বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
সিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছিলেন, ভুল ও ধ্বংসাত্মক নীতির কারণে বিএনপির জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর এই কথাগুলো তাঁদের কণ্ঠে হরহামেশাই উচ্চারিত হতো। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতারা ভোটের নতুন তত্ত্ব হাজির করেছেন। বিএনপির নেতিবাচক প্রচারণার কারণেই নাকি অধিকাংশ ভোটার নির্বাচনের দিন ঢাকা শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। রাস্তায় নামতে না পারা বিএনপির এত ক্ষমতা!
বিএনপির যে জনপ্রিয়তা, তার কৃতিত্ব বিএনপির নেতাদের নয়। আওয়ামী লীগের বিরামহীন প্রচারের কারণেই এটি হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা প্রতিদিন সচিবালয় কিংবা মাঠে-ময়দানে জনপ্রিয়তার যেসব অভিনব তত্ত্ব হাজির করছেন, তাতে কার জনপ্রিয়তা কত কমেছে, কার বেড়েছে, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। নির্বাচন জনপ্রিয়তার একটি মাপকাঠি হতে পারত। সব দেশে সব কালে সেটি হয়ে থাকে। কিন্তু বিগত জাতীয় নির্বাচন এবং সদ্য অনুষ্ঠিত ঢাকার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটদানের হারে এত ফারাক যে উপসংহার টানা কঠিন। যেখানে জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৮০ শতাংশ, সেখানে সিটি নির্বাচনে মাত্র ২৭ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ নেতাদের যুক্তি মেনে নিলে মাত্র ১৩ মাসের ব্যবধানে বিএনপি এতটাই প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যে তাদের কথায় ভোটাররা ঢাকা শহরে থাকেন, ঢাকা শহর ছাড়েন। বিএনপির জনপ্রিয়তায় তলানিতে আসার পরও দলটির দুই মেয়র প্রার্থী প্রায় পাঁচ লাখ ভোট পেয়েছেন। আর অতি জনপ্রিয় আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়র প্রার্থীদ্বয় পেয়েছেন সাড়ে আট লাখের কম। দুটি সিটির ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ।
সিটি নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপির নেতারা যে কিছুটা চাঙা হয়েছেন, তা নির্বাচন-পরবর্তী তাঁদের ভাষাভঙ্গি ও কর্মসূচিতে প্রতিফলিত। ২০১৫ সালের পর এই প্রথম বিএনপি ঢাকায় হরতাল কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে তারা বাম দলের হরতালকে সমর্থন দিলেও নিজেরা হরতাল ডাকতে সাহস পায়নি। গত শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির জনসমাবেশে কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিও ছিল উৎসাহব্যঞ্জক।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্ব কর্মীদের সেই উৎসাহ ধরে রাখতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে যান। সেই থেকে দলটি নেতৃত্ব সংকটে আছে। দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি হলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। লন্ডনে অবস্থানকারী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ ও উপদেশেই দল পরিচালিত হচ্ছে। যে দেশের রাজনীতি নিয়ত অস্থির ও পরিবর্তনশীল, সে দেশে এ রকম প্রবাসী নেতাকে দিয়ে দল চালানো যায় কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির ভেতর থেকেই। স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দলের নেতৃত্ব দিতে হলে তারেককে দেশে আসতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বিএনপির শুভানুধ্যায়ী হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্দেশে বলেছেন, ‘লন্ডনে বসে “ওহি” পাঠাবেন না। স্কাইপের মাধ্যমে দল পরিচালনা করবেন না।’ তিনি তারেককে লন্ডনে বসে দুই বছর মাস্টার্স বা এমফিলে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। নিজের ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বয়সের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘দুই ঘণ্টা দাঁড়াতে পারে না, এদের দিয়ে হবে না। আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে। আমাদের দিয়ে হবে না। বিএনপিতে অনেক দক্ষ ও চৌকস নেতা আছেন। তাঁদের দায়িত্ব দিতে হবে। তাঁরাই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন।’ তিনি আরও বলেন, লন্ডনে বসে এটা হবে না।
লন্ডন থেকে তারেকের দল পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা করেছেন দলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খানও। সম্প্রতি চট্টগ্রামের উপনির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে পাননি; যদিও বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে তারেকের বিরোধ স্পষ্ট হলেও কেউ পদপদবি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছেন না।
গত ডিসেম্বরে বিএনপির সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। দল এতটাই এলোমেলো যে নেতারা সম্মেলন করার সাহস পাননি। গত কয়েক বছরে বিএনপির সহযোগী ছাত্রদল, যুবদলসহ যেসব সংগঠনের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা নিয়ে হাঙ্গামা হয়েছে। দলীয় অফিসের সামনে কর্মীরা বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করেছেন। নেতাদের অবরুদ্ধ রেখেছেন।
জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকে জানেন না কীভাবে এসব কমিটি হয়, কীভাবে কারা কমিটির নেতৃত্বে আসেন। অথচ দায় এসে পড়ে তাঁদের ওপরই।
শনিবারের সমাবেশে বিএনপির নেতারা বলেছেন, আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবেন। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে না। কিন্তু তাঁরা কীভাবে আন্দোলন করবেন, আন্দোলনের রূপ কী হবে, তা তাঁদের জানা নেই। অতীতের মতো আন্দোলনের রূপরেখাটিও আসবে লন্ডন থেকে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রেখে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। কিন্তু অনেকে বলেন, তারপরও জামায়াতকে ছাড়তে না পারার কারণ তারেক রহমান। অতীতে তাঁর হঠকারী কর্মসূচি ও কথাবার্তায় বিএনপির অনেক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ কর্মীরা। তাঁরা ক্ষতির পরিমাণ আর বাড়াতে চান না। তাঁদের অভিযোগ, যখন আন্দোলন গতি পায়, তখনই লন্ডন থেকে এমন বার্তা আসে, যা আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে ২০১৩-১৪-এ দেওয়া তারেক রহমানের বালখিল্য বক্তৃতা-বিবৃতির কথাও বলেছেন একাধিক নেতা। গত ১০ থেকে ১১ বছরে দেশে বিএনপির নেতারা অনেক জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। মাসের পর মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। কিন্তু দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়েছে।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, গত জাতীয় নির্বাচনে তারেক রহমানের পরস্পরবিরোধী অবস্থান দলকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। তাঁর প্রথম কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া এবং বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। কিন্তু যখন সেই বৃহত্তর ঐক্য হলো না, তখন আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। অন্যদিকে দলের প্রার্থী কারা হবেন, সেটি নিয়েও দেনদরবার চলতে থাকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটি যে তালিকাই করুক না কেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে লন্ডন থেকে। এই নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে যে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল, তার মূলে ছিল লন্ডনি হস্তক্ষেপ।
নির্বাচনের পরও প্রথমে বিএনপি সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। পরে হঠাৎ লন্ডন থেকে বার্তা আসে, সংসদে যেতে হবে। বিএনপি যদি সংসদেই যাবে, তাহলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করানো হলো কেন?
বিএনপিতে এমন কথাও চালু আছে যে স্থায়ী কমিটির ভূমিকা হলো ডাকবাক্সের মতো। লন্ডন থেকে যে নির্দেশ আসে, সেটাতেই তাদের অনুমোদন দিতে হয়। বিদেশ থেকে ‘ওহি’ নিয়ে বিএনপি যে রাজপথের আন্দোলনে সুবিধা করতে পারবে না, সেটি দলের সাধারণ কর্মীরাও জানেন। তবু জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাহস করে বলেছেন। তাঁর এই ‘সদুপদেশ’ বিএনপির নেতৃত্ব কতটা আমলে, নেবেন সেটাই প্রশ্ন।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন