লন্ডনে শেখ হাসিনার সফর
25 April 2018, Wednesday
আমার একটা বিশ্বাস ছিল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়ার পরও দলটি দেশে যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথে রয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে সন্ত্রাসের পথে যায়নি, তখন বিদেশেও তারা সন্ত্রাসের পথে না যাওয়ার জন্য তাদের নেত্রীর নির্দেশ মেনে চলবে।
এই প্রত্যাশাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফর শুরু হওয়ার আগের দিন থেকেই যুক্তরাজ্য বিএনপি যে বিক্ষোভ শুরু করে তার শান্তিপূর্ণ চেহারা দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম এবং ঢাকার অন্য একটি কাগজে আমার কলামে লিখেছিলাম, লন্ডনে বিএনপির প্রতিবাদ মিছিলে লোক তেমন নেই এবং তা শান্তিপূর্ণ।
এ লেখার কালি না শুকাতেই লন্ডনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর নামে বিএনপি যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তা ধারণাতীত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে এসেছেন কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে। কমনওয়েলথের অন্য দেশের নেতারাও এসেছেন। আর কোনো দেশের নেতার বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই লন্ডনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে।
ওয়েস্টমিনস্টারে মোদির পক্ষে এবং বিপক্ষে ভারতীয়রা জমায়েত হয়েছেন, মোদির বিরুদ্ধবাদীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কিন্তু গুণ্ডামি করেননি। দু’পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে একদল মোদির পক্ষে, অন্য দল মোদির বিপক্ষে স্লোগান দিয়েছে। তাদের আচরণ ছিল সংযত এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতিসম্মত।
কিন্তু লন্ডনে শেখ হাসিনা আসার পর বিএনপির কর্মীবাহিনী নামে পরিচিত বাহিনীটি অসংযত, অশালীন এবং হিংসাত্মক যে আচরণ দেখিয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক দলের নেতাকর্মীদের আচরণ নয়।
ত্রিশের নাৎসি দলের বাদামি শার্ট বাহিনীর আচরণ এটা। গত শতকের ত্রিশের দশকে হিটলারের বাদামি শার্ট বাহিনী লন্ডনের রাজপথে এসে এ ধরনের হিংস্র আচরণের পরিচয় দেখাতে পারেনি।
কিন্তু বর্তমান শতকের দ্বিতীয় দশকে লন্ডনের রাজপথে বিএনপির কর্মীবাহিনী সেই হিংস্রতা দেখাতে পেরেছে। গত কয়েকদিন লন্ডনের রাজপথে এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু হিংস্রতা ছিল বেশি।
শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাতে লন্ডন, ব্রিটেন ও ইউরোপের নানা শহর থেকে আগত বাংলাদেশিদের ওপর ভাঙা কাচের বোতল, ছেড়া জুতা, লোহার ডাণ্ডা নিয়ে আক্রমণের চেষ্টাসহ বাংলাদেশের এক উপমন্ত্রীকে বেকায়দায় পেয়ে তার ওপরও হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় তারা।
বিএনপির ঝটিকা বাহিনীর এ তাণ্ডব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা কমনওয়েলথের অন্য দেশের নেতাদের দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ তারা ছিলেন অনেক দূরে এবং তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু আমার মতো অনেক বাঙালি-অবাঙালি সাধারণ মানুষ তা দেখতে পেরেছে।
২১ এপ্রিল (শনিবার) দুপুরে আমি যখন শেখ হাসিনার সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে ওয়েস্টমিনস্টারে যাই, তখন দেখি, রাস্তার অপর পাশে একদল লোক কালো পতাকা হাতে অভব্য ভাষায় খিস্তিখেউড় করছে। সেখানে পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাই তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠতে পারেনি। এরা সবাই বিএনপির রাজনৈতিক কর্মী, না তাদের মধ্যে ভাড়াটে গুণ্ডারাও আছে তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।
বাংলাদেশে বিএনপির দুই নেতা ফখরুল-রিজভী দাবি করেন তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-মিছিল করতে চাইলেও সরকার তাতে বাধা দিচ্ছে।
লন্ডনে বিএনপির মিছিলের চেহারা দেখার পর আমার মনে হয়েছে, ঢাকায় এই ‘শান্তিপূর্ণ’ সভা ও মিছিলের চেহারাটা কী হতে পারে বা হতে পারত? লন্ডনে ১৬ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত বিএনপি হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল ও মিডিয়া প্রচারণার জন্য যে অর্থ খরচ করেছে, তার পরিমাণ কত এবং কারা তা জুগিয়েছে, সম্ভবত তারেক রহমান ছাড়া আর কেউ তা বলতে পারবেন না।
কথায় বলে, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন।’ বিএনপির এই গৌরী সেন কে বা কারা তাও সম্ভবত বিএনপির নতুন নেতা তারেক রহমানেরই জানার কথা।
সাতদিন ধরে লন্ডনের বিভিন্ন রাস্তায় লোক জড়ো করে রাখা, ব্রিটেন ও ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে বাসভর্তি করে সমর্থকদের (অথবা ভাড়াটে লোক) আনা, ফ্রি খালেদা জিয়া (খালেদা জিয়াকে মুক্তি দাও) লেখা বিলবোর্ড লাগানো অসংখ্য ভ্যান রাজপথে টহল দেয়ার জন্য নামানো এবং একটি ব্রিটিশ টেলিভিশনকে প্রচারণার কাজে নিয়োগ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারেক জিয়া লন্ডনে সপরিবারে আছেন দশ বছর ধরে। মাঝে মাঝে সভা করেন অভিজাত হল ভাড়া করে।
ব্রিটিশ এলিট ক্লাস এবং মিডিয়ার একটি অংশকে নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা বিএনপি ও জামায়াতের বহুদিনের এবং তাতে তারা সফল হয়। তার ফলে লর্ড কারলাইন, টবি ক্যাডমেনের মতো বিশিষ্ট ব্রিটিশ ব্যক্তিরা জামায়াত-বিএনপির প্রচারণায় সাহায্য ও সমর্থন জোগাতে শুরু করেন। প্
রভাবশালী মিডিয়ার মধ্যে গার্ডিয়ান, ইকোনমিস্ট এবং অতি সম্প্রতি চ্যানেল ফোর এই ব্যান্ড ওয়াগানে যোগ দেয়। অনেকেরই সন্দেহ এবং অভিযোগ, এজন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে বিশেষ করে জামায়াতকে বিপুল অর্থের জোগান দিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবেরও সহায়তা ছিল বলে অনেকের সন্দেহ।
ব্রিটেনে বাংলাদেশের জামায়াতের ঘাঁটি শক্ত হওয়ার আগে সৌদি আরবের টাকায় লন্ডনে একটি ‘মুসলিম পার্লামেন্ট’ গঠনের চেষ্টা করা হয়। এর উদ্যোক্তা ছিলেন একজন ব্রিটিশ মুসলিম সাংবাদিক।
তিনি গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় বিভাগের সদস্য ছিলেন। সম্ভবত তার মাধ্যমেই ‘গার্ডিয়ানে’ আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হয়। এ ‘মুসলিম পার্লামেন্ট’ গঠনের আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
কিন্তু এই আন্দোলনের সমর্থকরা গার্ডিয়ানসহ ইকোনমিস্ট ও সম্প্রতি চ্যানেল ফোর টেলিভিশনে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হন। ইকোনমিস্ট নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা প্রচারণা চালায়।
শেখ হাসিনার লন্ডন অবস্থানকালে চ্যানেল ফোর অত্যন্ত নগ্ন প্রচারণা চালায়। তাতে বিএনপি উল্লসিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে চ্যানেলটির মুখোশ
উন্মোচিত হয়েছে। এই চ্যানেলের সাংবাদিক-প্রতিবেদক এলেক্স থমসন প্রথমে শেখ রেহানা-কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো শুরু করেন। টিউলিপ ব্রিটিশ এমপি, কিন্তু থমসন প্রচার চালাতে থাকেন, টিউলিপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটা ফোন করলেই গুম হওয়া কয়েক ব্যক্তি উদ্ধার পেয়ে যেত। কারণ শেখ হাসিনার তিনি ভাগ্নি, থমসনের সমস্ত কাতরতা ফাঁসি হওয়া দুই জামায়াত নেতার গুম হওয়া দুই পুত্রকে নিয়ে।
শেখ হাসিনার বর্তমান লন্ডন সফরকালেও এলেক্স থমসনের ভূমিকা সাংবাদিকের নয়, ভূমিকাটি কনট্রাক্ট-এজেন্টের। এক প্রশ্নোত্তর সভায় প্রধানমন্ত্রীর জবাবদানের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর থমসন বাংলাদেশের গুম হওয়া লোকদের সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।
অনুষ্ঠানের পরিচালক তাকে জানান, প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু থমসন তার টেলিভিশন প্রতিবেদনে প্রচার করেন, শেখ হাসিনা তার প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি। থমসনের প্রতিবেদনে হাসিনাবিদ্বেষ প্রকট এবং বিএনপি-জামায়াতের প্রতি সমর্থন লক্ষণীয়।
গোলাম আযম ও মীর কাশেম আলীর পুত্রদ্বয়ের গুম হওয়া নিয়ে তিনি অনবরত অসত্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এ ডেসপারেট অবস্থা কেন, তা লিখে বলার সম্ভবত কোনো দরকার নেই।
আমার কথা, গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা বিক্ষোভের বিধান আছে, কিন্তু কালো পতাকা-গুণ্ডামির কোনো সমর্থন নেই। খালেদা জিয়া জেলে গেছেন রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে রাজনৈতিক কারণে নয়।
তিনি জেলে গেছেন দুর্নীতির দায়ে আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে। তার পুত্র তারেক রহমানও কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়- আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে তিনি এখন পলাতক ব্যক্তি।
ব্রিটেন তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় কীভাবে সে প্রশ্ন উঠছে এখন। একজন দণ্ডিত আসামিকে দলের নতুন নেতা করার জন্যও বিএনপির গঠনতন্ত্র গোপনে বদলাতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাকে।
আমি এবার লন্ডনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাকে তারেক রহমানের তৎপরতা বন্ধ করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। তাকে বলেছি, তারেক দমিত হলে দেশ বাঁচবে, তার দল বিএনপিও বাঁচবে। দলটি সুস্থ গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে।
উৎসঃ যুগ ান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন