(গতকালের পর)
আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের উভয়েই পুঁজিবাদে বিশ্বাস করে এবং প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চায় না। যে পরিমাণে গণতন্ত্র চায় না, ঠিক সেই পরিমাণেই তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় ও ইহজাগতিকতায় অবিশ্বাসীর মতো আচরণ করে। তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়েই জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা সমাজে ও রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। ধর্মকে উভয় দলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ ভোটের আশায় ব্যবহার করেছে। ফলে তথাকথিত ইসলামপন্থীরা, যাদের সামাজিক ভিত্তিটা আগেও মোটামুটি শক্তই ছিল, তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় রূপেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আমাদের শাসকদের ভেতর ক্ষমতার জবরদখলকারী স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ধার্মিকতার জন্য নয়, ব্যভিচার ও দুর্নীতির জন্যই প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। শিল্পী কামরুল হাসান ইয়াহিয়া খানের ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেছিলেন হিংস্র পশু হিসেবে, এরশাদকে চিত্রিত করেছিলেন বিশ্ববেহায়া হিসেবে; এই বেহায়া ব্যক্তিটিই শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং পরে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে ছেড়েছেন। আমাদের জন্য লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়, তিনিও রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়েছেন, দুই বড় দলই তাঁকে কেবল পাত্তা দেয় না, তাঁকে ধরে টানাটানি পর্যন্ত করে।
ওদিকে সমাজে দারিদ্র্য, অবিচার, শোষণ, এসব কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নতি যা ঘটেছে তা অল্প কিছু সুবিধাভোগীর। বাকিরা বঞ্চিতই রয়ে গেছে। এই বঞ্চিত মানুষরা কোথাও কোনো আশ্রয় দেখতে পায় না, ভরসা করার জায়গার সন্ধান জানে না। ফলে তারা ধর্মের ওপরই ভরসা করে আশা করে, ইহকালে যারা তাদের নির্যাতন করছে পরকালে তারা জ্বলন্ত অগ্নিতে দগ্ধ হবে। এভাবে ধর্মবাদিতা বৃদ্ধি পায়, এবং ধর্মকে নিয়ে যারা ব্যবসা করে সে-ই ছদ্ম ধার্মিক, কিন্তু আসলে ভোগবাদীরা সুবিধা পায়। মানুষের মধ্যে ইহজগতের ওপর আস্থাটা কমে আসে।
রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজ হবে ইহজাগতিক
দেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে, কিন্তু সেই শিক্ষা মনোজগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পেরেছে তা নয়। জ্ঞানানুশীলনে অনীহা, সুস্থ বিনোদনে অংশগ্রহণ না করা, সামাজিক আদান-প্রদানের অভাব, সংস্কৃতি চর্চার অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে সাংস্কৃতিক মান উন্নত হয়নি; উল্টো নিম্নগামী হয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা অধিকাংশই ব্যবসায়ী এবং তাঁদের অনেকেরই সাংস্কৃতিক মান এতটাই নিচু যে তাঁদের কাছ থেকে যত কম শিক্ষা নেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অথচ তাঁরাই তো দৃষ্টান্ত হিসেবে জনমাধ্যমে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান; তাঁরাই তো ক্ষমতার জোরে সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত। ইহজাগতিকতা সংস্কৃতিকে উন্নত করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু সে উন্নয়নের নিম্নতম ভিত্তি যদি অনুপস্থিত থাকে তাহলে ইহজাগতিকতার পক্ষে হতাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর কী? সত্য এটিও যে অনেক মেধাবান মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতার মতোই সংস্কৃতিচর্চার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি, চর্চাটা বিশেষ বিশেষ বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ইউরোপে যে ইহজাগতিকতার উন্মেষ ঘটেছিল, তার পেছনে ছিল রেনেসান্স। বাংলাতেও একটি রেনেসান্স ঘটেছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু সে দাবি যে যথার্থ নয়, তার বড় প্রমাণ ইহজাগতিকতার দৈন্যদশা। যাকে রেনেসান্স বলা হচ্ছে, সেটি হলো, ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে সৃষ্ট চিত্তচাঞ্চল্য। রেনেসান্সের একটি বড় গুণ হচ্ছে মাতৃভাষার চর্চা। বাংলায় সেটি ঘটেছে এবং বেশ ভালোভাবেই ঘটেছে। কিন্তু ওই চর্চাটি যে ব্যাপক হয়েছে, তা বলার উপায় নেই। আসলে চিত্তচাঞ্চল্যটি ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক, তার বাইরে সেটি যেতে পারেনি। তদুপরি কথিত রেনেসান্সের একটি ধারা আবার হারিয়ে গেল ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অন্ধকারে। সর্বোপরি পরাধীন দেশে রেনেসান্স সম্ভব করা পাথর দিয়ে সোনার বাটি তৈরির মতোই অসম্ভব কাজ। রেনেসান্স মনের স্বাধীনতা আনে, কিন্তু মন বাস করে দেশে, দেশ স্বাধীন না হলে মনকে স্বাধীন করা কঠিন।
বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ভেতরেই ধর্মীয় পরিচয় ও ভাষাভিত্তিক জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব আছে। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখব, এখানকার মুসলমানরা কখনো তাদের বাঙালি পরিচয়কে, আবার কখনো ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে চেয়েছে। একাত্তরের পর বাঙালি পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে ওঠার কথা এবং সেটি ঠিকই উঠেছিল; কিন্তু সে উত্থান স্থায়ী হয়নি। তার বড় কারণ দেশের ঘটনাবলি ও নানা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা বাঙালির ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতাকে মলিন করে দিল। ওদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলিম-খ্রিস্টান বিরোধ দেখা দিয়েছে। এর ফলে বাঙালি মুসলমানের মুসলিম পরিচয়টা তার জন্য বাঙালিত্বের বাইরে বড় একটি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগের সুযোগ তৈরি করে দিল এবং মুসলিম বিশ্বের অর্জনগুলোর অংশীদার ভাবার জন্য তাকে উৎসাহ জোগাল। অনেকের কাছেই মুসলিম পরিচয়টা বাঙালি পরিচয়ের তুলনায় অধিক সম্মানজনক ঠেকল। বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটিও সমাধান দাবি করছিল।
বাংলাদেশের তরুণরা অনেক কারণেই বিক্ষুব্ধ। কিন্তু তাদের জন্য ক্ষোভ প্রকাশের পথ নেই। একসময় বামপন্থী আন্দোলনের একটি শক্তিশালী ধারা প্রবহমান ছিল, বাম ধারায় কেবল যে সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন, তা নয়, সরকারবিরোধী (এবং রাষ্ট্রবিরোধীও বটে) অবস্থানের দরুন জাতীয়তাবাদীরাও দক্ষিণে নয়, বামেই ছিলেন। তরুণরা ওই ধারায় যুক্ত হতো। এখন দলীয় আনুগত্য নির্বিশেষে জাতীয়তাবাদীরা সবাই দক্ষিণপন্থী, অর্থাৎ পুঁজিবাদী। অস্পষ্ট করে হলেও বিক্ষুব্ধ তরুণরা জানে যে পুঁজিবাদই হচ্ছে শত্রু, কিন্তু পুঁজিবাদবিরোধী বাম আন্দোলন এখন আর আগের মতো নেই। আন্দোলনকারী নেতারা অনেকেই হতাশার আক্রমণে ও প্রলোভনের বশে জাতীয়তাবাদী হয়ে গেছেন; কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যে বামপন্থীরা এখনো টিকে আছেন, তাঁদের ওপর নানা দমন-পীড়ন চলছে। জনমাধ্যমে প্রচারও তাঁদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ। তরুণ তার বিক্ষোভ প্রকাশ করবে, এমন সংগঠন পায় না। সে যুক্ত হতে চায়, তার ভেতর আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা। তথাকথিত ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোকে তারা অনেকটা হাতের কাছেই পেয়ে যায় এবং তাদের হাতছানিতে ধর্মীয় রাজনীতির পথে যাত্রা করে। বামের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি যে জঙ্গি তৎপরতার একটি কারণ, সেটি বুদ্ধিমান উদারনৈতিক মানুষরাও বুঝতে চান না। অনেক অভিভাবক আছেন, যাঁরা ছেলেটি নিয়মিত মসজিদে যাচ্ছে এবং মেয়েটি হিজাব পরছে দেখে খুশিই হন, ভাবেন ঠিক পথেই আছে, নইলে হয়তো বখে যেত। তরুণের এই আপাত ধর্মমুখিতা কেবল যে ইহজাগতিকতার প্রতি বিরূপতা তৈরি করছে তাই নয়, জঙ্গিবাদের মানসিক ক্ষেত্রটিকেও প্রসারিত করে দিচ্ছে।
আর মাদ্রাসা শিক্ষা। মাদ্রাসা শিক্ষার শিক্ষাগত মান নিয়ে তো প্রশ্ন আছেই, সামগ্রিক বিচারে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা যে মঙ্গলজনক নয়, সেটি সব সময়ই অনুমানের ব্যাপার ছিল, এখন তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের মতো একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই সংগঠনের ১৩ দফা দাবি অবিশ্বাস্য রকমের সরল, স্থূল ও অন্ধকারমুখী। নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না এবং ব্লাসফেমি আইন প্রবর্তন করতে হবে, এমন বিপজ্জনক দাবিও রয়েছে। হেফাজতিদের তৎপরতা দেখলে মনে হবে এ দেশে কেবল পুরুষই আছে, মেয়েরা নেই এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে হেফাজতিরা যা বলবে, তা-ই চূড়ান্ত। এদের আব্দার বাস্তবায়ন করলে আমাদের সব সমষ্টিগত অর্জনই ধুলায় লুণ্ঠিত হবে। অথচ তারা আমাদেরই আপনজন। এই সমাজেরই মানুষ।
হেফাজতের নেতারা যা-ই হোন, তাঁদের অনুসারীরা আসলে বঞ্চিত মানুষ। তাদের যে শিক্ষাটি দেওয়া হয়েছে, সেটিও বঞ্চনা বটে। নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার ছিল সাধারণ শিক্ষার; সেটি না দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার বেষ্টনীর ভেতর তাদের আটক করে রাখা হয়েছে। ওই শিক্ষা তাদের মধ্যে শিক্ষার অভিমান তৈরি করে, কিন্তু সে শিক্ষা বাস্তবিক জীবনে কাজে লাগে না। তারা নিজেদের শিক্ষাকে পবিত্র বলে জেনে কায়িক শ্রমকে অমর্যাদাকর জ্ঞান করে। মাদ্রাসা শিক্ষা গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের আশ্রয়। ওই শিক্ষাদানটি গরিব মানুষকে গরিব রাখার আয়োজন। এতে ধনীরা বেশ উৎসাহ বোধ করেন, গরিবদের গরিব ও সন্তুষ্ট রাখতে পারলে তাঁদের সুবিধা। ধনীরা মাদ্রাসা খোলেন, কিন্তু স্কুল গড়তে বললে মুখ ফিরিয়ে নেন। সরকার আসে, সরকার যায়, তাদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের কথা শোনা যায়, কিন্তু সবাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে থাকে। অভিপ্রায় দুটো। প্রথমটি, গরিব মানুষকে গরিব ও সন্তুষ্ট রাখা। দ্বিতীয়ত, ওই মানুষদের ভোট পাওয়া। হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবি করেছে; কিন্তু তাদের প্রত্যেকটি দাবি রাজনৈতিক ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়ে চিহ্নিত করার উপায় নেই। বিরোধী দল তো বটেই, সরকারও তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। ভোটের আশায়। ধনীরাই রাষ্ট্র চালান, তাঁরা নিজেরা ইহজগৎ সম্পর্কে খুবই সচেতন, কিভাবে ধন বৃদ্ধি করা যায় সে চিন্তায় অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু সমাজে দার্শনিকভাবে ইহজাগতিকতার চর্চা হোক, এটা চান না; যাঁরা ইহজাগতিকতার চর্চা করতে চান, তাঁদের শুধু সন্দেহ নয়, শত্রু বলেই বিবেচনা করেন। ফলে সমাজ এগোয় না। সমাজের সাংস্কৃতিক মান উন্নত হয় না। আমরা পশ্চাৎপদ রয়ে যাই। রাষ্ট্রের মালিকরা যা ইচ্ছা তাই করেন। সমাজ বদলের চেষ্টা গড়ে ওঠে না। আমাদের ভাবমূর্তি অপ্রতিরোধ্যরূপে মলিন হতে থাকে।
আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনলে তো এমন অনেক শিক্ষিত লোক আছেন, যাঁরা রীতিমতো শঙ্কিত বোধ করেন। ধারণা করেন যে তাঁদের ধর্মচর্চার অধিকার নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে। যে জন্য রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মধ্যে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তখন রাষ্ট্র পরিচালকদের পক্ষ থেকে বিশেষভাবেই আশ্বাস দিতে হয়েছিল যে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। তারপর রাষ্ট্র যখন পুরোপুরি পুরনো সেই পুঁজিবাদী রাস্তায় চলা শুরু করল, তখন তো আর রাখঢাক বলতে কিছু রইল না, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হলো। সরকারের বদল হয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে পরিচিতরাও ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের সময়ে অনেক কিছুরই রদবদল ঘটেছে, কিন্তু নির্বাসিত ধর্মনিরপেক্ষতা আর ফেরত আসেনি। বরং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বাহুল্য যুক্ত হয়ে গেছে, যে সংযুক্তিকে বিচ্যুত করার আগ্রহ কেউই দেখাচ্ছেন না। পুঁজিবাদীরা খুবই বস্তুবাদী, কিন্তু ধর্মকে তারা নানাভাবে ব্যবহার করে থাকে। বিভেদ সৃষ্টির জন্য, ভোটের জন্য, সর্বোপরি সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাসীদের দমন করার জন্য। বামপন্থীদের তারা সমাজদ্রোহী বলেও চিহ্নিত করে, এমনও বলে যে ওরা হচ্ছে নাস্তিক।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার কথা বলছিলাম। রাষ্ট্র ও সমাজে এ দুটি গুণের কার্যকর উপস্থিতিই কি যথেষ্ট? না, তা নয়। গণতন্ত্রের জন্য তারা প্রয়োজনীয়, কিন্তু এরা আছে বলেই রাষ্ট্রে ও সমাজে যে গণতন্ত্র রয়েছে তা অবশ্যই বলা যাবে না। এরা না থাকলে গণতন্ত্রের পথে এগোনো সম্ভব নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য আরো কিছু দরকার। সেটি হলো সাম্য। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতা মানুষের জন্য মুক্তির পথটিকে প্রশস্ত করে দিয়েছে, কিন্তু ওই পথেই আবার পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে। সামন্তবাদের তুলনায় পুঁজিবাদ অগ্রসর বটে, কিন্তু পুঁজিবাদও বৈষম্যের ওপরই নির্ভরশীল। পুঁজিবাদ গণতন্ত্র আনে না, গণতন্ত্রের জন্য প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদ 'কল্যাণ রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করতে চায় ও নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়, কিন্তু গণতন্ত্রের যেটি মর্মবস্তু, অধিকার ও সুযোগের সাম্য সেটিকে নিশ্চিত করবে কি, উল্টো তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাই প্রয়োজন হয় পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের। ওই আন্দোলন না থাকলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতা উভয়েই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যেমনটি আমাদের দেশে হচ্ছে, হচ্ছে পৃথিবীর সব দেশেই।
পুঁজিবাদের সমালোচনা উদারনীতিকরা করে থাকেন। কিন্তু শেষ বিচারে তাঁরা পুঁজিবাদের ধ্বংস চান না, চান সংস্কারের মধ্য দিয়েই তার সংরক্ষণ। সেদিক থেকে তাঁরা আসলে রক্ষণশীলই। তাঁরা ভদ্র আচরণে অভ্যস্ত, পুরোপুরি দক্ষিণপন্থী হতে চান না, কিন্তু পুঁজিবাদের চেয়েও বড় বিভীষিকা মনে করেন সমাজতন্ত্রকে। সমাজতন্ত্রও এক ধরনের সামাজিকতাই বৈষম্যহীন ও ইহজাগতিক সামাজিকতা। অর্থাৎ কিনা তার ধরনটি হলো উন্নত। সামাজিকতা না থাকলে মানুষ যে মানুষ থাকে না সেটি তো স্বীকৃত সত্য। পুঁজিবাদ সামাজিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না, তার কাজ মানুষকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করা; যে জন্য পুঁজিবাদনিয়ন্ত্রিত সমাজে মানুষের প্রবণতা থাকে স্বার্থপর ও আত্মসুখপরায়ণ হওয়ার। আমরা যে গণতন্ত্র চাই তার কারণ আমরা সামাজিকভাবে বাঁচতে চাই।
গণতন্ত্রের সংগ্রামে ধার্মিক লোকরাও থাকতে পারেন, থাকেনও, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা কখনোই থাকবে না। লাতিন আমেরিকার ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের একাংশকে দেখা গেছে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে। বর্তমানে বিশ্বক্যাথলিক সম্প্রদায়ের যিনি প্রধান, তিনি লাতিন আমেরিকার মানুষ। তাই দেখা যায়, অন্য কোনো পোপ যা কখনো করতেন না ইনি তা করছেন, পীড়িত বিশ্বের কথা বলছেন। যেমন বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের শ্রমদাসত্বের ব্যাপারে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ঘরের কাছেও দৃষ্টান্ত আছে। যেমন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ধার্মিক মানুষ; গ্রন্থপাঠে নয়, অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তিনি সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতা বুঝেছেন এবং মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্রের যে বিকল্প নেই, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। প্রকাশ্যে জোর দিয়ে না বললেও ভাসানী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও ইহজাগতিক সমাজেই বিশ্বাস করতেন। তিনি জাতীয়তাবাদের মোটেই বিরোধী ছিলেন না, পাকিস্তানি দুঃশাসন ছিন্ন করে বাংলাকে স্বাধীন করার আবশ্যকতার কথা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রকাশ্যে প্রথম ঘোষণা করেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদের সীমা তিনি অতিক্রম করে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রথম কাতারে। পুঁজিবাদবিরোধী মানুষ সমাজে আছেন। কিন্তু তাঁরা যে একত্র হয়ে মুক্তির অনুকূলে বড় একটি আন্দোলন গড়ে তুলবেন, তেমনটি ঘটেনি। আর ঘটেনি বলেই আমাদের রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়নি, সমাজ পারেনি ইহজাগতিক হতে। আমরা পিছিয়ে আছি। এই সত্যটিকে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের একেবারে সামনে রাখাটি খুবই জরুরি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও লেখক,
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(কালের কণ্ঠ, ১০/০৪/২০১৪)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন