উনসত্তর আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্রসমাজই গড়ে তুলেছিল মহাবিদ্রোহের কাহিনি। সেদিনের স্বাধিকার আন্দোলন দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে চূড়ান্ত স্বাধীনতার পথে নিয়ে যায়। কিন্তু উনসত্তরে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্রসমাজ আন্দোলন করেছিল, ৫০ বছর পরও তার অনেক কিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে। গণ–অভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রথম আলোর এই ধারাবাহিক
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯ বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ
উনসত্তরের প্রথম সূর্যোদয়টি ছিল অন্য রকম। খ্রিষ্টীয় নতুন বছর বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে নতুন বার্তা। এদিনই কয়েকটি ছাত্রসংগঠন মিলে বটতলায় (নতুন কলাভবনের সামনে) সমাবেশ করে। আইউবের এক দশকের স্বৈরশাসন সারা দেশে একটি দমবন্ধ অবস্থা তৈরি করেছিল। কিন্তু এ থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে, কেউ বলতে পারছিল না। তখনো বেশির ভাগ রাজনীতিক কারাগারে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রুদ্ধ। শ্রমিকেরা অধিকারহারা।
আইউবী দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে এগিয়ে আসে ছাত্রসমাজ। ৪ জানুয়ারি ডাকসু ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং তিনটি ছাত্রসংগঠনের নেতারা বসে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। গঠন করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বা স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি (Student Action Committee)। তখন ডাকসুর সহসভাপতি ছিলেন তোফায়েল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী। অন্য ছাত্রনেতারা ছিলেন: আবদুর রউফ, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ; খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান, ছাত্রলীগ; সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, শামসুদ্দোহা, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ); মোস্তফা জামাল হায়দার, সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন; দীপা দত্ত, সহসম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, (মেনন গ্রুপ)।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচিতে শুধু ছাত্রদের দাবির কথা ছিল না। কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের দাবির কথা ছিল।ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও।
Eprothom Aloউল্লেখযোগ্য দাবি ছিল
ক. সচ্ছল কলেজগুলো প্রাদেশিকীকরণের নীতি ত্যাগ করতে হবে এবং জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিকীকরণ কলেজগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে।
খ. শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা প্রসারের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ; পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও বাণিজ্যিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে।
গ. প্রদেশের কলেজগুলোতে দ্বিতীয় শিফটে নৈশ আইএ, আইএসসি ও আইকম, বিএ, বিএসসি ও বিকম এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোতে নৈশ এমএ ও এমকম ক্লাস চালু করতে হবে।
ঘ. ছাত্র বেতন ৫০ শতাংশ কমাতে হবে এবং বৃত্তির পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়াতে হবে; ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের অপরাধে কারও বৃত্তি বাতিল করা যাবে না।
ঙ. হল ও ছাত্রাবাসগুলোর ডাইনিং হল ও ক্যানটিনের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ সরকার কর্তৃক সাবসিডি দিতে হবে।
চ. হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ছ. মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে; অফিস–আদালতে বাংলা চালু করতে হবে এবং সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক অভিজ্ঞ শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হবে; শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে ; স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
জ. অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে; নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে;
ঝ. মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে; প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলোপ, নমিনেশনে ভর্তি প্রথা ১০% ও ৭৫% রুল বাতিল, কেন্দ্রীয় পাঠাগারের ব্যবস্থা করতে হবে; পলিটেকনিক ছাত্রদের ‘কনডেন্স কোর্সের সুযোগ দিতে হবে এবং সেমিস্টার পদ্ধতির ভিত্তিতে ডিপ্লোমা দিতে হবে। ট্রেনে, স্টিমারে, বাসে ও লঞ্চে ছাত্রদের ৫০% ভাড়ায় টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের ৫০% দামে টিকিট দিতে হবে; চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এর বাইরে ১০টি দাবিই গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা–সংক্রান্ত, যার মধ্যে ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধিনতা। দৈনিক ইত্তেফাক–এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে ফেডারেল এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ছাড়া সব বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ।
দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সব ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুঁশিয়ারি প্রত্যাহার করতে হবে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সব রাজনৈতিক কারণে জারি করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর দ্রুত দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও সংগঠিত হয়। ১০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ফের ছাত্রসভার আয়োজন করা হয়। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ ও ইপিআর বাধা দেয়। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে যায় সংঘর্ষ। প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ জানুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করে। এদিনও কলাভবনের সামনে সংক্ষিপ্ত ছাত্র জমায়েত ও মিছিল হয়।
আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলো একসঙ্গে আন্দোলন করলেও তাদের আদর্শ ও স্লোগান এক ছিল না। ছাত্রলীগের প্রধান স্লোগান ছিল:
তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা
পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা
জেলের তালা ভাঙব,
শেখ মুজিবকে আনব
ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) স্লোগান ছিল:
জয় সর্বহারা। মণি সিংহ-মতিয়ার মুক্তি চাই
সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।
ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) আওয়াজ তুলত
গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ
সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।
তবে ছাত্রসংগঠনগুলো একটা বিষয়ে একমত ছিল, আইউব–মোনায়েম খানকে তাড়াতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পশ্চিমাদের শোষণ–জুলুম বন্ধ করতে হবে।
শুধু ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা নন, আইউবের বিরুদ্ধে মাঠে নামেন লেখক-শিল্পীরাও। ১৪ জানুয়ারি লেখক স্বাধিকার সংগ্রাম কমিটি নামে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। ১৫ জানুয়ারি একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত লেখকদের প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক এবং বক্তৃতা করেন জয়নুল আবেদিন, ড. আহমদ শরীফ, বেগম সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, কে জি মুস্তাফা, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুহম্মদ মুনসুরউদ্দীন প্রমুখ। অাট দলের সমন্বয়ে গঠিত ডাক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা পুরোপুরি সমর্থন না করলেও দুই পক্ষ ১৭ জানুয়ারি দাবি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব জেলে থাকলেও তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতেই ডাক নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে আইউবের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
সেদিন বটতলার সমাবেশে ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসেন। আসেন বিভিন্ন কলেজ থেকেও। সভা শেষে মিছিল বের হতেই পুলিশ-ইপিআর বাধা দেয়। ছাত্ররাও প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা পুলিশের বাধা পেরিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করেন। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ে তঁাদের নিবৃত্ত করে। অন্যদিকে ছাত্ররাও পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। পুরো ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অনেকে রক্তাক্ত ও আহত হন। পুলিশ আহত ছাত্রদের ট্রাকে তুলতে গেলে মোশাররফ হোসেন নামের এক ছাত্র সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। এতে ছাত্ররা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ঘণ্টা দেড়েক দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। লাল পানি ছিটায়। অনেকে আহত হন। তারপরও ছাত্ররা পিছু হটেননি। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমে ডাকের সমাবেশেও হামলা করে পুলিশ। কয়েকজনকে তারা গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি সমগ্র প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট হয়। এদিনও বটতলায় ছাত্রসভা হয়। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। কিন্তু সেই বাধা উপেক্ষা করে তঁারা মিছিল নিয়ে গুলিস্তানে যান এবং সেখানে স্থাপিত মীর জুমলার কামানের সামনে আবার জমায়েত হন।
এরপর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবনে গিয়ে হামলা করে। তারা জিন্নাহ হল ও ইকবাল হলের রুমে ঢুকে ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালায়। এতে শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হন। মহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ ড. ইন্নাস আলী ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি মফিজউদ্দিন আহমদ হামলার নিন্দা জানান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ছাত্রদের ওপর হামলার নিন্দা জানানো হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৮ জানুয়ারি সমাবেশ থেকে ১৯ ও ২০ জানুয়ারি ফের ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। দুই দিনই ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯ জানুয়ারি পুলিশ বর্তমান বুয়েটের দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।
আগামীকাল: ডাক দিয়ে যায় আসাদ
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন