উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদের (বাঁয়ে) হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন মো. নজিমুদ্দিন। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার বাতিয়াগাঁও এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধীগাঁও গ্রামের নাজিমুদ্দিন তথাকথিত ভদ্দরলোক নন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি যে পেশা বেছে নিয়েছেন, সমাজ তা ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু নাজিমুদ্দিন ছিলেন নিরুপায়। দিনমজুরি করতে গিয়ে ৮–৯ বছর আগে তাঁর পা ভেঙে যায়। সেই থেকে ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু করোনা সংকটকালে তিনি যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকেই লজ্জা দিয়েছে। শুরু থেকে যেভাবে ত্রাণের চাল-ডাল-তেল চুরির হিড়িক পড়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল সমাজটা একেবারে রসাতলে গেছে। কিন্তু একজন নিজামুদ্দিন প্রমাণ করলেন, এখনো সমাজে ভালো মানুষ আছে। আর মানুষকে সাহায্য করতে ধনী হতে হয় না, ইচ্ছা থাকলে গরিব ও নিঃসম্বল মানুষও কিছু করতে পারে। তাঁর বয়স এখন ৮০ বছর।
করোনা সংকটের আগে রাষ্ট্র, সরকার ও জনপ্রতিনিধি—কেউ তাঁর খোঁজ নেয়নি। নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রের খোঁজ নিয়েছেন। তাঁর সঞ্চয়ে যে সামান্য টাকা ছিল, তা ত্রাণের কাজে সহায়তার জন্য রাষ্ট্রকে দান করেছেন। এত দিন ভদ্র সমাজ 'ভিক্ষুক' বলে যাঁকে অবহেলা করেছে, তিনিই হয়ে উঠেছেন বিপদের বন্ধু—পথপ্রদর্শক। জীর্ণ দেহের মানুষটিই আমাদের ঘুমন্ত ও ঘুণে ধরা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চাইলেন কি? জানিয়ে দিলেন, মানুষ বিপদে পড়লে, দেশে দুর্যোগ এলে কী করতে হয়। তাঁকে সহস্র সালাম। আমাদের সমাজে বহু বিত্তবান আছেন, মন্ত্রী–এমপি–মেয়র–চেয়ারম্যান আছেন, কিন্তু নাজিমুদ্দিনের মতো কেউ তাঁর সঞ্চয়ের সবটা নিয়ে এগিয়ে আসেননি।
ভাবতে অবাক লাগে, যেই পরিবারে চারজন দিনমজুর, সেই পরিবারকে এত দিন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। তাহলে এই যে ভিজিএফ–ভিজিডি কার্ড, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, দুস্থ ও বয়স্ক ভাতা—সেসব কাদের জন্য? দলের নেতা–কর্মী, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের আত্মীয়স্বজনের জন্য? সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি কি চাল চুরির জন্য? টিসিবির তেল–ডাল–চিনি কি কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য?
আমাদের রাষ্ট্র সব সময় তেলা মাথায় তেল দিতে পছন্দ করে। যুগ যুগ ধরে সেটাই করে আসছে। এ কারণেই নাজিমুদ্দিনদের খবর কেউ রাখত না। অথচ তিনি রাষ্ট্রের খবর রাখতেন। মানুষের খবর রাখতেন। নাজিমুদ্দিন তাঁর ভাঙা ঘর মেরামতের জন্য দুই বছর ধরে ১০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সহায়–সম্বলহীন এক বৃদ্ধের জন্য এটি বড় সঞ্চয়। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন করোনা সংকটের কারণে অনেক মানুষ না খেয়ে আছে, তখন তাঁর জমানো ১০ হাজার টাকার পুরোটাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হাতে তুলে দিলেন।
এর আগে ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে দুস্থ ও অভাবি মানুষের তালিকা তৈরি করছিলেন। তাঁরা নিজামুদ্দিনকেও তালিকাভুক্ত করতে তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র বা আইডি দিতে বলেছিলেন। তিনি রাজি হননি। বললেন, ভিক্ষা করে আমার তো দিন চলে যাচ্ছে, আমার চেয়েও যাঁরা বেশি কষ্টে আছেন, তাঁদের সাহায্য দিন। যে দেশে সরকারি পদক ও সাহায্য পাওয়ার জন্য ভদ্দরলোকেরা তদবিরবাজিতে ব্যস্ত থাকেন, সে দেশে নাজিমুদ্দিন ব্যতিক্রমী উদাহরণ বটে।
ইউএনওর কাছে নাজিমুদ্দিনের টাকা দেওয়ার সেই ছবি প্রথম আলোসহ সব পত্রিকায় ছাপা হলে, টেলিভিশনে দেখানো হলে চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। পত্রিকার খবর পড়ে প্রধানমন্ত্রী নিজামুদ্দিনের ঘর নির্মাণের জন্য জমি ও টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
যে দেশে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা গরিব মানুষের চাল চুরি করেন, ১০টি মাস্ক ও ১০ ব্যাগ খাবার বিতরণের জন্য ১৫ জন দাতা ক্যামেরার সামনে দাঁত কেলিয়ে হাসেন, সে দেশে নাজিমুদ্দিনের নাম সত্যিকার মানবদরদি হিসেবে লেখা থাকবে। তিনি সরকারের ত্রাণ তহবিলে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার বিনিময়ে কিছু চাননি। তাঁর এ দান ছিল শর্তহীন। জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে চুক্তি থাকে, সেটি রাষ্ট্র পালন না করলেও, একজন নাগরিক হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। সমাজে এ রকম মানুষ আরও আছে। ভদ্দরলোকেরা যাঁদের খোঁজ রাখেন না।
রাষ্ট্র দুই ধরনের হয়। একটি জল, স্থল ও অন্তরিক্ষের সব সম্পদ কতিপয় লোককে হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আরেক ধরনের রাষ্ট্র হলো সব মানুষের মৌলিক অধিকার, তথা খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। কতিপয় তস্কর যাতে রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ গ্রাস করতে না পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে।
রাষ্ট্র কল্যাণকামী হলে ৮০ বছর বয়সে কাউকে ভিক্ষা করতে হয় না। রাষ্ট্র তাঁর থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্র কল্যাণকামী হলে জনপ্রতিনিধি হয়ে কেউ গরিবের হক মেরে দিতে পারেন না। আওয়ামী লীগের নেতারা সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ 'সমাজতন্ত্র' পুনঃস্থাপন করার কৃতিত্ব দাবি করেন। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে তাঁদের অর্থনৈতিক কর্মসূচির ফারাকটা কোথায়, জিজ্ঞেস করলে তা বলতে পারেন না। সমাজতন্ত্র অনেক দূরের বিষয়। সরকার অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা দিক যে ৮০ বছর বয়সে দেশের কোনো নাগরিককে ভিক্ষা করতে হবে না। নাজিমুদ্দিন ভিক্ষার টাকা রাষ্ট্রকে দান করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্র তার লজ্জা ঢাকতে পারেনি।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন