গণতন্ত্রচর্চা সমার্থক নয়যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে নির্বাচন হয়ে গেল গত বৃহস্পতিবার। এই নির্বাচন থেকে আমাদের কী নেওয়ার আছে, এ নিবন্ধে সেই আলোচনা করতে চাই। তবে আলোচনাটি করতে চাই একটি অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। সেটি হলো ‘বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ক্ষমতাসীন দলকে রেখেই নির্বাচনকালীন সরকার হয় এবং বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার যে দাবি করে আসছে, তার ভিত্তি নেই।’
আমরা আরও ধরে নিচ্ছি, আওয়ামী লীগ স্বীকার করে যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নিয়মিত সরকার এবং তফসিল ঘোষণার পরের সরকারের বৈশিষ্ট্য এক হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকার কার্যত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হয়। টোরি প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেকে লেবার নেতা জেরেমি করবিন পদত্যাগ করতে বলেছেন। আসলে থেরেসা মে পদত্যাগী বা তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নিজেকে গণ্য করে চলেছেন, সেই ১৮ এপ্রিল থেকে, যেদিন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে কাল তিনি সংসদে আগাম নির্বাচনের প্রস্তাবের ওপর ভোট আশা করেন। ১৯ এপ্রিল প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর ব্রিটেনের কেবিনেট ম্যানুয়ালে বর্ণিত কেয়ারটেকার কনভেনশন এবং ২০১১ সাল থেকে ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট আইনের বিধানাবলি আপনাআপনি তার ওপর জারি হয়ে গেছে। ব্রিটেনে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই বলে নির্বাচনী প্রচারণায় বিরোধী দল বা মিডিয়াকে সেটা খুব তারস্বরে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার পড়েনি। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ এবং ঘন ঘন নির্বাচন করার ঘটনাকে একটা প্রলয়ংকরী বিষয় হিসেবে দেখার উপায় নেই।
ব্রিটেনের কাছ থেকে আমরা কি এটা নেব না যে যেকোনো মূল্যে মেয়াদ পূরণ করা কোনো সংসদীয় কৃতিত্ব নয়। থেরেসা মে হয়তো হিসাবে ভুল করেছেন, কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইইউর সঙ্গে দর-কষাকষির সামর্থ্য বাড়াতেই সম্ভবত তিনি আগাম নির্বাচনে গেছেন। অর্থাৎ শক্তির জ্বালানিটা তিনি ক্ষমতার মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি নিতে চেয়েছিলেন। তিনি বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার জন্য এটি করেছেন, এমনটি আমরা না–ও ভাবতে পারি। আগাম নির্বাচন দিতে প্রধান বিরোধী দল তেমন কোনো চাপ সৃষ্টি করেনি। বরং আমরা বলব, শত শত বছরের ঋদ্ধ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট অ্যাক্ট, ২০১১ (রাজনৈতিক সমঝোতা হয় ২০১০ সালে) যে দর্শন থেকে ব্রিটেন করেছিল, তার মূল চেতনার সঙ্গে ঘন ঘন নির্বাচন খুব খাপ খাওয়ার বলে গণ্য করা চলে না।
আমরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ এই যুক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা দিতে চায় এবং সেটা যেকোনো জাতিরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে। কিন্তু তা একেবারেই শর্তমুক্ত নয়। নিয়মিত সরকার ও নির্বাচনকালীন সরকারের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য বজায় থাকবে। এটা দুঃখের বিষয় যে আওয়ামী লীগ যতটা তীব্রতা ও ঝাঁজ নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে নির্দলীয় সরকারের ধারণা প্রত্যাখ্যান করে, তার থেকে দশ ভাগ জোর দিয়েও বলে না যে তারা নির্বাচনকালীন সরকারকে একটি সত্যিকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপ দিতে সচেষ্ট হবে।
এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে ১৯৭২ সালে আমরা ব্রিটিশদের অনুসৃত ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধাঁচ গ্রহণ করেছিলাম। সুতরাং সেই দেশটি তার সংসদীয় নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, সেদিকে আমাদের নজর রাখার একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থা তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মৌলিকভাবে বদলাবে, অথচ আমরা চোখ বন্ধ রাখব, তা হয় না। অবশ্য এই প্রশ্নে যখন শনিবার রাতে টেলিফোনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে কথা বলি, তখন তিনি বলেন, ‘নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে আস্থার সংকট সর্বব্যাপী, যে দেশে রাষ্ট্র, সরকার, সংসদ ও দল লেপ্টে আছে এবং এদের পৃথক্করণ ঘটেনি—এসব বাস্তবতার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়ে উঠেছিল। এবং সেই পরিস্থিতি তো এখনো বহাল। ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে যে ভোট হলো সেটা নির্বাচন কমিশন নয়, প্রশাসন করেছে। অথচ ১৯ এপ্রিলের আগে বা পরে মের প্রশাসনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের কোনো চেষ্টা করেছেন বলে তাঁর বিরোধীরা অভিযোগ তোলেনি।’ তবে এই অবস্থা বাংলাদেশে অনুপস্থিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত জোশের সঙ্গে বলা হয়, ব্রিটেন, ভারত, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ার মতো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, তাই বাংলাদেশেও হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যখন খুশি তখন সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন—এই ধারণা ব্রিটেন থেকেই আমদানি করা। কিন্তু সেই ব্রিটেন নিজেকে এ বিষয়ে লিখিত আইন করে বদলেছে। কিন্তু তাই বলে তারা কিন্তু সংসদ বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনটি করেনি। ভারত তার ৭০ বছরের ইতিহাসে বিচ্ছিন্নভাবে হাতে গোনা কয়েকটি লোকসভা নির্বাচন লোকসভা বহাল রেখে করেছে, সেই উদাহরণ হাজির করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যরা কী করে তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রী হয়ে ওঠেন, তা তাঁরা মুখে নিতে নারাজ। ব্রিটেনকে তত্ত্বাবধায়ক কনভেনশন লিখে নিতে হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের তা লাগে না। সংসদ রেখে সংসদ নির্বাচন করা কিন্তু ব্রিটিশ ধারা নয়।
সংসদের মেয়াদ পুরা করা কোনো কৃতিত্ব নয়। গণতন্ত্র বা সরকারের স্থিতি যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড নয়। ব্রিটেনের হাতে গোনা সংসদ মেয়াদ পুরা করেছে। সেখানে বরং ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যাতে তাঁর খুশিমতো হুট করে নির্বাচন না দিতে পারেন, তাই তারা আইন পাস করেছে। ২০১০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের ইতিহাসে আমিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যে স্বেচ্ছায় সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা বিসর্জন দিল।’ যে নির্বাচনটি ৮ জুন ২০১৭ হলো, সেটি ২০১১ সালের ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ৭ মে ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল।
এবারের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের দায় কি এককভাবে মেকে নিতে হবে? এর উত্তর—না। কারণ, তাত্ত্বিকভাবে নতুন আইন অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কখন হবে, সেটা সংসদের সিদ্ধান্তের বিষয়, আইনে প্রধানমন্ত্রীকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ব্রিটেনে সংসদে ভোটাভুটিতে আগাম নির্বাচনের পক্ষে ৫২২ ভোট এবং বিপক্ষে মাত্র ১৩ ভোট পড়েছিল। ন্যূনতম ভোট দরকার ছিল ৪৩৪।
বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা রোডম্যাপ-সংক্রান্ত বক্তব্যে বলেছেন, মেয়াদ অবসানের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু মেয়াদ শেষের ৯০ দিন আগে নাকি ৯০ দিন পরে নির্বাচন হবে, তা নির্ধারণে বাংলাদেশ সংবিধান নিরঙ্কুশভাবে প্রধানমন্ত্রীকেই দায়িত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই ২০১৪ সালে আমরা ৬০০ নির্বাচিত সাংসদের আইনি অস্তিত্ব একত্রে অনুভব করেছিলাম, নির্বাচনের পরেও নবম সংসদ না ভেঙে দশম সংসদের সদস্যরা শপথ নিয়েছিলেন। ব্রিটেন এটা কল্পনা করতেও অক্ষম।
নতুন আইনটি যে ফিক্সড সংসদের কথা ভেবেছে, সেটা ব্রিটিশ জাতি কবে বাস্তবে দেখবে, সেটা কারও জানা নেই। বর্তমান ঝুলন্ত সংসদ প্রধানমন্ত্রী স্থির করতে না পারলে আগস্টেই ব্রিটেন ফের ভোটে যাবে। নতুন আইন পাসের পর সাধারণ নির্বাচনগুলো ২০১৫ সালের মে মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার থেকে ২০২০ ও ২০২৫ এভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনে দুটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলেই যেকোনো মুহূর্তে নির্বাচনে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এক. প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা ভোটে পরাস্ত হলে, দুই. সংসদের মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে বা কোনো ডিভিশন ছাড়াই আগাম নির্বাচনের পক্ষে প্রস্তাব পাস হলে। ফ্লোর ক্রসিং-সংক্রান্ত ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে কোনো অনাস্থা কিংবা আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব পাস হওয়ার বাস্তবতা আমাদের দেশে নেই। সংবিধানই সে পথ রুদ্ধ রেখেছে।
বলেছিলাম, ব্রিটেনের ৮ জুনের নির্বাচনী যজ্ঞ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি। এক. এটা বলা অভ্যাস করা যে জনগণ পাঁচ বছরের জন্য সরকার নির্বাচিত করে না। দুই. মেয়াদ পুরা করা আর গণতন্ত্রচর্চা সমার্থক নয়। তিন. ফিক্সড টার্ম অ্যাক্টকে যতটা সম্ভব অনুসরণ করে আমরা একটি আইন করতে পারি। ওই আইন নির্দিষ্ট করেছে, ‘নির্বাচনের তারিখের ২৫ কার্যদিবস (প্রথমে করেছিল ১৭ দিন) আগে সংসদ বিলুপ্ত হবে। আগের নির্বাচন থেকে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর (জেরেমি করবিন চার বছরের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তা পাস হয়নি) অতিবাহিত হওয়ার পরের মে মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার হবে ভোটের দিন।’ এ রকম একটি বিধান আমাদের থাকা দরকার। প্রধানমন্ত্রী জরুরি কারণ দেখিয়ে নির্ধারিত তারিখ থেকে অনধিক দুই মাস ভোটের দিনটা পেছাতে পারেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব উভয় কক্ষে আলাদাভাবে পাস হতে হবে। চার. এটা স্বীকার করা যে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই শ্রেষ্ঠ নয়। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ কলিন ট্যালবটের মতে, নতুন আইন সংখ্যালঘু সরকারের হাত শক্তিশালী করেছে। পাচ. ভোটের দিন পর্যন্ত মন্ত্রীদের আচরণ কী হবে, সেটা বাতলে দিতে মন্ত্রিসভা বিভাগ ব্রিটেনের মতো গাইডলাইন জারি করবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রকল্প, সিদ্ধান্ত বা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি দিতে প্রকারান্তরে বিরত থাকতে বলা হয়। কেবিনেট ম্যানুয়েলের ২.২৯ দফায় লেখা, ‘বিরোধপূর্ণ কোনো ক্রয়, প্রশাসনের উচ্চপদে কারও নিয়োগ বা অনুমোদন বিলম্বিত করা, তবে জাতীয় স্বার্থ বা জনগণের গাঁটের টাকা গচ্চা না হয় সেটাও দেখতে হবে। অপেক্ষা করা না গেলে অস্থায়ী সিদ্ধান্ত কিংবা বিরোধী দলের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক পরামর্শ করে নিতে হবে।’
কোনো কারণে মে বা অন্য কারও অধীনে দ্রুত আরেকটি নির্বাচন হলে তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই কাজ করতে হবে। আপাতত এটুকুই হোক ব্রিটিশ নির্বাচনী শিক্ষা। সরকারি দল এ রকম একটি নির্বাচনী সরকারের আচরণবিধি প্রকাশ করলে তা তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন