ইতিহাসের ফুটনোট ও বিএনপির তারেক সমস্যা
23 August 2020, Sunday
ইতিহাসের ফুটনোট ও বিএনপির তারেক সমস্যা
বিএনপির নেতাদের উচিত আনুষ্ঠানিকভাবে ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ জানানো। যে দলের নেতারা কথায় কথায় জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানি এজেন্ট, ষড়যন্ত্রকারী ইত্যাদি বলে গালাগাল করেন, সেই দলের সাধারণ সম্পাদক তাঁকে ইতিহাসে জায়গা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠক স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারে না। জিয়া (জিয়াউর রহমান) ইতিহাসের ফুটনোট মাত্র, ফুটনোট কখনো ইতিহাসের নায়ক হতে পারে না।
জিয়াউর রহমান নিজেকে ইতিহাসের নায়ক দাবি করেছেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি তিনি বেঁচে থাকতে স্বাধীনতার ঘোষক, ঘোষণাকারী, ঘোষণা পাঠকারী কূটতর্কও শোনা যায়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যোক্তা বেলাল মোহাম্মাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি থাকাকালে জিয়া একবার তাঁকে টেলিফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, সেদিন বেতারে প্রচারিত ঘোষণাটি যেই কলমে লেখা হয়েছিল, সেই কলমটি তাঁর কাছে আছে কি না।
ইতিহাসের ফুটনোট হোক আর যেখানেই হোক মুক্তিযুদ্ধের অন্য রকম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানকে স্থান দিতেই হবে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারই তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে কোনো অন্যায় করে থাকলে সেটি সেই প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। তার সঙ্গে একাত্তরকে টেনে আনা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব দ্য ব্লাড বইকেই সাক্ষ্য মানেন। কিন্তু ওই বইয়ে আরও যেসব তথ্য-উপাত্ত ও মন্তব্য আছে, তা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে মোটেই স্বস্তিকর হবে না।
বইটি বের হয়েছিল এরশাদের সামরিক শাসনামলে। সে সময়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল যে বঙ্গবন্ধু ও জিয়া উভয়ের চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে বইটি লেখানো হয়েছিল। এরশাদ লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে বইটি বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছানোরও ব্যবস্থা করেছিলেন। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এর পক্ষে সত্যি সত্যি প্রমাণ থাকলে আওয়ামী লীগ নেতারা সেটি দেশবাসীর কাছে হাজির করছেন না কেন? জিয়া তবু ইতিহাসের ফুটনোটে জায়গা পেয়েছেন, প্রতিদিন তাঁকে যাঁরা গালাগাল করছেন, তঁাদের জন্য ফুটনোটটিও থাকবে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব দ্য ব্লাড বইকেই সাক্ষ্য মানেন।কিন্তু ওই বইয়ে আরও যেসব তথ্য-উপাত্ত ও মন্তব্য আছে, তা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে মোটেই স্বস্তিকর হবে না।
বিজ্ঞাপন
জিয়াউর রহমানের বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিএনপি এক নয়। জিয়া বিএনপি করেছিলেন ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। আর খালেদা বিএনপিকে সংগঠিত করেছিলেন বিরোধী দলে থেকে। সে সময় দলের অনেক বড় নেতা এরশাদের সঙ্গে ভিড়েছিলেন। আবার খালেদা ও তারেক রহমানের বিএনপিও এক নয়। ১৯৮৪ থেকে ২০০১ সাল—এই ১৭ বছর খালেদা জিয়া এককভাবে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮২ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপিকে তিনি দু–দুবার ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তারেক কীভাবে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তা খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলের সঙ্গে দ্বিতীয় শাসনামল তুলনা করলেই স্পষ্ট হবে। তারেক হাওয়া ভবন নামে সরকারের সমান্তরালে আরেকটি ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন। এক–এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য তারেকের বাড়াবাড়ি দায়ী বলে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীও মনে করেন।
খালেদার শারীরিক অবস্থা ও মাথার ওপর কারাদণ্ডের খড়্গ থাকায় বিএনপির মহলে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো তিনি ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবেন কি না। তাঁর অনুপস্থিতিতে কে দলের হাল ধরবেন? বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি দল পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যকার বিরোধও স্পষ্ট। স্থায়ী কমিটি নীতি নির্ধারণের চেয়ে স্কাইপে আসা হুকুম তামিল করতেই ব্যস্ত। সহযোগী একটি দৈনিক শিরোনাম করেছে, ‘খালেদা জিয়া কি নেতৃত্ব ছাড়ছেন তারেকের হাতে?’ এ ব্যাপারে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। দলের শুভানুধ্যায়ী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও মতভেদ আছে। এক পক্ষ মনে করে, খালেদা জিয়া যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন দলের নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকতে হবে। কোনোভাবে তারেকের ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। স্কাইপে দলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করা যায়, দল পরিচালনা করা যায় না। এখনো বিএনপি চলছে জিয়া ও খালেদার ভাবমূর্তি সম্বল করে। আবার কারও মতে, খালেদার পর যেহেতু তারেকই দলের দায়িত্ব নেবেন, সেহেতু এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। প্রশ্ন হলো, দলের সব নেতা-কর্মী কি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন? তারেকের কারণে অনেক নেতা দল ছেড়েছেন কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
অনেকে বলেন, বিএনপিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিকল্প নেই। তাহলে কি খালেদা-তারেকের পর বিএনপির অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না? প্রতিটি রাজনৈতিক দলে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি খোলা রাখা উচিত। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেটি রাখছে না বলেই নেতৃত্বের সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। উত্তরাধিকারের মধ্যেই নেতৃত্ব খুঁজতে হচ্ছে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
উৎসঃ প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন