বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থার দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্বে এখন ব্যাপক সঙ্ঘাত চলছে। দেশগুলো এখন ভ্রাতৃঘাতী বিরোধে লিপ্ত। আরবের মক্কানগরী মহানবী সা:-এর প্রিয় জন্মভূমি। একসময়ের ‘জাজিরাতুল আরব’ই আজকের সৌদি আরব। রাসূল সা:-এর স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যময় এই দেশ ইসলাম ও মহানবী সা:-এর সঠিক আদর্শে উজ্জীবিত রাষ্ট্রের প্রতীক হয়ে থাকবে এবং মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণে কাম্য ভূমিকা রাখবে- এটিই মুসলিম উম্মাহর কাম্য। কিন্তু সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব, সৌদি-ইয়েমেন যুদ্ধ, সৌদি-কাতার বিরোধ মুসলমানদের স্বার্থকে দুর্বল করে ফেলছে। ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক মাখামাখি বিশ্ব মুসলিমকে বেদনাহত করছে। একই সাথে মিসর-তুরস্ক বিরোধ এবং ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সুদান, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনে নানা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ও গৃহযুদ্ধের ঘটনা মুসলমানদের মধ্যে দুঃখবোধের সৃষ্টি করছে। মুসলমানেরা এখন সংখ্যায় বিশ্বের সামনের সারিতে। অথচ ‘ব্যবহৃত’ হওয়া ছাড়া পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ আয়োজন কিংবা উপলক্ষে তাদের উপস্থিতি নেই। মুসলিম বিশ্বের বিচ্ছিন্নতা উম্মাহর জন্য পীড়াদায়ক। চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতায় বাকি বিশ্বের সাথে মুসলমানদের সমন্বয় করা অপরিহার্য। এ জন্য নিজেদের ঐতিহ্য নতুন করে পাঠ করতে হবে।
মুসলমানদের সেই ঐতিহ্য হচ্ছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রেখে যাওয়া আদর্শ ও দৃষ্টান্ত। মহানবী সা: বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। এর সব শিক্ষা ও আদর্শ মানবজাতির জন্য চিরকল্যাণকর। ভ্রাতৃত্ববোধের ক্ষেত্রেও ইসলাম সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামে সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক, কালো হোক সাদা হোক, ধনী হোক কিংবা নির্ধন- সব মুসলমান ভাই ভাই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত-১০)।
মহানবী সা: বলেন, ‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই’ (বুখারি)। অর্থাৎ বিশ্বের সব মুসলমান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। পরস্পরের প্রতি তারা ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করবে- এটাই ইসলামের শিক্ষা। অন্য একটি হাদিসে মুসলমানদের পরস্পরের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, সব মুমিন একটি মাত্র দেহের মতো, যদি দেহের এক অংশে ব্যথা হয় তবে তা যেমন অনুভূত হয় সর্বাঙ্গে, ঠিক তেমনিভাবে একজন মুসলমান কষ্ট পেলে, সেই কষ্ট অনুভব করে সমগ্র মুসলিম জাহানের মুসলমানরা (বুখারি ও মুসলিম)।
মুসলিমরা পৃথিবীর যেকোনো দেশের অধিবাসী, যেকোনো ভাষাভাষী হোক না কেন, তারা এক ও অবিচ্ছেদ্য। কারণ তারা একই কালেমা তাইয়েবার সোনালি সূত্রে গাঁথা। তারা এক আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাসী, এক আল্লাহর ইবাদত করে। তারা একই রাসূল সা:, একই কুরআনের অনুসারী এবং একই কেবলামুখী হয়ে নামাজ আদায়কারী।
মহানবী সা: বলেন, যেহেতু এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, তাই তারা একে অন্যের প্রতি জুলুম করে না, একে অন্যকে তিরস্কার করে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটায়, আল্লাহ পাক তার প্রয়োজন মেটাবেন। কোনো মুসলমানের দুঃখ-কষ্ট যে লাঘব করবে, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। কোনো মুসলমান যদি তার আরেক মুসলমান ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করে, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন করবেন।
ইসলামের স্বর্ণযুগের কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে, তদানীন্তন মুসলিম সমাজ কিভাবে একে অন্যের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় দিতেন। মহানবী সা: মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন তার হিজরতের কথা জেনে আরবের চার দিক থেকে নির্যাতিত-অত্যাচারিত মুসলমানরা দলে দলে মদিনায় সমবেত হন। নবাগত বিপুলসংখ্যক মুসলমানের ভরণপোষণ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ অবস্থায় রাসূল সা: হিজরত করে আসা নবাগত মুসলমান (মুহাজির) ও স্থানীয় মুসলমানদের (আনসার) একত্র করে ঘোষণা করেন- ‘তোমরা পরস্পর ভাই ভাই।’ এই পবিত্র বাণীর গুরুত্ব মুসলমানদের কাছে এত বেশি মূল্যবান ছিল যে, পরমুহূর্তেই আনসাররা তাদের প্রত্যেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অর্ধেক করে মুহাজিরিনের মধ্যে বণ্টন করে দেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধক্ষেত্রের একটি ঘটনা। ইবনে হুজায়ফা বলেন, এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমার চাচাতো ভাইয়ের খোঁজ করেছিলাম। সাথে নিয়েছিলাম এক পাত্র পানি। যদি তাকে তৃষ্ণার্ত দেখি, পানি পান করাব। হঠাৎ এক স্থানে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পেলাম। তার মৃত্যুযন্ত্রণা হচ্ছিল। আমি তাকে পানি দেবো কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি ইশারায় সম্মতি জানালেন। এমন সময় তার কাছেই আরেকজন মুমূর্ষু লোক চিৎকার করে উঠলেন। তারও মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল। তার চিৎকার শুনে আমার ভাই আমাকে তার নিকট পানি নিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন। তিনি ছিলেন হিশাম ইবনে আবিল আস। আমি তার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অন্য একজন সাহাবি মরণাপন্ন হয়ে চিৎকার করে উঠলেন। হিশাম আমাকে ওই সাহাবির নিকট পানি নিয়ে যেতে বললেন। তার কাছে পানি নিয়ে গিয়ে দেখলাম, তার প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে। তখন হিশামের কাছে ফিরে এসে দেখি তিনিও আর ইহজগতে নেই। সেখান থেকে ফিরে আমার ভাইয়ের কাছে এসে তাকেও জীবিত পেলাম না।’
কী অদ্ভুত সহানুভূতি, ওষ্ঠাগতপ্রাণ, তৃষ্ণার্ত সৈনিক মৃত্যুর মুহূর্তেও নিজের প্রয়োজনকে তুচ্ছজ্ঞান করে অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কী অতুলনীয় ত্যাগ স্বীকার! ভ্রাতৃত্ববোধের এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই তুলনাহীন।
মসজিদে নববীতে ইতেকাফে রত ছিলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:। এমন সময় এক মুসলমান ভাই তাকে সালাম করে চিন্তিত অবস্থায় মসজিদের এক পাশে গিয়ে বসলেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: তাকে চিন্তিত হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি তার সমস্যার কথা বললেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: তার জবাবে বললেন, আপনার এই কষ্ট দূর করার জন্য চেষ্টা করব কি না। ওই লোক বললেন, তাহলে তো খুবই ভালো হয়; কিন্তু আপনি তো ইতেকাফে রয়েছেন?
অর্থাৎ আপনি তো মসজিদ থেকে বাইরে বেরোতে পারবেন না। তখন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:-এর চোখে পানি এসে গেল। এ অবস্থায় তিনি বললেন, আমি প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছ থেকে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান ভাইয়ের প্রয়োজনের জন্য বের হবে, দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে সচেষ্ট হবে, তার এই কাজ মসজিদে নববীতে ১০ বছরের ইতেকাফের চেয়েও উত্তম।
ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা শুধু পার্থিব স্বার্থই একে অন্যের জন্য পরিত্যাগ করতেন না, পরকালীন জীবনের চির সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ পর্যন্ত একে অন্যের জন্য কোরবানি দিতে কুণ্ঠিত হতেন না।
হজরত আলী রা:-এর একটি ঘটনা। তিনি সব সময় হজরত আবু বকর রা:কে সালাম দিতেন। হজরত আবু বকর রা: অনেক চেষ্টা করেও হজরত আলী রা:কে আগে সালাম দিতে সক্ষম হতেন না। একদিন এর ব্যতিক্রম হলো। হজরত আলী রা: অভ্যাসমাফিক সালাম দিলেন না। তাই হজরত আবু বকর রা: প্রথমে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’। হজরত আবু বকর রা: চিন্তা করলেন নিশ্চয়ই কোনো কারণে হজরত আলী রা: মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন, যার কারণে অভ্যাসমাফিক আগে সালাম দেননি।
বিষয়টি তিনি হুজুর সা:-এর কাছে পেশ করলেন। মহানবী সা: হজরত আলী রা:কে ডেকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি একদিন স্বপ্নে বেহেশতের অতি সৌম্য সুন্দর একখানা প্রাসাদ দেখেছি। আমাকে তখন বলা হয়েছে, যে সর্বপ্রথম সালাম দেবে তাকেই ওই প্রাসাদ দেয়া হবে। তখন আমি চিন্তা করলাম, হজরত আবু বকর রা:ই এই প্রাসাদের যোগ্যতর অধিকারী। এ জন্য আমি তাকে আগে সালাম করিনি।
কাজের লোকদের ব্যাপারে মহানবী সা: বলেন- চাকর, গোলাম বা কাজের লোকেরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ পাক তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। কাজেই তোমরা যা আহার করবে তাদের সেটাই আহার করতে দেবে, তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরও সেরূপ পরিধান করাবে।
মহানবী সা:-এর কাছে আমির, ফকির, ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই ছিলেন সমান। সব মুসলমান সেখানে সম-অধিকার ভোগ করতেন। কারো প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হলে তা শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতেই করা হতো। গোত্রীয় অহংবোধকে মহানবী সা: অন্ধকার যুগের কুসংস্কার বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তার মুক্ত করে দেয়া গোলাম হজরত জায়েদ ইবনে হারেসার রা: সাথে আপন ফুফাতো বোন জয়নাব বিনতে জাহাশ রা:-এর বিবাহ দিয়ে কোরাইশদের গোত্রীয় দম্ভ চূর্ণ করে দেন এবং ভিনদেশী সাহাবি হজরত মেকদাদ বিন আল-আসওয়াদ কিনদির কাছে আপন চাচাতো বোন দোবা’আ বিনতে জোবায়েরকে বিয়ে দিয়েছিলেন।
মহানবী সা: ধর্মীয় ও জাগতিক সব কাজে অন্য সব মুসলমান ভাইয়ের সাথে সমভাবে অংশগ্রহণ করতেন। মসজিদে নববীর নির্মাণ এবং খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের কাজে সাহাবাদের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তাবুকের যুদ্ধের সময় হজরত আবদুল্লাহ জুলবাজাদাইন রা: ইন্তেকাল করলে অন্য সাহাবিদের সাথে হজরত মুহাম্মদ সা: কবর খননের কাজে অংশ নেন। অথচ তখন তাঁর সাথে ৩০ হাজার সাহাবি উপস্থিত ছিলেন।
একটি হাদিসে আছে মহানবী সা: বলেন, সে ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন হতে পারে না, যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা যতক্ষণ অন্য মুসলমান ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করে। তিনি এ কথাও ঘোষণা করেছেন, একজন মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ যখন তুমি মুসলমান ভাইয়ের সাথে মোলাকাত করো, তখন তাকে সালাম দাও; যখন সে তোমাকে দাওয়াত করে তখন তুমি দাওয়াত কবুল করো; যখন সে তোমার কাছে সাহায্য চায় তুমি তাকে সাহায্য করো; যখন তার হাঁচি আসে এবং সে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে তখন তুমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলে জবাব দিও; যখন সে অসুস্থ হয় তখন তাকে দেখতে যেও এবং যদি তার মৃত্যু হয় তবে তার জানাজায় গমন করো। মহানবী সা: আরো বলেন, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যে পর্যন্ত না প্রকৃত মুমিন হও। আর প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যে পর্যন্ত না একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করবে।’
ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলমানদের অবস্থা এমনই ছিল। স্নেহ-মমতা, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ইসলামি সমাজ তথা মুসলিম উম্মাহ। সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক মুসলিম বিশ্ব। অথচ সে জাতিই আজ দলাদলি, কলহ-দ্বন্দ্ব, বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত রয়েছে। আমরা যদি রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ অনুসরণ করি এবং স্বর্ণযুগের মুসলমানদের যেসব উজ্জ্বল উদাহরণ সামনে আছে সেসব মেনে চলি, তাহলে আবারো মুসলিম ঐতিহ্য আমরা ফিরে পাবো। ঈদে মিলাদুন্নবী সা:-এর এই পবিত্র দিনে আমাদের প্রত্যাশা হোক, সর্বক্ষেত্রে আমরা যেন মহানবী সা:-এর জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন