এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র কার অধীনে থাকবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। সরকার ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগে যাবে। নির্বাচন কমিশন প্রথমে বলেছিল, এটি করা ঠিক হবে না। এখন সুর নরম করে বলছে কার কাছে যাবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলা যাবে না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা গতকাল বুধবার নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই) ভবনে মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, এটি চেয়ার-টেবিল নয় যে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম। এটা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে কে এম নূরুল হুদা বলেন, এনআইডি সেবা হস্তান্তরে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও আলোচনার সুযোগ থাকছে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠান তো এটা। কীভাবে নেবে-না নেবে, এ বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা হবে। নিশ্চয়ই সচিব পর্যায়ে কথাবার্তা হবে। সুবিধা-অসুবিধা জানানো হবে। এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে গেলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অসুবিধা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুরোনো কারাগার কনভেনশন হলে এক অনুষ্ঠানে বলেন, এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে না। বরং জনগণ এনআইডি সেবা যথাযথভাবে পাবেন। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শসহ অন্যদের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁরা ইতিবাচক মত দিয়েছেন। এনঅইডি নিয়ে এখন যা বলা হচ্ছে তা অবান্তর।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত সব সেবা দেওয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশনা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়, এনআইডি কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগকে এই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ার জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করার প্রয়োজন পড়বে। কেননা, ওই আইনে কাজটি করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছিল।
এ কথা ঠিক যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এনআইডি তৈরি সরকারই করে থাকে। বাংলাদেশে কেন এই ব্যতিক্রম হলো?
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। যেহেতু এটি ভোটের সঙ্গে সম্পর্কিত সেহেতু নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপরই দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু সে সময়ে সেটি করার মতো ইসিতে লোকবল ছিল না। এর আগে ভোটার তালিকা করা হতো নির্বাচনের আগে স্কুলশিক্ষক কিংবা স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে। এই প্রথম ভোটার তালিকার জন্য একটি বিভাগ খোলা হলো। প্রয়োজনীয় লোকবল নেওয়া হলো। সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইসি কাজটি করল।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমরা ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা পেলাম এবং সেই তালিকার ভিত্তিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও হলো। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন পাস করে এবং এর দায়িত্ব ইসির হাতেই রাখা হয়।
প্রশ্ন উঠেছে, এখন সেই জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কেন হস্তান্তর করা হলো? নির্বাচন কমিশন ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এই প্রশ্নটি করা হচ্ছে। অনেকের আশঙ্কা সরকারের কাছে এই দায়িত্ব গেলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা হবে (এখন কি হচ্ছে না?) তাদের এই যুক্তি স্বীকার করছি। বাংলাদেশে সবকিছুই দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকে স্বেচ্ছায়ও অপরের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পছন্দ করে। বাংলাদেশে সোজা মেরুদণ্ডের লোকের চেয়ে ন্যুব্জ মেরুদণ্ডধারী লোকের সংখ্যাই বেশি।
নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ভোটার তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার একমাত্র উদ্দশ্যে নির্বাচন করা। আর সেই নির্বাচন মানে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন তো স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি। এর অর্থ হলো নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা যে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তা পালন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
নাগরিক সমাজের এই যুক্তি ও আপত্তির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেও আরেকটি প্রশ্ন রাখতে চাই। ইসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলেই তারা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির দায়িত্ব ইসির কাছে রাখতে চায়। ইসি সরকারের অধীন নয়। এটি হয়তো এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের জন্য ঠিক ছিল। এরপর এই কমিশনে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরা অধীন হতেই পছন্দ করেন। রকিব কমিশন এ ক্ষেত্রে কিছুটা রাখঢাক রাখলেও বর্তমান কমিশন পুরোটাই খোলা। সব বিষয়ে সব ক্ষেত্রে সরকারকে জিন্দাবাদ দিয়েছেন। ইসির পদাধিকারীদের কথায় মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও বিব্রত হয়েছেন। এখন অবশ্য কেউ কাউকে বিব্রত করেন না। দুজনে দুজনার।
দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব কী? নির্বাচন করা। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী ক. রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন, খ. সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন গ. সংসদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন এবং ঘ. রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।
পরবর্তী সময় আইন করে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব কমিশনের হাতে ন্যস্ত করা হয়। যদিও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন কখন হবে সেই এখতিয়ার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছেই রেখে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ বছর আটকে রেখেছিল, তা এই আইন অপব্যবহার করেই।
নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ভোটার তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার একমাত্র উদ্দশ্যে নির্বাচন করা। আর সেই নির্বাচন মানে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন তো স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি। এর অর্থ হলো নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীরা যে শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তা পালন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।
তাই এনআইডি নির্বাচন কমিশনের হাতে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাবে, এই বিতর্ক হলো ‘মাথা নাই কান লইয়া’ টানাটানির মতো। আগে তো কমিশনকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে। তারপর ঠিক করা যাবে তার হাতে কী থাকবে, কী থাকবে না।
পাদটীকা: জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা মন খারাপ করেছেন। কিন্তু তার আগে সিইসির আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত তাঁরা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুবিভাগের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা কি গত সাড়ে তিন বছরে একবারও ভোগ করেছেন? সিইসি এবং তাঁর তিন সহযোগী কমিশনার সরকারের সব সিদ্ধান্তে ‘হ্যাঁ’ বলে এসেছেন (কমিশনার মাহবুব তালুকদার মৃদুস্বরে হলেও প্রতিবাদ করেছেন)। এখন ‘না’ বললে সরকার শুনবে কেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন