা এমনভাবে যুক্ত হয়নি, যেমনভাবে পরে যুক্ত হয়েছে। যারা দাবি তুলেছে তখন তারা প্রবল হতে পারেনি, বরং ক্রমশ দুর্বলই হয়ে পড়েছে। এর একটা ভালো দৃষ্টান্ত তমদ্দুন মজলিস। এই সংগঠনটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৪৭-এর ১ সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এরাই প্রথম জানায়। অন্তত সেদিক থেকে প্রতিষ্ঠানটি ছিল ইহজাগতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। এরা শোষণহীন সমাজ গঠনের কথা বলত। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক সৈনিক প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়টিতে লেখা হয়, ‘আজ আমাদের সমাজ জীবনে অসাম্য মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে একদিকে প্রাচুর্যের বাঁধভাঙা স্রোত, অন্যদিকে দারিদ্র্যের যে বুকফাটা আর্তনাদ শুরু হইয়াছে। সেটা দূর করিয়া একটা সুস্থ-সুন্দর সমাজ গড়িয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে মানুষ মানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।’ বলা হয়েছে, ‘যারা এতদিন পদে পদে লাঞ্ছিত ও শোষিত হইয়াছে, আজো যাদের প্রতি পদে ধাপ্পা ও ধোঁকা দেয়া হইতেছে, বহু জমানা তারা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ন্যায্য অংশগ্রহণ করিতে পারে নাই। জালেমের দাপট বারবার তাহাদিগকে দমাইয়া দিয়াছে। কিন্তু আজ আর সেদিন নাই।’
সমাজতন্ত্রীদের কথাই বটে। ‘সৈনিক’ পত্রিকা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে অবিরাম লিখেছে, বিশেষ সংখ্যা বের করেছে, মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছে, কার্টুন ছেপেছে। তমদ্দুন মজলিস সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সদস্য ছিল। কিন্তু ভেতরে একটা মুশকিল ছিল। যার ইশারা তাদের ওই তমদ্দুন মজলিস নামকরণের ভেতরই পাওয়া যাবে। এরা তমদ্দুনের কথা বলেছেন, সংস্কৃতির কথা না বলে। তমদ্দুন শব্দটি অবশ্য সেকালে খুবই চালু ছিল; কিন্তু যারা সমাজতন্ত্রী তারা তো ধর্মীয় ছায়াযুক্ত তমদ্দুনের কথা বলবে না, বলবে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির কথা। মুশকিলটা ছিল আসলে ওইখানেই। এরা সমাজতন্ত্র ও ইসলামকে মেলাতে চাইছিলেন, যেটা ছিল একটি অবান্তর চেষ্টা। সমাজতন্ত্রকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, ধর্মীয় হলে চলবে না। ওই যে ধর্মের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে মেলানোর চেষ্টা এটাই তাদের দুর্বল করে ফেলল। ধর্মকে পণ্য করে ব্যবসা করবেন এটা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কাজ মুসলিম লীগ করেছিল কিছুটা অগোছালোভাবে, জামায়াতে ইসলামী করছিল সুসংগঠিত উপায়ে।
তমদ্দুনপন্থিবাদ ছিলেন আগাগোড়া মুসলিম লীগবিরোধী; কিন্তু এরা যে রাজনৈতিক দল গঠন করলেন তার নাম দিলেন খেলাফতে রব্বানী পার্টি, যে নামে ইহজাগতিকতা ছিল না। ১৯৫৪’র নির্বাচনে দল হিসেবে যুক্তফ্রন্টে যোগদানে এরা আগ্রহী ছিলেন, শেষ পর্যন্ত পারেননি। কিন্তু এদের নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেম যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং অন্য একজন স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তি কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী সুনামগঞ্জ এলাকা থেকে লীগ ও যুক্তফ্রন্ট উভয় প্রার্থীকে পরাজিত করে রব্বানী পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসেন। তবে ওইখানেই সমাপ্তি। দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যতটুকু হলো অন্যরাই করলেন এবং ধর্ম ব্যবসায়ের রাজনীতিতে চলে এলো জামায়াতে ইসলামী, দেশি-বিদেশি অর্থের বিপুল তহবিল নিয়ে। তমদ্দুনপন্থিরা না ঘরের না ঘাটের হয়ে বিলীন হয়ে গেলেন। না পারলেন সমাজতন্ত্রী হতে, না সম্ভব হলো ব্যবসায়ী হওয়া।
একাত্তরে জামায়াতের যে ভূমিকা তাতে বাংলাদেশ থেকে তাদের পক্ষে চিরকালের জন্য নির্মূল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। দেশি-বিদেশি তহবিল ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। তাদের পথটা বড়ই সোজা। তারা পুরোপুরি সমাজতন্ত্রবিরোধী এবং সম্পূর্ণরূপে ধর্মব্যবসায়ী। এতে কোনো প্রকার ভেজাল নেই। নিজেরা মোটেই দাঁড়াতে পারত না, কিন্তু প্রথমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগগৎ আন্দোলন এবং পরে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যজোট গঠন করে ক্ষমতায় চলে গিয়েছিল এবং গিয়েই কোনো প্রকার দ্বিধা করেনি, চাকরি দিয়েছে, ব্যবসা পাইয়ে দিয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছে, ব্যাংক, বীমা, শিক্ষা, চিকিৎসা, মিডিয়া, নির্মাণ সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তাদের উপস্থিতির অভাব আছে। তাই ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসা তো জমে উঠবেই। উঠছেও।
ব্যাপারটা কিন্তু ব্যবসাই, অন্য কিছু নয়। ইহকালে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে পরকালেও পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এর সঙ্গে ধর্মকর্মের যেটুকু সম্পর্ক তা প্রদর্শনের বটে, আদর্শের নয়। কিন্তু প্রতিকার কী? সেটাও আমাদের জন্য। প্রথম কথা, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে গোঁজামিলের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। আরো বেশি করে যা প্রয়োজন, তাহলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যে আন্দোলনের লক্ষ্য হবে সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দারিদ্র্য দূর করা। দারিদ্র্য হচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত ক্ষেত্র। দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে; সেই বিক্ষোভকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যদি ধারণ করতে না পারে তবে ধর্মব্যবসায়ীদের সুবিধা না হয়ে যায় না। ধর্মবিশ্বাসকে তো বটেই, ইহজাগতিক বিক্ষোভকেও কাজে লাগিয়ে তারা মহানন্দে ব্যবসা করতে থাকবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ আরো বেশি বিপন্ন হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
(মানবকন্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন