প্রিয়ভাষিণীর জন্য ভালোবাসা
13 December 2017, Wednesday
বাবার তো অনেক বয়স হয়েছে। চোখে দেখেন না এখন। রাতে বাথরুমে যান একটু পরপর। বাবার জন্য টেনশন করে ঘুমাতে পারেন না মা। তাঁর বিছানার পাশে চেয়ারে বসে ঝিমোতে থাকেন। বাবা একটু উঠলেই জেগে ওঠেন। বাবাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যান। সেখানে একদিন মেঝেতে পা পিছলে পড়ে যান। পায়ের গোড়ালির হাড়-চামড়া ছিঁড়ে বের হয়ে যায় বাইরে!
তূর্যকে আমার বলতে ইচ্ছে করে, প্লিজ, একটু থামেন এবার। আর শোনা যায় না তাঁর মায়ের কষ্টের গল্প। আমি তাঁর মাকে চিনি, পুরো বাংলাদেশ চেনে তাঁকে। তিনি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন তিনি পুরো সাতটি মাস। বাংলাদেশের বহু মা, বহু বোন এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সবার মধ্যেও অনন্য হয়েছেন লোকলজ্জা আর সামাজিক ট্যাবুকে অগ্রাহ্য করে অকপটে সে কথা জাতিকে জানিয়ে। বাংলাদেশের বহু প্রজন্মের মানুষের কাছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত মনুমেন্ট। বড় বড় অনুষ্ঠানে, বড় বড় গৌরবগাথায় মধ্যমণি হয়ে থাকেন তিনি। কোনো দিন তাঁকে দেখে মনে হবে না নিজের কত কষ্টের কথা তিনি লুকিয়ে রাখেন মানুষের কাছে।
১০ ডিসেম্বর ছিল তাঁর পায়ের অপারেশন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এই অপারেশনে ঝুঁকি আছে। তাঁর প্রথম চিকিৎসা হয়েছে ল্যাবএইডে। সেখান থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীও নাকি বলেছেন, তিনি চাইলে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তিনি তা চাননি। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, এখানেই তাঁর চিকিৎসা হোক, চান তিনি। তা ছাড়া কারও কাছে নিজে থেকে কিছু চাওয়া ধাতে নেই তাঁর। নামী এক সরকারি হাসপাতালের কেবিনে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি এতেই খুশি ছিলেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে আমার দেখতে যাওয়ার কথা অনেক দিন ধরে। ধানমন্ডি থেকে পূর্বাচলের কাছে সুদূর ৩০০ ফুটে বাস করতে তিনি চলে গেছেন বছর তিনেক আগে। পরে একদিন বেঙ্গল গ্যালারিতে তাঁর প্রদর্শনীতে গেলে বুকে জড়িয়ে ধরেন আমাকে আর শীলাকে। বারবার বলেন তাঁর নতুন বাসায় যেতে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সত্যি কি যাব আমি এত দূরে!
রত্নেশ্বরী আমাকে বারবার মেসেজ পাঠায়, মা দেখতে চান আপনাকে। কিছুদিন আগে বড় বোন মারা গেছেন তাঁর। তখনো বলেছিলেন, মা যেতে বলেছেন আপনাকে। আমার যাওয়া হয়নি, এমনকি তিনি পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে জড়িয়ে ধরে হাসপাতালের বড়কর্তা, সমাজের বড় বড় মানুষের ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়, ফেসবুকে কতজন ছবি দেয় তাঁর গালে গাল ঠেকিয়ে। ভাবি, আমার মতো নগণ্য একজন না গেলে কীই-বা হয় তাঁর? অগাধ স্নেহভরা অন্তর তাঁর, হয়তো এমনি বলেন যেতে। তারপরও অপারেশনের আগের দিন তাঁর কাছে না গিয়ে পারিনি।
তাঁর কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তূর্য এসে ভেতরে নিয়ে যায় আমাদের। সেখানে একটা বেডের পাশে নানা ধরনের নল গায়ে বহন করে হুইলচেয়ারে বসে আছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। শীলার হাত টেনে জড়িয়ে রাখেন বুকে, আরেকটা হাত রাখেন আমার হাতে। সারা রাত ঘুমাননি তিনি অসহনীয় শারীরিক কষ্টে। ঘুমাননি তূর্যও। অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে এসে দিনরাত মায়ের পাশে আছেন তিনি, অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে পালা করে।
তূর্যের তাতে কষ্ট নেই। তাঁর কষ্ট অন্য জায়গায়। আমাকে চৌকো একটা পাউরুটির টুকরা দেখিয়ে বলেন, মাকে সকালে নাশতা খেতে দেয় এটা। মায়ের সুগার লেভেল না কমলে নাকি অপারেশন করা যাবে না। অথচ পাউরুটি থাকে চিনিভরা। মাকে এটা খেতে দিই কীভাবে? মা তাই শুধু একটা ডিমের সাদা অংশ খেয়ে থাকেন সকালে।
তূর্য বিদেশে থাকেন বহু বছর। বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় তাই হতবুদ্ধ তিনি। তাঁর কথা শুনতে শুনতে তাঁর মতো করে ভাবতে থাকি। তাই তো, কেন তাঁর খাওয়ার কোনো সুব্যবস্থা থাকবে না। কেন তাঁর রুমে জুতা, ক্যামেরা আর একদল সঙ্গী নিয়ে ঢুকবে মানুষ? কেন কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে দেখতে আসবেন কোনো ফাইল না পড়ে? কেন তাঁদের কণ্ঠে থাকবে না কোনো সহমর্মিতা?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ছেলেকে বহুবার থামানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু চিকিৎসকের ব্যবহারের প্রসঙ্গ এলে তাঁর নিজেরই চোখ টলটল করে ওঠে। তিনি একজন তরুণ চিকিৎসককে বলেছেন, চিকিৎসার মূল বিষয়টি হচ্ছে রোগীকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া। বিদেশে এটাই করা হয়। সেই চিকিৎসক তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন, তাহলে বিদেশে চলে যান চিকিৎসা করাতে। গাল থেকে চোখের জল মুছে তিনি বলেন, কোনো দিন কাউকে কটু কথা বলিনি বাবা। তাঁকে বলেছি।
কী বলেছেন?
বলেছি, ডাক্তারি বিদ্যা বোধ হয় ভালো করে শেখা হয়নি আপনার।
এই তাঁর কটু কথা! হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। সেই চিকিৎসক জানেন না বিদেশে চিকিসার ইচ্ছা নেই তাঁর, নেই এমনকি সামর্থ্যও। এই দেশে নানা আমলে কত মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের পরিবার সরকার থেকে বাড়ি-গাড়ি পেয়েছেন। কখনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও পেয়েছে এসব। তিনি কিছু পাননি, পাওয়ার চেষ্টা করার রুচি পর্যন্ত হয়নি তাঁর। ভাড়াবাড়িতে থাকেন, ৭০ বছর বয়সেও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলাফেরা করেন। কয়েক মাসের ভাড়া জমে গেলে, দোকানে কয়েক মাসের টাকা বকেয়া পড়লে নিজের স্থাপত্যকর্মের প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখান থেকে ওঠা টাকায় ঋণ পরিশোধ করেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক বাংলাদেশে। অথচ এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর দায়িত্ব নেয়নি কোনো সরকার। মুক্তিযোদ্ধার ভাতার কয়েক হাজার টাকা পাওয়ার জন্য বহু জায়গায় ঘুরতে হয় বলে বাদ দিয়েছেন তা-ও। তিনি নিজে কিছুই নেননি। বড় ছেলে তিতাস জানালেন, মা আমাদের জন্যও কাউকে কিছু বলেননি।
তিতাসের রাগ অন্যখানে। অসুস্থ শরীরে অটোরিকশা খুঁজে খুঁজে দীর্ঘ পথ তিনি যান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তিনি সেখানে বিশাল অতিথি বা বিশিষ্ট বক্তা! তিতাস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, মাকে তারা একটা গাড়ি পাঠাতে পারে না? তিনি এই ‘তারা’দের বিভিন্ন কাহিনি বলতে বলতে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠেন। হাত উঁচিয়ে প্রিয়ভাষিণী থামান তাঁদের। থাম বাবা, এসব বলিস নে! কারা কারা তাঁকে সাহায্য করেছে, সেসব বলেন তারপর। খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে হয় এসব সাহায্য, তবু তিনি বলেন তা সবিস্তারে।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে কতক্ষণ চিন্তা করতে পারি না কিছু। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে আধো অন্ধকার শহরে। রিকশা
নেওয়া দরকার, সেটাও বুঝতে পারি না। কেবল মনে হয়, কেন তাঁকে দেখে আগে বুঝিনি কত রকম কষ্টে থাকেন তিনি?
তাঁর প্রবল আত্মমর্যাদায় উপস্থিতির জন্য? নিজের কষ্ট আড়ালে রেখে শুধু অন্যদের নিয়ে চিন্তা করার জন্য? আমি নাহয় সামান্য মানুষ, কালেভদ্রে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। অন্যরা কেউ কি বোঝেনি? কেউ না?
আমার পাশে গজগজ করতে থাকে শীলা। কেন প্রিয়ভাষিণীকে বাসাভাড়ার চিন্তা করতে হবে? কেন তাঁকে অটোরিকশা খোঁজার জন্য রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? কেন তাঁর মতো একজন মানুষের দায়িত্ব নিতে পারে না সরকার? শীলাকে থামাতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। রাগে নাকি কষ্টে চোখ ভিজে গেছে তার।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্য আমাদের সবার কি এমন চোখের জল আসা উচিত নয়? যাদের হাতে ক্ষমতা, তাদের কি উচিত না এই অকুতোভয় বীর নারীকে সাংসারিক তুচ্ছতার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করা? তাঁর সুচিকিৎসা ও দেখাশোনার সব রকমের ব্যবস্থা করা?
অপারেশনের পর ফোন করি তূর্যকে। অপারেশন সফল হয়েছে তাঁর। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ হলো অপারেশন-পরবর্তী দেখভালের। এই দেখভালের সুব্যবস্থা কি আছে তাঁর বর্তমান হাসপাতালে? কোনো চিকিৎসক কি স্নেহময় কণ্ঠে বলবেন তাঁকে: আপনি ভালো আছেন, মা! কোনো চিন্তা করবেন না, আমরা সবাই আছি আপনার জন্য।
তূর্য নিশ্চিত নন এমন কিছু ঘটবে। তিনি বরং আমাকে বললেন, ফেরার আগে আপনাকে বলে যাব কী হয় এখানে।
আমি তূর্যর থেকে এমন কিছু শুনতে চাই না। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি যেন ফেরত যান খুশিমনে। মা-বাবাকে নিয়ে তাঁর, তিতাসের, রত্নেশ্বরীর দিনরাত চিন্তার অবসান যেন ঘটে।
আমাদের যেন তিনি বলে যান: বাংলাদেশ সম্মান করতে পেরেছে তার বীর মাতাকে। যেন বলতে পারেন: সত্যি ভালো আছেন আমাদের প্রিয়ভাষিণী!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন