বাংলাদেশ আবারও বিশ্ব রেকর্ড করেছে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশের নাম আসা উচিত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে আমরা অনেকগুলো রেকর্ড করেছি। ক্রিকেট খেলার রেকর্ড বইয়ে যেমন বিচিত্র ধরনের রেকর্ড লেখা হয়, আমাদের বেলায়ও প্রশ্নপত্রের ফাঁসের রেকর্ড বহু বিচিত্র। বিভিন্নভাবে আমরা রেকর্ড করছি। ক্রিকেটে যেমন আপনি যদি সবচেয়ে বেশিবার শূন্য রানে আউট হন, সেটাও রেকর্ড, সবচেয়ে বেশিবার ৯৯ রান করলেও রেকর্ড, নিজের ব্যাট দিয়ে নিজের উইকেট ভেঙে দিয়েও আপনি রেকর্ড খাতায় নাম লেখাতে পারেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেকর্ড তেমনি বহুমাত্রিক, বহুকৌণিক, বহু বিচিত্র।
যেমন: সর্বকনিষ্ঠ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস।
বরগুনায় প্রথম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। গতকাল ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ডেইলি স্টার-এর প্রথম পৃষ্ঠার খবর। বরগুনা সদরের ২৪৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণির পরিবেশ পরিচিতি এবং চতুর্থ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করতে হয়েছে। কারণ, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। পরীক্ষার আগেই অভিভাবকেরা ফেসবুকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র প্রকাশ করে দিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যখন দেখা গেল ঘটনা সত্য, বেচারি কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা আপাতত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো। এর আগে চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে একই কারণে।
শুধু বরগুনায় ঘটনা ঘটলে তো চলবে না। আমাদের আছে বরগুনা থেকে বিক্রমপুর। মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনও জেলার দ্বিতীয় আর চতুর্থ শ্রেণির ১১৯টি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা স্থগিত করেছে। কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে।
বরগুনার ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষক ইউনুস আলী বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা ঘটতে পারে না।’
কবি কেন বলেছেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, আর আমরা কতটাই বিপরীতভাবে কবির কথাটাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছি।
সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিষয় ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ডও এখন বাংলাদেশের। আমরা প্রথম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি।
দাঁড়ান দাঁড়ান। আমরা কেজি ওয়ানের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা প্লে গ্রুপের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি।
আরে দাঁড়ান না।
আমরা প্লে গ্রুপে ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টার খুলেছি এবং প্লে গ্রুপের ভর্তির প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছি। আমরা ক্লাস ফাইভের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে আমাদের ঐতিহ্য কয়েক যুগের।
আমরা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি। আমরা ব্যাংকে অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছি।
এত বেশিসংখ্যক বিষয়ে এত বেশিসংখ্যক স্তরে এত বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নপত্র ফাঁস পৃথিবীর আর কেউ কোনো দিনও করতে পারবে না। আমাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ। আছেন কোনো দেশ? কত বিষয়ে কত রেকর্ডই তো আপনাদের আছে, হে বিশ্বসভার সদস্য দেশগণ, বাংলাদেশের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁস কি কেউ কোনো দিনও করতে পেরেছেন? কোনো দিনও পারবেন? হিম্মত থাকলে হাত তোলেন। এত বেশি বিষয়ে এত অসংখ্যবার প্রশ্নপত্র ফাঁস তো দূরের কথা, এই কল্পনাও আপনারা করতে পারবেন না।
এরপরের রেকর্ড হলো প্রশ্নপত্র ফাঁসে প্রযুক্তির ব্যবহার।
প্রকাশ্য ক্যামেরা, গোপন ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফটোকপিয়ার থেকে শুরু করে দেহের ভেতরে গোপন চিপস স্থাপন, প্রকাশ্যে মাইক্রোফোন লাউডস্পিকার ব্যবহার-আরও যেসব পদ্ধতি জানি না বা আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিংও কল্পনা করতে পারবেন না, তা আমরা আবিষ্কার করেছি, প্রয়োগ করেছি, এবং তাতে সফল হয়েছি।
আর আছে টাকার লেনদেন। আমাদের জাতীয় বাজেটে প্রশ্নপত্র ফাঁসের টাকা কত শতাংশ অবদান রাখছে, জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব কী, তা গুরুতর আলোচনার দাবি রাখে। এক হাজার টাকায় প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়, এক লাখ টাকায় হয়, তিন লাখ টাকাতেও হয়। কোচিং সেন্টারের মালিক বলে রেখেছেন, ১০ লাখ টাকা দেবেন, ছেলে/মেয়ে আপনার মেডিকেলে চান্স পাবে। বাকিটা আমার।
আহা! ছোটবেলায় হাসির গল্প শুনতাম। মাস্টার বলছেন, ‘ছেলেকে রেখে যান, পিটিয়ে মানুষ করে দেব, কত গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম, আর আপনার ছেলেকে মানুষ করতে পারব না।’ পাশেই ছিল এক গাধা। সে তার বাবাকে ধরল, ‘বাবা, আমিও স্কুলে ভর্তি হব। মাস্টার বলেছে, তিনি গাধা পিটিয়ে মানুষ করতে পারেন। আমিও মানুষ হব।’
এই দেশে এখন আমরা কী করছি? গাধাকে মানুষ করছি, নাকি মানুষকে গাধা করছি? গাধাও কিন্তু একটা আদর্শ প্রাণী, মুখ বুজে বোঝা বয়ে বেড়ায়। আমরা আসলে হয়ে উঠছি শৃগাল।
আমরা শৃগাল অভিভাবকেরা শৃগাল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের মানুষের বাচ্চা শিশুগুলোকে শৃগাল বানানোর প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছি। মাস্টার সাব, ওকে পড়তে জানতে হবে না, লিখতে জানতে হবে না, অঙ্ক কষতে হবে না, ও দুটো ছড়া-কবিতা-গল্প পড়ে সময় নষ্ট করবে কেন, ওকে ফল দিন, ওকে ভালো জায়গায় ভর্তি করিয়ে দিন, সেখান থেকে ও ভালো একটা টাকা বানানোর মেশিন হয়ে বের হোক।
আর আমাদের চৈতন্য বলে যে একটা জিনিস ছিল, বিবেক বলতে যে একটা জিনিস ছিল, কর্তৃপক্ষ বলতে যে একটা জিনিস ছিল, তারা কোথায় গেল?
তারা তো ঘুমিয়েছে। আমরা যখন একটু চিল্লাপাল্লা করি, তখন তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। তারা বড্ড খেপে যায়: দেশে কোথাও কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। সব মিডিয়ার চক্রান্ত। সব ষড়যন্ত্র।
তবে উন্নতি তো হচ্ছে। আমরা রেকর্ড বইয়ে নাম লেখাচ্ছি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিশ্ব রেকর্ড। একটা না, দুইটা না, ডজন, ডজন।
ফাঁস করুন। ফাঁসাতে থাকুন। জাতির ভবিষ্যতের গলাতেই কষে ফাঁসান।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমঅালো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন