পানি পড়বে না তো কি শরবত পড়বে?
18 June 2017, Sunday
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকার মানুষের দুঃখ-কষ্টের ছবি দেখলাম প্রথম আলোয়। পানি থইথই করছে ঘরের ভেতরে। শোয়ার ঘরে পানি। খাটের পায়া ডোবা। খাটে শুয়ে আছে শিশু। রান্নাঘরে পানি। গ্যাসের চুলা পানির এক হাত নিচে।
এলাকার সাংসদকে প্রথম আলো এই সমস্যা আর তার সমাধানে করণীয় নিয়ে প্রশ্ন করেছিল। মাননীয় সাংসদ উত্তর দিয়েছেন, বৃষ্টি আল্লাহ দেন। কিছুই করার নেই। এবার বৃষ্টি বেশি হয়েছে। জলাবদ্ধতা তো হবেই।
ঘরের মেঝেতে পানি, চুলা পানির নিচে—এই দৃশ্য দেখে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল।
এইখানে ছোটবেলার দুটো স্মৃতি বলি।
রংপুর জিলা স্কুল ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত। স্কুলভবন ছিল খুব পুরোনো। আমরা তখন পড়ি ক্লাস নাইনে। বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ে। আমাদের ক্লাসরুমের মেঝে বৃষ্টির পানিতে ভেসে যায়।
মোস্তাফিজুর রহমান স্যার আমাদের গণিত পড়াতেন। একদিন ক্লাস করছি, ছাদ থেকে পানি পড়ছে।
একজন ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, ছাদ থেকে পানি পড়ছে।
স্যার বললেন, ছাদ থেকে পানি পড়ছে। পানি পড়বে না তো কি শরবত পড়বে?
আরেক দিনের ঘটনা। আমরা সকালবেলা ক্লাসে এসে দেখি, সব বেঞ্চ ওলটানো। আর রাতের বেলা বৃষ্টি পড়ে ক্লাসের মেঝে পানিতে সয়লাব। স্যার এলেন। বললেন, বেঞ্চ কে উল্টিয়ে রেখেছে।
তাহের আলী দাঁড়াল।
তাহের আলী, বেঞ্চ কেন উল্টাইছিস?
স্যার। কাল বিকেলে দেখলাম আকাশে মেঘ। তখন ভাবলাম বৃষ্টি পড়বে। তাইলে বেঞ্চগুলোর ওপরের দিকটা ভিজে যাবে। তাই ভাবলাম বেঞ্চগুলা উল্টায়া রাখি। অন্তত বেঞ্চের ওপরের দিকটা যাতে না ভেজে।
স্যার হেসে বললেন, যা তোকে মাফ করি দিলাম। উকিল তো ভালোই ধরছিস।
কথায় কথা আসে। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্কুলজীবনেও।
প্রথম আলোর সদ্য প্রকাশিত ঈদসংখ্যায় ফজলে লোহানীর লেখা ‘অগ্নিগর্ভ সময়ের সংলাপ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এতে মাওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার আছে। বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারটি ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ১৯৭০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে, দৈনিক ইত্তেফাক–এ।
শেরেবাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী গেছেন গোপালগঞ্জে। সেখানে তাঁরা পরিদর্শন করছেন মিশন স্কুল। পরিদর্শন শেষে তাঁরা ফিরছেন।
‘ঘুরে ঘুরে তাঁরা মিশন স্কুল দেখছেন। হেডমাস্টার ছাত্রদের আগেই তালিম দিয়ে নিয়েছেন। মানপত্র পেশ, সংবর্ধনা সভা। সবই বেশ সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার মাননীয় অভ্যাগতদের ফিরে যাওয়ার পালা।
কয়েকজন ছাত্র সঙ্গে নিয়ে এসে দাঁড়াল একজন ছিপছিপে কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর—মুজিব। মেহমানদের পথ আগলে দাঁড়াল সে।
‘আপনাদের যেতে দেব না এখন’ নির্ভয়ে বলে ওঠে কিশোর ছাত্র।...‘কী করছ মুজিব, সরে দাঁড়াও। দেখছ না অতিথিরা যাবেন এখন’—হেডমাস্টার বলেন।
‘না।’ অস্বীকার অগ্রাহ্যের প্রতীক এই ‘না’।...‘আমাদের হোস্টেলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। আপনারা কথা দিন ছাদ সারিয়ে দেবেন। তারপর এখান থেকে যেতে পারবেন আপনারা।’
এ যে কিশোর ছাত্রের অলঙ্ঘনীয় দাবি। এ দাবি উপেক্ষা করা যায় না।
মন্ত্রী দুজন নীরবে হাসতে থাকেন। দাবি মঞ্জুর।’
ফজলে লোহানী এই বিবরণ লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে, লিখেছেন ১৯৬৯-এর শেষে, ১৯৭০-এর শুরুতে। দৈনিক ইত্তেফাক–এ। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই এ লেখা পড়েছেন। কাজেই এই বিবরণ মুজিবের মুখ থেকেই পাওয়া। আমার লেখা যারা ভোর এনেছিল বইটি বেরোয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেরোনোর আগে। আমার বইয়ে স্কুলের এই ঘটনার বিবরণ আছে। কিন্তু আত্মজীবনীতে এর উল্লেখ না থাকায় মনের মধ্যে একটা খচখচানি ছিল যে এটা কি সত্য নাকি কিংবদন্তি। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় ফজলে লোহানীর লেখা পড়ে আশ্বস্ত হলাম।
হ্যাঁ, কিশোর মুজিব সেদিন অভিন্ন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্য-উন্নয়নমন্ত্রীর কাছ থেকে ঘরের ছাদ চুইয়ে বৃষ্টি পড়া সমস্যার সমাধান আদায় করে নিতে পেরেছিলেন।
কিন্তু যাত্রাবাড়ী-ডেমরাবাসী কি তাঁদের জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান পাবেন?
মাননীয় সাংসদ বলেছেন, কিছুই করার নেই। এবার বৃষ্টি বেশি হয়েছে। জলাবদ্ধতা তো হবেই।
কিন্তু ওয়াসার ইঞ্জিনিয়ার সাংসদের মতো বলেননি কিছুই করার নেই। বরং বলেছেন, দৈনিক ২৮ কোটি ঘনফুট পানি নিষ্কাশনের উপযোগী পাম্প লাগবে। এখন তাঁদের আছে দৈনিক ৪ কোটি ঘনফুট পাম্প করার ব্যবস্থা। তিনি বলছেন, নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
এবার আমরা মাননীয় সাংসদকে বলতে পারি, আপনি যা বলছেন, তা হয়তো পুরোটা সত্য নয়, বৃষ্টি বেশি হলে কিছু করার নেই, এ কথা সত্য নয়। জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে মানুষের করণীয় আছে, আর বেশি বৃষ্টির কারণে মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়াও মানুষের এখতিয়ারে। পবিত্র কোরআন শরিফে আছে, ‘আল্লাহ অবশ্যই কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’
এই যে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামে পাহাড়ধস হচ্ছে, এর পেছনেও আছে মানুষের অপকর্ম। নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ে বসতি স্থাপন, গাছ কাটা, পাহাড়ি গাছের বদলে অর্থকরী গাছ লাগানো এবং অবশ্যই জলবায়ুর পরিবর্তন।
অমর্ত্য সেন একটা কথা বলেন। লেখেন। আনন্দ প্রকাশিত তাঁর উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা বইতেও তিনি এই কথা লিখেছেন। আর তা হলো যে দেশে গণতন্ত্র আছে, বাক্স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কারণ হিসেবে তিনি অনুমান করেছেন, যদি কোনো দেশের কোনো অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমে তা লেখা হবে, আর তা তখন সরকারের দৃষ্টিগোচর হবে, সরকার যেহেতু গণতান্ত্রিক, আগামীবার নির্বাচনের সময় যেহেতু তাকে জনগণের কাছে যেতে হবে ভোট চাইতে, সরকার বাধ্য ওই এলাকায় খাদ্যশস্য পাঠাতে। ফলে দুর্ভিক্ষ হবে না।
এবার আসি অমর্ত্য সেনের তত্ত্বে। সংবাদমাধ্যমে লেখা হলে সরকার ব্যবস্থা নেয়, কারণ তার ভোট দরকার।
কিন্তু যাঁরা বলেন, প্রকৃতির খেয়াল থেকে বাঁচার কোনোই উপায় নেই, মেনে নেওয়া ছাড়া, তাঁরা ভোট পান কীভাবে? নিজের ভোট নিজে পাওয়ার ব্যবস্থা তো তাঁরা ঠিকই করে নেন। তখন আর প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে তাঁরা বসে থাকেন না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন