ভালো নেই বাংলাদেশ। এক ধরনের অসুস্থপ্রবণতা বিরাজ করছে সব ক্ষেত্রে। আগে কী কী ঘটেছে তা না-ই তুললাম। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে, তাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। মনে হয়, সবাইকে এক ধরনের মতিবিভ্রমতায় পেয়ে বসেছে।
বাংলাদেশই সম্ভবত প্রথম উদাহরণ- রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠল। তেমনি এটাও সম্ভবত এ দেশে প্রথম উদাহরণ- যে সুপ্রিম কোর্টের তিনি প্রধান বিচারপতি, ছুটিতে বিদেশে যাওয়ার পর সেই সুপ্রিম কোর্ট তার প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে বিবৃতি জারি করে জানিয়েছেন, তিনি দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত। আর এই অভিযোগের কারণে অন্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সাথে এক বেঞ্চে বসে বিচারকার্যক্রম চালাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
মানুষের মনে প্রশ্ন : সুপ্রিম কোর্টের যে রেজিস্ট্রার এই বিবৃতি জারি করলেন, প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টিও তিনিই কেন জানালেন না? সেটা তো তারই জানানোর কথা, আইনমন্ত্রীর জানানোর তো কথা নয়।
সরকারের কাছে মানুষের প্রশ্ন- প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অপরাধের ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাকে এ আসনে বসানো হলো কেন? মাত্র এ ক’দিনের মধ্যে তিনি তো এসব অপরাধ করতে পারেন না। অপরাধগুলো করে থাকলে নিশ্চয়ই তিনি তা অনেক দিন ধরেই করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়ার পরই কেন এ অভিযোগ তোলা হলো?
আইনমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করেছেন, প্রধান বিচারপতির ক্যান্সার হয়েছে, তিনি অসুস্থ। আবার প্রধান বিচারপতি বিদেশে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে লিখিত বিবৃতি দিয়ে জানালেন- তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তাহলে কোনটা সঠিক? আইনমন্ত্রীকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন, তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। প্রধান বিচারপতির ছুটির দরখাস্তেই সেটা লেখা আছে। কিন্তু এই দরখাস্ত তিনি যে স্বেচ্ছায় দেননি, সেটা সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রধান বিচারপতির বিবৃতিই আবার প্রমাণ করছে। অর্থাৎ এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এ সম্পর্কে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক রোববার বলেন, ‘আমার মনে হয় স্বাস্থ্যগত কারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না বা লোকে এতে আস্থা রাখতে পারছে না। এ জন্য সরকার হয়তো মনে করছে অন্য কারণগুলো সামনে নিয়ে আসা উচিত। আমরা জানি না এই অভিযোগ বানোয়াট কি না বা এর ভিত্তি আছে কি না। পুরো ব্যাপারটাই, মানে প্রধান বিচারপতির শারীরিক যে অসুস্থতা আর এখন যে মানসিক অবস্থার কথা বলা হচ্ছে, আমার কেন জানি মনে হয় কারো কাছে বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।’ তা ছাড়া ‘কোনো হর্তাকর্তা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে অভিযোগকারীর নাম-ঠিকানা থাকতে হয়। বেনামী অভিযোগ সচরাচর আমলে নেয়া হয় না। পত্রপত্রিকায় খুঁজে দেখেছি, এই ১১টি অভিযোগের অভিযোগকারীর নাম-ঠিকানা অজানা’ (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর)।
আসলে কোনো রাষ্ট্র যদি স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে না চলে, অর্থাৎ ব্যক্তির খেয়ালখুশি মতে চলে, মিথ্যার ওপর চলে এ ধরনের ঘটনাই ঘটতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে চলছে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনা ভোটের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ চলছে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনে। এর কোনো জবাবদিহিতা নেই। ফলে রাষ্ট্রের সবগুলো কাঠামো ভেঙে পড়ছে। গণতান্ত্রিক শাসন না থাকলে এমনই হয়। রাষ্ট্র অসুস্থ হয়ে পড়ে, রাজনীতি কলুষিত ও রুগ্ণ হয়।
জনরায় উপেক্ষার পরিণাম
জনগণের রায়কে উপেক্ষা করার পরিণাম খুব খারাপ হয়। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। পাঁচ বছরে জনগণ মাত্র একটি দিন তার স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পায়। এই অধিকার ও সুযোগ থেকে তাকে যদি বঞ্চিত করা হয়, তাহলে কোনো না কোনোভাবে এর প্রতিক্রিয়া হয়। সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মেনে নেয়নি। এর পরিণতিতে তারা পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। ১৯৭৩-এর নির্বাচনটি একতরফাভাবে করা হয়েছিল। দেশের জন্য এর পরিণামও ভালো হয়নি। পরবর্তী নির্বাচন না করেই পার্লামেন্টের মেয়াদ আজীবন করে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়েছিল। সেটা টেকেনি। ১৯৮৬ সালে আঁতাতের নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালে একতরফা নির্বাচন করেও জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে মিরপুর ও মাগুরায় উপনির্বাচন নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনটি করে খালেদা জিয়াকে শুধু সাংবিধানিক ধারা বজায় রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করতে হয়েছিল। এই নির্বাচন সরকার পরিচালনার ম্যান্ডেট হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।
এক-দেড় মাসের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় এসে যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জোরপূর্বক বিনা ভোটের নির্বাচন হয়েছে। এর পরিণামে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন অসুস্থ। এখন এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা কল্পনাও করা যায়নি। রাষ্ট্রকে এই অসুস্থতা থেকে স্বাভাবিক করে তুলতে, রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় নিয়ে আসতে তাই ভালো একটি নির্বাচন ছাড়া উপায় নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউই ভালো নেই। সরকার ভালো নেই, রাজনৈতিক দলগুলো ভালো নেই, দেশের মানুষ ভালো নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় একটি ভালো নির্বাচন। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই দেশকে সঙ্কটমুক্ত করতে পারে, মানুষকে অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এ ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য দেশের জনগণ উন্মুখ হয়ে আছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছেÑ যা হওয়ার তো হয়েছে, একে আর বাড়তে দেয়া উচিত নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনটি এমন হতে হবে, যাতে ভোটাররা নির্বিঘেœ তার ভোট দিতে পারেন এবং নির্বাচনী ফল যাতে হয় তার ভোটেরই প্রতিফলন। অন্তত সামনে এ ধরনের একটি ভালো নির্বাচন হলে এই ক্ষত পুষিয়ে নেয়া যাবে।
ভোটাররা সেই পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চান না
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’ হিসেবেই সর্বত্র চিহ্নিত। এটি ছিল ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী প্রহসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানের ভাষায়- ‘দেশে যে কয়টি খারাপ নির্বাচন হয়েছে, ওই নির্বাচন ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট। ওই নির্বাচনী প্রহসনে শুধু বিএনপি নয়, দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি যেসব ব্যক্তি স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তারাও নির্বাচন বর্জন করেন। সরকারের তাঁবেদার বলে পরিচিত এরশাদের জাতীয় পার্টিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে নির্বাচন বয়কট করার জন্য, কিন্তু এরশাদকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আটকে রাখা হয়। এরশাদের জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে নমিনেশন পেপার প্রত্যাহার করার পরও তাদের জন্য কয়েকটি আসন বরাদ্দ করে নির্বাচিত বলে উল্লেখ করা হয়। পরে তাদের মন্ত্রী-এমপি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
দেশ-বিদেশে চরম প্রশ্নবিদ্ধ এই প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। কোনো ভোট ছাড়াই প্রথমে ১৫৩ এবং পরে আরো একটি মোট ১৫৪টি আসনে অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে চার কোটি ৫৩ লাখ ভোটারকে বঞ্চিত করে তাদের বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। বাকি ১৪৬টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবাহী জোটভুক্ত দল ছাড়া অন্য কোনো দল এই প্রহসনে অংশ নেয়নি। এভাবে আসন ভাগাভাগি করে বিনা ভোটের এ নির্বাচনের মাধ্যমে এক অদ্ভুত সংসদ গঠন করা হয়। যদিও সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- ‘প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন মহিলা সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হবে।’ অর্ধেকের বেশি আসনে যেখানে প্রত্যক্ষ কোনো নির্বাচনই হয়নি, সেখানে সংসদও গঠিত হয়নি বলে বিশেষজ্ঞদের মত। তবুও জোরপূর্বক যে সংসদ গঠন করা হয় সেখানে এরশাদের জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের সদস্যরা একসাথে বিরোধী দলেও আছে আবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও আছে। এইচ এম এরশাদ আবার মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতও।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিনটিতে কেন্দ্রগুলোতে কুকুর-বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য দৈনিক পত্রিকায় ছবি হিসেবে ছাপা হয়েছে। প্রচণ্ড সহিংসতাপূর্ণ এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে ১২৩ জন নিহত হয়েছে। নির্বাচনের দিনই মারা যায় ১৯ জন। নির্বাচনের আগের দিন ১১১টি ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৫৯টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এমন সহিংস জাতীয় নির্বাচনের নজির অতীতে নেই। ভোটাররা এমন বিনা ভোটের প্রহসনের নির্বাচন আর দেখতে চান না।
ইসির সংলাপ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয়
আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শেষ হওয়ার পথে। আসছে ২৪ অক্টোবর নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সাথে সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রায় তিন মাস ধরে চলমান এই সংলাপের ইতি ঘটবে।
নির্বাচন কমিশন গত ৩১ জুলাই দেশের সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে তাদের সংলাপ শুরু করে। এতে ১৬ ও ১৭ আগস্ট দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধি, ২৪ আগস্ট থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত রাজনৈতিক দল এবং ২২ অক্টোবর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা এবং ২৩ অক্টোবর নারীনেত্রীদের সাথে ধারাবাহিক সংলাপের কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সংলাপে প্রতিটি দলই তাদের দফাওয়ারি সুপারিশমালা কমিশনে পেশ করেছে। ন্যূনতম ৮ দফা থেকে সর্বোচ্চ ২৬ দফা পর্যন্ত নির্বাচনী সুপারিশমালা দলগুলো দিয়েছে। এসব দফা একত্রে যোগ করলে নির্বাচন কমিশনে জমাকৃত মোট দফার সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।
তবে এত দফা ও সংলাপের পরও মানুষের মধ্যে এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের আগ্রহ তথা তারা জানতে চায়, দেশে আদৌ নির্বাচন হবে কি না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে যে প্রচণ্ড একটা শঙ্কা রয়ে গেছে, সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে। আর নির্বাচন যদি হয়ই, তাহলে মানুষ জানতে চায় সেটা কী ধরনের নির্বাচন হবে? সেটা কি ৫ জানুয়ারির মতো গদি দখলের সর্বনাশা নির্বাচন হবে? নাকি একটি ভালো নির্বাচন অর্থাৎ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে?
এ প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত কারো কাছে নেই। ফলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাও কাটছে না। দেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান ১৬ অক্টোবর নয়া দিগন্তে যে সাক্ষাৎকার দেন, তাতেও সেটা ফুটে উঠেছে। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘নির্বাচন অনিশ্চিত মনে হচ্ছে।’ ইসি সংলাপ করলেও তার কাছে মনে হচ্ছে, এরা নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে না। দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- ‘আওয়ামী লীগ সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবে না।’ এ ক্ষেত্রে তার যুক্তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যেমন শেখ হাসিনাকে ছাড়া নির্বাচন করবে না, তেমনি বিএনপি শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে তিনি একটি একতরফা নির্বাচনের সম্ভাবনাই দেখছেন। যার মোদ্দাকথা হচ্ছে, একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান হচ্ছে না।
আসলে গত নির্বাচনটি একতরফা হওয়ায় রাষ্ট্রের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের ভাষায়- ‘রাষ্ট্রের সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে।’ এ অবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচন রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই হওয়া উচিত। এবারও যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয় তাহলে দেশে বড় ধরনের সঙ্ঘাত ও রক্তপাত যে হবে সে আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন ওই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের শেষপর্যায়ে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইসির সাথে সংলাপ করে। বিএনপির সাথে সংলাপ হয় ১৫ অক্টোবর এবং আওয়ামী লীগের সাথে ১৮ অক্টোবর। সংলাপে দুই দল নিজ নিজ অবস্থানই তুলে ধরে। যেমন বিএনপি বলেছে, নির্বাচন হতে হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে, সব দলের জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে, সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের সাত দিন আগে মাঠে নামাতে হবে, ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় সীমানায় ফিরে যেতে হবে এবং ই-ভোটিং করা যাবে না। ২০ দফার মধ্যে এগুলোই বিএনপির মূল দাবি। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার অধীনে।
সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হবে, সিভিল প্রশাসন প্রয়োজন মনে করলে কেবল সেনাবাহিনীকে ডাকতে পারে সংশ্লিষ্ট এলাকার জন্য। ইভিএম চালু হতে পারে এবং নির্বাচনী সীমানা বহাল থাকবে।
আওয়ামী লীগের এমন বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাচ্ছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে যদি তারা হেরে যায়। এ জন্যই বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে তারা প্রচণ্ড বিরোধিতা করছে। আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন- ‘সেনাবাহিনীকে দিয়ে যদি হাসপাতাল ও বীমা প্রতিষ্ঠান চালানো যায়, রাস্তার নির্মাণকাজ করানো যায়, ত্রাণ দেয়ানো যায়, এমনকি ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের কাজ করানো যায়, তাহলে সেনাবাহিনী দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের কাজ করানো যাবে না কেন’ (প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০১৭)।
তবে আওয়ামী লীগের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ভালো একটি নির্বাচনের পথে বাধা হিসেবে দেখলেও নির্বাচন কমিশনের চলমান দীর্ঘ সংলাপকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এই সংলাপের ফলে অন্তত একটি ভালো নির্বাচন হোক সে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশে যে ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কট রয়েছে তার একটি চিত্র উঠে এসেছে। রাষ্ট্র যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং এই অসুস্থ রাষ্ট্রকে সুস্থ করে তুলতে হলে একটি ভালো নির্বাচন যে করতে হবে, তার যথার্থতাও প্রমাণিত হয়েছে। সংলাপে সুশীলসমাজের পক্ষ থেকে জোরালোভাবেই বলা হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। নির্বাচন কমিশনকে এ জন্য বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। ভালো নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ হতে হবে, প্রশাসন নিরপেক্ষ হতে হবে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করলে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা দুরূহ হবে, তাই নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচনটি হতে হবে ভয়মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞরাই ইসির সংলাপে এই পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছেন।
ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশায় এই পরামর্শগুলো নির্বাচন কমিশন সুপারিশ আকারে তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরলে বোঝা যাবে ইসি সৎ চিন্তা থেকেই সংলাপ অনুষ্ঠান করেছে। ইতঃপূর্বে দেশবাসী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়েও সংলাপ প্রত্যক্ষ করেছে। এ নিয়ে দীর্ঘ সংলাপের পর দেখা যায় শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেটাই হয়েছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন