ছাত্রদের মিছিল
উনসত্তর আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্রসমাজই গড়ে তুলেছিল মহাবিদ্রোহের কাহিনি। সেদিনের স্বাধিকার আন্দোলন দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথে নিয়ে যায়। কিন্তু উনসত্তরে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্রসমাজ আন্দোলন করেছিল, ৫০ বছর পরও তার অনেক কিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে। গণ–অভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক
২০ জানুয়ারির কর্মসূচি পালনে ছাত্রদের প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। আগের দিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রনেতারা সমাবেশ করে বলেছেন, আপনারা ক্লাসে যাবেন না। ধর্মঘটে যোগ দেবেন। এদিনও সকালে বটতলায় শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা এসে সমবেত হন। অনেকের বিরাট ছাত্রসভা হয়। ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় অন্য ছাত্রনেতারাও বক্তৃতা দেন। ছাত্ররা অনেকেই লাঠিসোঁটা নিয়ে এসেছিলেন। থেমে থেমে তাঁরা স্লোগান দিচ্ছিলেন:
Eprothom Alo১১ দফা মানতে হবে
আইউব শাহি ধ্বংস হোক
ছাত্রসভা শেষে বিশাল মিছিল বের হয়। কিছুক্ষণ পর সেই মিছিল দুই ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ রেললাইন পার হয়ে কায়েতটুলি, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন, নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। অপর ভাগ মেডিকেল কলেজসংলগ্ন রশীদ বিল্ডিং পার হতেই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে গুলি করলে আসাদুজ্জামান নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হন। গুলিতে আরও আহত হয়েছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার চিফ ফটোগ্রাফার মোজাম্মেল হক, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আবু, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুল মজিদ। ছাত্ররা ধরাধরি করে আসাদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার আগেই তিনি মারা করেন।
মুহূর্তের মধ্যে গোটা মিছিলের চেহারা পাল্টে যায়। আইউব-মোনায়েমের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। আসাদুজ্জামান ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা (মেনন গ্রুপ)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আইন বিভাগে পড়ছিলেন। তাঁর বাড়ি নরসিংদীর হাতিরদিয়ায়। সেখানে তিনি কৃষকদের নিয়েও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
সেদিনের মিছিল নিয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন:
দুপুরবেলা। কার্জন হলের সামনে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। মিছিল আসছে। মিছিলের স্লোগান শোনা যাচ্ছে। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। এখনকার দোয়েল চত্বর হয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছে। এদিক থেকে আরও অনেকে এসে যোগ দিয়েছে। মিছিল এগিয়ে চলেছে পুরোনো কলাভবনের দিকে। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। মিছিল ছত্রভঙ্গ। একদিকে ইটপাটকেল, অন্যদিকে লাঠিপেটা আর কাঁদানে গ্যাস। এরপরই গুলি। খুব কাছ থেকে রিভলবার উঁচিয়ে গুলি ছুড়ল জনৈক পুলিশ অফিসার এক ছাত্রের বুকে। রাস্তার ওপরই ঢলে পড়ল ছাত্রটি। রক্তাক্ত দেহ ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ। ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) গ্রুপের নেতা।(একজন সাধারণ লোকের কাহিনি, আবদুল মান্নান খান)
আসাদ হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রনেতারা পৌনে ৩টায় পল্টনে শোকসভার আয়োজন করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল করে ছাত্ররা সেখানে যান। ছাত্রদের সেই মিছিলে এসে যোগ দেন শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা বয়সের মানুষ। সবার গন্তব্য ছিল পল্টন ময়দান। সেখানে ছাত্রনেতারা তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।শহীদ আসাদ
শহীদ আসাদ
পরদিন ২১ তারিখের হরতাল ছিল স্বতঃস্ফূর্ত । এদিন হরতাল পালন করতে কোনো পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয়নি। ভয়ে পুলিশ রাস্তায়ই নামেনি। ইপিআর বিভিন্ন স্থানে টহল দিলেও আগের দিনের মতো মারমুখী ছিল না। বিভিন্ন স্তরের মানুষ শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড তৈরি করে। সেদিন হরতাল সফল করতে আদমজী থেকে শ্রমিকেরা এসেছিলেন। পলাশ-ডেমরা থেকে শ্রমিকেরা এসেছিলেন। পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল জঙ্গি রূপ নেয়। আবারও ছাত্র ও ইপিআরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে ইপিআর বেয়নেট চার্জ করে ও গুলি ছোড়ে। ১৫ ছাত্রীসহ বহু মানুষ আহত হন।
দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার অফিসের চারতলায় বসে আছেন শামসুর রাহমান। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন মিছিল যাচ্ছে। মিছিলের সামনে বাঁশের লাঠিতে একটি রক্তমাখা শার্ট। মিছিলটি পশ্চিম দিক থেকে ডিআইটি মোড় ঘুরে ফের দক্ষিণ দিকে চলে যায়। সহকর্মী সাংবাদিকেরা তাঁকে জানান, গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদুজ্জামান আসাদ নামের যে ছাত্রকে পুলিশ হত্যা করে, তাঁর শার্ট নিয়েই মিছিল যাচ্ছে পল্টনের দিকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। দেখতে দেখতে মিছিলটি বড় হতে থাকে। শামসুর রাহমান তাঁর কক্ষে ফিরে গেলেন। নিউজপ্রিন্টের প্যাডটি সামনে টেনে নিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই লিখিত হলো একটি অসাধারণ কবিতা। ‘আসাদের শার্ট’।
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালী তন্তুর সূক্ষতায়
বর্ষীয়সী জননী সে–শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কত দিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালীম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে, এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
অাসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
এ যেন কবিতা নয়। হৃদয়ের আর্তি আর শপথের গাঢ় উচ্চারণ।
২১ জানুয়ারির মিছিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক সংবাদ লিখেছে:
মিছিলে অসংখ্য কালো পতাকা ও রক্তে আঁকা ফেস্টুন বহন করা হয়। মিছিলে ছাত্রছাত্রী, কিশোর, মহিলা, শ্রমিক কর্মচারী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, রাজনীতিক, পরিষদ সদস্য, শিল্পী–সাহিত্যিকসহ সকল নাগরিক যোগদান করেন। ২০০১ সালের মধ্যে এত বড় মিছিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়নি। এই বিশাল গণমিছিলে ছাত্রপদভার ও বজ্রনির্ঘোষ আওয়াজে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মিছিল যতই অগ্রসর হতে থাকে, ইহার কলেবর ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। (সংবাদ, ২২ জানুয়ারি)
২২ জানুয়ারিও ঢাকায় বিরাট মিছিল বের হয়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যোগ দেন সেই মিছিলে। একদিকে মিছিল আরেক দিকে পুলিশ-ইপিআর–সেনাবাহিনী। ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আর মিছিলকারীরা সবাই নিরস্ত্র। তারপরও ওরা নিঃশঙ্ক, ভয়হীন। মিছিল যতই এগিয়ে যাচ্ছে, অস্ত্রধারী পুলিশ-ইপিআর ততই পিছু হটছে।
২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল বের হলো। দেখার মতো ছিল সে দৃশ্য। ছাত্ররা দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর মশালের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
তারা স্লোগান দিচ্ছে,
আসাদ আমার ভাই
শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
আগামীকাল: মতিউরের রক্তে ছিল শাশ্বত মুক্তির গান
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন