আগুন নিয়ে খেলা
28 August 2017, Monday
ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় নিয়ে এ যাবত যা লিখেছি, সবই মনে হয় অরণ্যে রোদন। এই রায় সম্পর্কে সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পারস্পরিক আলোচনাক্রমে একটা সুস্থ মীমাংসায় পৌঁছার বদলে চলছে অসুস্থ গালিগালাজ ও হুমকি প্রদর্শন। প্রধান বিচারপতিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। আমরা আগুন নিয়ে খেলছি। এই খেলার পরিণতি কী হবে তা কেউ ভেবে দেখছি না।
এভাবে দেশের প্রধান বিচারপতির ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করা হলে তা যে দেশের জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করবে তা আমরা ভেবে দেখছি না। গণতান্ত্রিক শাসনের একটি স্তম্ভ জুডিশিয়ারি। তার মর্যাদা নষ্ট হলে দেশে গণতন্ত্রের মর্যাদাও রক্ষা পাবে না। ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সমালোচনা করা চলে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগও তোলা যায়। কিন্তু প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে সবদিক বিবেচনা করে দেখতে হবে। আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। মাছের বাজারের ভাষা এখানে ব্যবহার করা চলবে না।
ঢাকার ৭১ টিভি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে একটি সিরিজ অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেছে। তারা প্রধান বিচারপতিকে দেয়া বড় অংকের টাকার দুটি চেক দেখিয়েছে এবং বলেছে, তাদের কাছে আরও দুর্নীতির প্রমাণপত্র আছে। তা-ও তারা দেখাবে। একইভাবে দু’দিন আগে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে উপস্থিত ছিলেন একজন সাবেক মন্ত্রী এবং সাবেক বিচারপতি। তারা যে ভাষায় প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে কথা বলেছেন, তা সভ্য মানুষের ভাষা নয়। তাকে তুই তোকারি তো করা হয়েছেই, সেই সঙ্গে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তোমাকে শুধু চাকরি ছাড়লে হবে না, দেশ ছাড়তে হবে।’
এই সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক বিচারপতি আমার পরিচিত বন্ধু। সাবেক বিচারপতি তো বর্তমান প্রধান বিচারপতির সহকর্মীও ছিলেন। তাদের মধ্যে মনোমালিন্য ঘটেছিল এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সামনে রেখে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নানা প্রচারণাও শুরু করা হয়েছিল। তা সত্য প্রমাণিত হয়নি, বরং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এই সাবেক বিচারপতি যদি এই ধরনের লাগামছাড়া কথাবার্তা বলতে থাকেন, তাহলে তিনি নিজে একজন সাবেক বিচারপতি হয়েও প্রতিশোধমূলক মনোভাব দ্বারা তাড়িত হয়ে বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করছেন না, এটাই সবার মনে হবে।
বিতর্কটি ছিল সংবিধানে একটি ধারার সংশোধনী নিয়ে। এটা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভালো বোঝেন এবং তারা মতামত দেবেন। যদু-মধুর এ সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ নেই এবং তাদের কথা বলা উচিতও নয়। কিন্তু ছাত্রলীগের এক নেতাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত বিশাল রায়ের এক পাতাও তিনি পড়েছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে।
প্রধান বিচারপতি কি সত্যিই দুর্নীতিবাজ? যদি হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়ার সময় আওয়ামী লীগ সরকার তার অতীত ও বর্তমান খতিয়ে দেখেনি? সবচেয়ে বড় কথা, এতকাল যে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি, এখন ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় দেয়ার পর হঠাৎ তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলা এবং তার বিরুদ্ধে অশোভন কথাবার্তা বলা থেকে কি সাধারণ মানুষ এই ধারণাই করবে না যে, এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ? এই অভিযোগ মানুষ বিশ্বাস করতে চাইবে না। তারা এমনও ভাবতে পারে যে, সরকারই হয়তো তাকে তার পদ থেকে সরানোর জন্য পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। জনসাধারণের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হলে তা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে দারুণভাবে।
একটা উদাহরণ দেই। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তি ধ্বংস করার জন্য তার বিরুদ্ধে ১৯টি দুর্নীতির মামলা দেয়া হয়েছিল। মামলাগুলো চলাকালে তৎকালীন শাসকদের সমর্থক ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে তার রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল। তাতে তখনকার প্রধান বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ কড়া ভাষায় পত্রিকাটিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই একজন জনপ্রিয় নেতার চরিত্র হননের চেষ্টা শুধু আদালত অবমাননা নয়, একটি শাস্তিযোগ্য গুরুতর অপরাধও।’
বর্তমান প্রধান বিচারপতি সম্পর্কেও অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে প্রকাশ্যে অশোভন ভাষায় সমালোচনা এবং তার মিডিয়া ট্রায়াল কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারে না। তার বিরুদ্ধে সত্যিই যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, তাহলে মিডিয়া তা তুলে ধরতে পারে; কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ করার আগেই তার চরিত্র হননের প্রোপাগান্ডা শুরু করতে পারে না। আর রাষ্ট্রপতি কোনো অপরাধ করলে তার ইমপিচমেন্টের যেমন সাংবিধানিক বিধান আছে, তেমন বিধান আছে প্রধান বিচারপতির বেলাতেও। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সম্পর্কে সেরকম কোনো অভিযোগ থাকলে আইনের নির্দেশ মেনে তদন্ত হোক, তদন্তে অভিযোগ সঠিক প্রমাণিত হলে তার ইমপিচমেন্টের ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু তাকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করার এই অভিযোগ চালানো হলে মনে হবে এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কাজ। তাতে সরকার দুর্নামগ্রস্ত হবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চারটি মূল স্তম্ভের দুটি হল পার্লামেন্ট ও জুডিশিয়ারি। বর্তমানে বাংলাদেশে পার্লামেন্ট প্রকৃত বিরোধীদলবিহীনভাবে তেমন সক্রিয় ও কার্যকর নয়। তার ওপর জুডিশিয়ারিও যদি তার ক্রেডিবিলিটি হারায়, তাহলে যে বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি হবে তাতে গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রুর সংখ্যা কম নয় এবং তাদের সংঘবদ্ধ তৎপরতাও খুব গোপন একটা ব্যাপার নয়। তারা যদি দেশে গণতন্ত্র অচল, রাজনীতিকরা এবং বিচার বিভাগ সবাই দুর্নীতিপরায়ণ এই ধুয়া তুলে ক্ষমতা দখলের সুযোগ পায় (যে ধুয়া অতীতেও তোলা হয়েছিল) তাহলে তাদের ঠেকাবে কে? যারা এখন মাঠ গরম করে বড় বড় কথা বলছেন, তারাই কি সবার আগে দেশ ছেড়ে পালাবেন না?
আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় আস্থা রাখি। তিনি অনেক দূরতিক্রম্য সংকট নিজের সাহস ও দক্ষতার বলে পার হয়েছেন। এ সংকটও পার হবেন বলে আশা রাখি। তিনি ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় নিয়ে বিতর্কের একটা সাংবিধানিক সমাধান করুন। প্রধান বিচারপতিকেও আলোচনায় ডাকুন, তার বিরুদ্ধে লাগামহীন প্রচারণা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। প্রধান বিচারপতিরও উচিত হবে তার পর্যালোচনা থেকে বিতর্কিত অংশগুলো এক্সপাঞ্জ করা; তার সম্পর্কে মিডিয়া-প্রচারের যথাযোগ্য জবাব দেয়া এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা।
এবারের বিতর্কে যদি বিচার বিভাগের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়, তাহলে নির্বাহী বিভাগের ক্রেডিবিলিটিও রক্ষা পাবে না। বিচার বিভাগের মর্যাদা যতটা ক্ষুণœ করা হয়েছে, তা উদ্ধারে বহুযুগ লাগবে। আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী ও নেতা লাগামহীন কথাবার্তা শুরু করেছেন, তারা যেন সতর্ক হোন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শূন্যাবস্থা সৃষ্টি করে তারা যেন সেই শূন্যাবস্থা পূরণে একটি অপশক্তির জন্য পথ খুলে না দেন। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা তাদের স্মরণ করিয়ে দেই:
‘প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে বড়াই
জেন মনে তখন তাহার বিধির সঙ্গে লড়াই।’
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন