শিক্ষার মধ্য দিয়ে আসলে আমরা কোন ধরনের মানুষ তৈরি করতে চাই? সময় এবং বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটির গুরুত্ব এড়িয়ে যাওয়ার পথ তো নেই-ই বরং খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা চাইব, শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে। আজকের দিনে শিক্ষিত মানুষকে সমাজ বিশ্বাস করে না এ রকম কথা যখন কখনো কখনো শুনতে হয় তখন লজ্জায় নুইয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অসত্য নয় যে, একজন কৃষকের সন্তান যখন শিক্ষিত হয়ে ওঠে, তখন সে আবার খাঁটি থাকে না এবং বিদ্যমান বাস্তবতায় এ রকমই মনে করা হয়। সমাজে যে দুর্নীতি চলছে, অন্যায় চলছে, রাজনীতিতে যে অব্যবস্থা চলছে সব কিছুই শিক্ষিত লোক করছে বলে ধারণা করা হয় এবং এ ধারণাটাও মিথ্যা নয়। তাহলে শিক্ষিত লোকরা যে এই কাজগুলো করছে, এর কারণ কি? যে শিক্ষায় তারা বেড়ে উঠেছে, খাঁটি মানুষ তৈরির শিক্ষা সেটি নয়। শিক্ষাটা তার মধ্যে সামাজিকতার বোধ, সামাজিক চেতনা তৈরি করছে কি-না এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, মানুষ হচ্ছে সামাজিক প্রাণী। তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও খুব জরুরি। সামাজিকতার বোধ ও বুদ্ধিবৃত্তি এ দুটি গুণ মনুষ্যত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আমরা দেখতে চাই, যে মানুষটা শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটাচ্ছে, তার মধ্যে সামাজিকতার বোধ সমমাত্রায় তৈরি হচ্ছে কি-না। আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থাটা প্রচলিত আছে, ব্রিটিশদের আমল থেকে যার সূচনা, সেই শিক্ষাটা শিক্ষিত মানুষকে সামাজিক মানুষে পরিণত না করে আত্মকেন্দ্রিক, বিচ্ছিন্ন, স্বার্থপর মানুষে পরিণত করবে এটাই ছিল ব্রিটিশদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। সামাজিক মানুষ গড়ার কোনো উদ্দেশ্য ব্রিটিশদের ছিল না। শিক্ষার যে এ রকম লক্ষ্য, সেটি তৈরি হয়ে গেছে তখনই। তাদের আসল লক্ষ্যই ছিল স্বার্থপর মানুষ তৈরি করা এবং সামাজিক মানুষ তৈরি না করে বিচ্ছিন্ন মানুষ তৈরি করা। আমরা ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখব, শিক্ষার এ লক্ষ্যটি কিন্তু পরিবর্তিত হয়নি। অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে, সংস্কার হয়েছে, পাঠ্যসূচি বদলেছে, পরীক্ষা পদ্ধতি বদলেছে; কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্যের এই জায়গাটাতে কতটা পরিবর্তন হয়েছে? এই প্রশ্নের যে উত্তর পাওয়া যাবে তাও নিশ্চয়ই প্রীতিকর হবে না বরং উদ্বেগজনক চিত্রই ফুটে উঠবে।
আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষরাই সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন করেছেন, রাজনীতির আন্দোলন করছেন; তারা জনগণের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন এবং করছেন। কিন্তু এই কাজগুলো তারা করেছেন ওই শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা যে শিক্ষা পেয়েছেন, সে শিক্ষা কিন্তু তাদের জনমানুষের মুক্তির আন্দোলনে যেতে বাধা দিয়েছে। ওই বাধাটা অতিক্রম করে আমাদের শিক্ষিত মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ ইতিবাচক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জাতি গঠন। এটার জন্য শিক্ষিত লোক প্রয়োজন। শিক্ষিত মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে, পরস্পরকে বুঝবে এবং তাদের জাতীয়তাবাদ গঠিত হবে। তাহলে জাতি গঠনের জন্যও শিক্ষা প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমলে যে শিক্ষা ছিল, সেই শিক্ষা জাতি গঠনের কাজে লাগেনি। পাকিস্তান আমলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও জাতি গঠনের শিক্ষা দেয়নি। আমরা ওই শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসেই জাতি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি, আমাদের সামগ্রিক মুক্তি, জাতীয় মুক্তি, সেই মুক্তির আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু তা কতটা কার্যকরভাবে নিয়েছি এই প্রশ্নটা জরুরি। এখন এই যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা, বাংলা ভাষা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা ভাষার যে স্থান আগে ছিল-আগেও অবশ্য দুর্বল ছিল কিন্তু এখন সে স্থানটা তাও কাক্সিক্ষত মাত্রায় সবল নয়। এখন শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। এই বিভক্তি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ তো করছেই না, বরং বিভক্ত করছে। এই বিভাজনটা আসলে শ্রেণী বিভাজন; শ্রেণী বিভাজনই জাতি গঠনের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা মানুষকে বিভক্ত করছি এবং এই বিভাজনটা শ্রেণী বিভাজনের রূপ নিচ্ছে। এ দ্বন্দ্বটা নিরসন করা যাচ্ছে না। অনেক ধরনের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু বিভিন্ন ধারাকে অভিন্ন করে কিছু করা যাচ্ছে না। এই যে এমনটি করা যাচ্ছে না এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাবে সমাজ অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে এবং বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতর হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা বিভক্তি দূর করতে পারব কীভাবে। আমাদের তাহলে ওই জায়গায় ফিরে যেতে হবে। আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি যে ভাষা, ওই মাতৃভাষার মাধ্যমে একটি অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের চেয়ে এই মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জটা কম নয়। এটাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। এটা যত উপেক্ষিত থাকবে ততই ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি সামগ্রিক ক্ষতির চিত্রকে স্ফীত করবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে দ্বিভাষিকতা অনিবার্য ছিল। কিন্তু এখন এই স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকম দ্বিভাষিকতা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই মাতৃভাষায় পড়ালেখা করবে এবং এটিই খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ইংরেজি শিখবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। ষোলো কোটি মানুষের সবারই তো ইংরেজি শিক্ষার দরকার পড়বে না। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি গঠনের কাজ আমরা যথাযথভাবে করতে পারছি না। কেননা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা এখনো আমরা সর্বক্ষেত্রে চালু করতে পারিনি। যদিও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি অর্জনে অনেক রক্ত ঝরেছে, প্রাণ গেছে তার পরও তো অর্জনটা অনন্য। কিন্তু সমাজ শ্রেণী বিভাজনকে গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্র শ্রেণী বিভাজনকে উৎসাহিত করেছে। এছাড়া আমরা এমন একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে আছি, যার মূল ভাষা হলো ইংরেজি। এ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আমাদের ইংরেজি শিখতে হচ্ছে এবং ইংরেজি না জানাটা এখন অজ্ঞতার পরিচায়ক বলা হচ্ছে। আর ইংরেজি যারা জানে, তারা সব জায়গাতেই সুবিধা পাচ্ছে। এই যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থান, আমরা সেই ব্যবস্থার বিপরীতে কিছুই করতে পারছি না। শিক্ষার মাধ্যমটাকে যদি আমরা সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষায় নিয়ে আসতে না পারি, সেটা আমাদের জন্য বিশাল ব্যর্থতা হবে এবং ব্যর্থতার গ্লানি হবে চূড়ান্তভাবে আমাদের জন্য আরো ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দুটি প্রবণতা দেখলাম। তখন আমরা দেখলাম, নানা জায়গায় কলেজ তৈরি হচ্ছে। কলেজের সংখ্যা খুব বাড়ল। শিক্ষানুরাগী লোকরা কলেজ করতে চাইলেন, রাজনীতিক লোকরা কলেজ করতে চাইলেন, সমাজে যারা প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে চান তারা কলেজ করতে চাইলেন। কলেজ করা খুব সোজা এবং এতে অল্প টাকা খরচ করতে হয়। তারপর যে প্রবণতা হলো সেটি হচ্ছে, মাদরাসা তৈরি করা। মাদরাসা করা কলেজ করার চেয়েও সোজা। মাদরাসায় যারা যায় তারা হচ্ছে গরিব মানুষ। এখানে সহজে অল্প পয়সার শিক্ষা লাভ করা সম্ভব, অনেক সময় বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। কলেজ করার ওই ঝোঁকটা মাদরাসার দিকে চলে গেল। কেননা এটি অল্প পয়সায় করা যায় এবং এর দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করা যায়। এছাড়া ইহকালেও খুব সুনাম হয় যে, লোকটা খুব ধার্মিক। ফলে শ্রেণী বিভাজনটা থেকেই যায়। দেখা যায় যে, মাদরাসায় পড়ে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা এবং তারা গরিবই থাকে। তারা আর ওই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে যারা জিহাদ ঘোষণা করেন, তাদের অনেকেই নিজেদের ছেলেমেয়েকে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন এবং গরিব মানুষের জন্য মাদরাসা শিক্ষার ব্যবস্থা করছেন। এটি যে কত বড় অন্যায় কাজ এবং ধর্মের দিক থেকে দেখলে কত বড় একটা অধার্মিক কাজ, তা তারা বোঝেন না। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেন। এ ব্যবসাটা চলছে। শিক্ষা আবার বাণিজ্যের অধীনেও চলে গেছে। আগে আমাদের দেশে শিক্ষা এভাবে বাণিজ্যের দিকে কখনো যায়নি। চিকিৎসা এবং শিক্ষা এ দুটি মৌলিক অধিকার মেটানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই দুটিই এখন বাণিজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সেসব ছেলেই ভালো করে, যাদের বাড়িতে প্রাচুর্য আছে, যাদের অবস্থা ভালো, যারা কোচিং সেন্টারে গিয়ে পড়তে পারে এবং যাদের পুষ্টির অভাব নেই। এটা হচ্ছে বিত্তবানদের সুযোগ। ফলে এই যে সমাজ আমাদের, এটা একটা অন্যায় সমাজ। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বারবার স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা দু’বার স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু আমরা সমাজকে বদলাতে পারিনি। সমাজকে যদি বদলাতে হয় তাহলে ইতিহাসকে জানতে হবে। অতীতের মধ্যেই আমাদের বর্তমানের ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার নির্দেশ আছে। ফলে সর্বস্তরের ইতিহাসকে গুরুত্বপূর্ণ করতে হবে। ইতিহাসের কোনো বিকল্প নেই। আরেকটা কথা হলো, শিক্ষার সঙ্গে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার চর্চা হচ্ছে। আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষা, স্বার্থপরতার শিক্ষা, ভোক্তাবাদিতার শিক্ষা এগুলোকে কুশিক্ষা বলব। এই কুশিক্ষাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। সমষ্টির মঙ্গল না শিখিয়ে ব্যক্তিকে তুমি ভালো হও, তুমি উঁচু হও এ রকম কথা বলা হচ্ছে। মনে পড়ে তালগাছের সেই কবিতাটা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে...।’ কিন্তু তালগাছ এক পায়ে হলেও দাঁড়িয়ে আছে শক্ত ভূমির ওপরে। আমরা আমাদের সন্তানদের তালগাছের মতো বড় হতে বলছি, আকাশের দিকে যেতে বলছি। কিন্তু তার যে সামাজিক ভিত্তি, সেটা তো শক্ত হতে হবে। না হলে এই তালগাছ বড় হবে না, মজবুত হবে না। সামাজিক ভিত্তিটাকে শক্ত কিংবা মজবুত না করে আমরা এত বড় প্রত্যাশা করি কি করে সেটাও প্রশ্ন বটে।
ভুল শিক্ষাটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সুশিক্ষা দরকার, পরিপূর্ণ শিক্ষা দরকার। অশিক্ষার চেয়েও অর্ধশিক্ষা ক্ষতিকর এ জন্য যে, অশিক্ষিত মানুষরা জানে যে, তারা অশিক্ষিত, কাজেই তার আগ্রহ থাকে শিক্ষালাভের প্রতি। আর অর্ধশিক্ষিত যে মানুষ, সে জানে না যে সে অশিক্ষিত। মাদরাসা শিক্ষার বড় ত্র“টি হলো, এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা জানেন না যে, তাদের আরো জানার আছে। ফলে এই যে অর্ধশিক্ষিত মানুষ তৈরি হচ্ছে, এটাও খুব বিপজ্জনক। আমরা অর্ধশিক্ষিত মানুষ চাই না, আমরা কুশিক্ষিত মানুষ চাই না। আমরা চাই মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের বোধ থাকতে হবে, সামাজিকতার বোধ থাকতে হবে এবং তারা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করবে। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা এবং মাদরাসার মধ্যকার ব্যবধানকে সকাল-সন্ধ্যার পার্থক্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে হয়তো। তবু দুইয়ের ভেতর মিল আছে এক জায়গাতে, উভয় বিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে উৎপাটিত করছে। শিক্ষা তাদের কৃত্রিম ও শুষ্ক করে তুলছে। আরো বড় বিপদ হচ্ছে এটা যে, শিক্ষা সমাজের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবে কি, পরস্পরবিচ্ছিন্ন করছে। দু’ভাবে ঘটছে ওই কাজ। প্রথমত আমাদের সমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্য সব সময়ই ছিল স্বার্থপর মানুষ তৈরি করা। এখনো সেটা কার্যকর রয়েছে। লেখাপড়া শিখে গাড়িঘোড়ায় চড়ার উচ্চাকাক্সক্ষা এখনো শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতা এই আকাক্সক্ষাকে দুর্বল না করে জলসিঞ্চনের মাধ্যমে প্রবল করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত, ওই যে তিন ধরনের শিক্ষা সেটা তো দাঁড়িয়ে আছে সমাজের শ্রেণীবিভাজনের ওপর ভর করেই। শিক্ষা ওই বিভাজন দূর করবে কি, উল্টো তাকে পোক্ত ও গভীর করছে। শিক্ষার বৃদ্ধি তাই আমাদের উৎফুল্ল করবে নাকি উদ্বিগ্ন করবে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন বৈকি। বহুবিধ প্রশ্নের মীমাংসা করে আমরা সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি! আগে প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার সব দেয়াল ভেঙে ফেলতে হবে বৃহৎ স্বার্থ ও প্রয়োজনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রেখে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কোনো প্রচেষ্টাই সফল হবে না, সব আশাই হয়ে দাঁড়াবে দুরাশার নামান্তর।
সংস্কৃতির একটি অভিন্ন ধারা তৈরি করা দরকার। কারণ সামাজিকতা সংস্কৃতির দ্বারা যেমন পরিপুষ্ট হয় তেমনি আবার সংরক্ষিতও হয় বৈকি। সংস্কৃতি মানুষের রুচি গঠন করে এবং আরো গভীরে গিয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো গঠনেও সাহায্য করে। লোকসংস্কৃতির কথা ওঠে। আমরা লোকসংস্কৃতি বলতে আলাদা একটি সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের পক্ষপাতি নই এবং লোকসংস্কৃতির ভদ্র চর্চাতেও উৎসাহী নই। তথাকথিত লোকসংস্কৃতিতে যে মূল্যবান গণতান্ত্রিক উপাদানগুলো রয়েছে তাকে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব এবং সংস্কৃতির মূল ধারার সঙ্গে তাদের যুক্ত করে দিয়ে সমষ্টিগত সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলব। লোকসংস্কৃতি প্রদর্শনীর বিষয় হবে না। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অবশ্যই থাকবে, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে সংস্কৃতির মূল ধারাকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে কিছু কিছু মানুষের জন্য অপরিমেয় সুযোগ এসে গেছে অর্থে ও ক্ষমতায় ফুলেফেঁপে ওঠার। কিন্তু ওরা কোনো ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি। যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে তাহলো ভোগবিলাসের এবং সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার, সর্বোপরি অসামাজিক মানুষে পরিণত হওয়ার। এদের কাছ থেকে শেখার কিছুই নেই। বাঙালি যাতে বাঙালি থাকতে পারে তার জন্য চেষ্টা করার মূল দায়িত্বটা নিতে হবে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেটা একেবারেই প্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়াবে সেটা হলো বাঙালির শত্র“কে চিহ্নিত করা। অনেক কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে লাভ নেই, বরং সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। বাঙালির আসল শত্র“ হচ্ছে পুঁজিবাদ। শ্রেণী বিভাজন, মুনাফা লোলুপতা, আত্মস্বার্থপরতা, পরস্পরবিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি যেসব ব্যাধি বাঙালিকে সামাজিক হতে দিচ্ছে না, বাঙালির বাঁচা ও বিকাশের জন্য অরিহার্য যে সংস্কৃতির জাগরণ সেটার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলোর সব কিছুই পুঁজিবাদেরই অবদান। পুঁজিবাদ যে মানুষের কত বড় শত্র“ তা আজ উšে§াচিত সত্য। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। শ্রেণী বিভাজন দূর করতে হবে। শ্রেণী বিভাজন জিইয়ে রেখে পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন-অগ্রগতির চিন্তা করাটাই অনুচিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
(মানবকণ্ঠ, ২৩/০৪/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন