মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলাকালে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে এক শিক্ষার্থী। গতকাল দুপুরে
এক অভূতপূর্ব ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল পরীক্ষা করছে। যেসব যানবাহনের চালক গাড়ির ফিটনেস সনদ, হালনাগাদ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেননি, তারা সেসব যানবাহন থামিয়েছে। পুলিশ ডেকে মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। গাড়ির ফিটনেস কিংবা চালকের হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকা যানবাহন থেকে মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ সদস্য ও গণমাধ্যমের কর্মীদেরও নেমে যেতে বাধ্য করছে তারা।
এই কিশোর-তরুণেরা আমাদেরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হয়, কীভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হয়। পূর্বসূরিরা অন্ধ হলে উত্তরসূরিরাই পথ দেখায়। রাস্তায় যে কাজটি ট্রাফিক পুলিশের করার কথা, বিআরটিএর করার কথা, সেই কাজটি করল কিশোর–তরুণেরা। অন্যান্য দিন দেখা যেত ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকাচ্ছেন, চালককে ধমকাচ্ছেন, পথচারীদের দিকে তেড়ে আসছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর দেখা যায় দুই পক্ষের মধ্যে ‘রফা’ হচ্ছে, লাইসেন্স না থাকলেও উৎকোচ দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন যাচ্ছে চালকেরা। শুধু সতীর্থ হত্যার বিচার দাবি নয়, সড়ক পরিবহনের নৈরাজ্য দূর করতেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অবস্থান নেয়। রাজধানীর বাইরেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে তারা স্লোগান দিয়েছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই।’ ‘নিরাপদ সড়ক চাই।’ ‘অপরাধীর বিচার চাই।’ ‘নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই।’ তাদের আকুতি, দিয়া-রাজীবের মায়ের মতো আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। কিন্তু তারপরও সড়কে মৃত্যু থেমে নেই। গতকালও মগবাজারে বাসের চাপায় একজন মারা গেছেন।
বিকেলে কারওয়ান বাজার থেকে হেঁটে শাহবাগ যেতে দেখি, মোড়ে মোড়ে শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তারা নানা ধরনের যানবাহন পরীক্ষা করছে। শাহবাগের মোড়ে কথা হয় কয়েকজন পথচারীর সঙ্গে। মধ্যবয়সী একজন জানালেন, তিনি মিরপুর থেকে হেঁটে এসেছেন। কোনো খেদ নেই। তাঁরা কিশোর-তরুণদের এই ন্যায় আন্দোলনের পক্ষে আছেন।
সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আমজনতাকে নিয়ত সবক দেন। আইন মেনে চলার সদুপদেশ দেন। কিন্তু তঁারা নিজেরা যে আইন মানেন না, সেটাই প্রমাণিত হলো। ছাত্ররা ভিআইপি, ভিভিআইপি, সিআইপি চেনে না। ফিটনেস না থাকা ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সের কারণে শিক্ষার্থীরা যেসব গাড়ি আটক করেছে, তার বেশির ভাগই সরকারি প্রতিষ্ঠানের। আইন মানানো যাঁদের দায়িত্ব, তঁারাই আইন অমান্য করে চলেছেন। সর্বত্র নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির মহোৎসব।
গত দুদিনে ছাত্ররা যেসব প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ধরেছে, কর্তৃপক্ষ কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে? পারবে না। তাহলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য কীভাবে দূর হবে? ঢাকার পরিবহন অব্যবস্থার আরেকটি কারণ রুট পারমিট ব্যবস্থা। যেসব সড়কে যাত্রী বেশি, সেসব সড়কে পারমিট নেওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হয়। এরপর সেই টাকাটি তুলতে চালকেরা পাল্লা দিয়ে বাস চালান। জাবালে নূর কোম্পানির যে বাসটি সেদিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছিল, সেই বাসের রুট পারমিটই ছিল না। ছিল না চালকের বাস চালানোর লাইসেন্সও। লাইসেন্স ছিল ছোট গাড়ি চালানোর।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রস্তাবিত আইন পাস হলে পরিবহন খাতের সব সমস্যা দূর হবে। নতুন আইনে কী হবে সেটি পরে দেখা যাবে। কিন্তু পুরোনো আইন প্রতিপালিত হচ্ছে না কেন? বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেওয়া যায়, কোনো আইন নেই লাইসেন্স ছাড়া কেউ রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারেন, অথচ সেটাই চলছে।
ছাত্ররা রাস্তায় নামার পর সরকারের মন্ত্রী-আমলা-নেতাদের ঘুম ভেঙেছে। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলেন, দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় মস্ত বড় গড়বড় আছে। তঁারা বৈঠক ডাকলেন, সলাপরামর্শ করলেন। করণীয় বাতলালেন। ঘোষণা করলেন লাইসেন্স ছাড়া কোনো বাস-মিনিবাস নামতে দেওয়া হবে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো চালক গাড়ি চালাতে পারবে না। বিআরটিএ নামক সংস্থাটিও নড়েচড়ে বসল। রাজপথে খাটিয়া টানিয়ে গাড়ি পরীক্ষা করে কতজনকে জরিমানা করে কত টাকা আদায় করা হয়েছে, তাও জানিয়ে দিলেন।
কিন্তু এত দিন তাঁরা বলতেন, সব ঠিক আছে। এই সব ঠিক আছের মাঝেই প্রতিদিন বাসচাপায়, চালকের খামখেয়ালিতে কত নারী, পুরুষ ও শিশুকে যে জীবন দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ নিয়ে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিংবা যাত্রী কল্যাণ সমিতি কথা বললেই মন্ত্রীরা রই রই করে উঠতেন। বলতেন সব অপপ্রচার। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের একজন মন্ত্রী আছেন। কিন্তু পরিবহন খাতটি নিয়ন্ত্রণ করছেন আরেকজন মন্ত্রী, যিনি নৌপরিবহনের দায়িত্বে। এই মন্ত্রী একই সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। কী করে একজন মন্ত্রী একটি শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা থাকেন? আমরা দেখেছি, কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পত্রিকার সম্পাদক মন্ত্রী হওয়ার পর আগের পদটি ছেড়ে দেন। কিন্তু মন্ত্রী শাজাহান খানকে কিছুই ছেড়ে দিতে হয়নি। তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তাদের প্রতিটি কাজে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজেন। কিন্তু দীর্ঘদিন এই ফেডারেশনে সভাপতি ছিলেন বিএনপির একজন নেতা।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি নতুন নয়। এ নিয়ে হরতাল, অবরোধ, মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন অনেক কিছুই হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বলেই আজ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামতে হয়েছে। আমরা অভিনন্দন জানাই তরুণ প্রজন্মকে, যারা স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী হয়েও পুরোনোদের ঘুম ভাঙিয়েছে। তারা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেনি, তারা চেয়েছে নিরাপদ সড়ক। নিরাপদ জীবন।
ঢাকার পরিবহন খাতের নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা দূর করা যে অসম্ভব নয়, সেটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক মেয়র আনিসুল হক গুলশান–হাতিরঝিলে ঢাকা চাকা বাস চালু করে। তিনি একেকটি রুটে একেকটি পরিবহন প্রতিষ্ঠান বা একাধিক পরিবহন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত জোটের মাধ্যমে বাস চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে সেই উদ্যোগ কার্যকর হতে পারেনি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বললেন, এটি সময়সাপেক্ষ। আমরা জানি না, আর কত মানুষ মারা গেলে সেটি বাস্তবায়ন হবে?
মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন। আবার মিরপুরে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ ও অজ্ঞাতনামা যুবকেরা একযোগে হামলা চালিয়েছে। এই স্ববিরোধিতা কেন?
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সরকার দ্বিমুখী নীতি নিয়ে এগোচ্ছে। একদিকে মন্ত্রীরা ছাত্রদের নয়
দফা দাবি পূরণের আশ্বাস দিচ্ছেন, তাদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলছেন, অন্যদিকে পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রদের লাঠিপেটা করছে। ছাত্রদের এই আন্দোলনের মধ্যে সরকার বিএনপি–জামায়াতের অনুপ্রবেশ খুঁজছে, অথচ পুলিশের সহায়তায় যারা ছাত্রদের ওপর হামলা চালাল, তাদের সম্পর্কে কিছু বলছে না। এদের চিহ্নিত করলেই আসল রহস্য বের হয়ে আসবে।
কেবল সরকারের মন্ত্রীরা নন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সদুপদেশের আড়ালে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু অনুগ্রহ করে তারা কিশোর-তরুণদের সদুপদেশ না দিয়ে তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যদি নিজ নিজ বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে যঁারা লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালাচ্ছেন, তঁাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে সড়কে যেমন শৃঙ্খলা ফিরে আসত, তেমনি দুর্ঘটনায়ও এত মানুষ মারা যেত না। যেদিন মন্ত্রীরা ছেলেমেয়েদের রাস্তা ছেড়ে ক্লাসে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, সেদিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করল। তাঁরা ছাত্রদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলছেন, আবার বাসশ্রমিকেরা ধর্মঘটে নেমেছেন, যঁাদের নেতা নৌপরিবহনমন্ত্রী।
তাহলে কি মন্ত্রী নিজেই সরকারের বিরুদ্ধে ‘অঘোষিত’ ধর্মঘট করছেন?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন