বাজেট নিয়ে কৌতুক করা উচিত কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি মনীষী-বচন জানি। এখন এই সমাজকে নিয়ে আর কিছুই করার নেই, কৌতুক করা ছাড়া।
কতগুলো কৌতুক আগে বলে নিই। এগুলোর সবই আমি পেয়েছি ইন্টারনেট থেকে, ‘বাজেট জোকস’ গুগল করে।
এক. এক ছিনতাইকারী একটা মুখোশ পরে একজন পথচারীর বুকে একটা রিভলবার ধরে বলল, ‘তোমার সব টাকা আমাকে দিয়ে দাও।’
সুবেশী পথচারী বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে এ রকম করতে পারো না। তুমি জানো না আমি কে।’
‘তুমি কে?’
‘আমি কংগ্রেসম্যান।’
‘তাহলে আমার সব টাকা আমাকে ফিরিয়ে দাও।’
এই কৌতুকটা আমরা এখন পুনর্নির্মাণ করব।
এক ছিনতাইকারী মুখোশ পরে এক সুবেশী পথচারীর গতিরোধ করল। পথচারীর বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে ছিনতাইকারী বলল, ‘তোমার সমস্ত টাকা আমাকে দিয়ে দাও।’
পথচারী বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে এ রকম করতে পারো না। কারণ, আমি একজন এমপি।’
ছিনতাইকারী বলল, ‘চাপা মাইরেন না, ভাইজান। আপনি এমপি নন।’
পথচারী তাঁর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ছিনতাইকারীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘কী করে বুঝলে যে আমি এমপি নই?’
‘ভোটের আগে ছাড়া এমপিদের পা কখনো মাটিতে পড়ে না।’
দুই.
এক জ্ঞানী ব্যক্তি গ্রামে গেলেন। সেখানে এক চাষির একটা সুন্দর ঘোড়া দেখে তাঁর পছন্দ হলো। তিনি বললেন, ‘আমি ঘোড়াটা কিনতে চাই। কত দাম?’
‘পাঁচ হাজার ডলার।’
‘আজ আমার কাছে মাত্র এক শ ডলার আছে। এটা আমি অগ্রিম দিয়ে যাচ্ছি। কাল এসে আমি বাকি ডলার দিয়ে দেব। তখন ঘোড়াটা নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে।’
পরের দিন জ্ঞানী ব্যক্তি টাকা নিয়ে আবার গেলেন চাষির কাছে। চাষি বললেন, ‘খুবই দুঃখের বিষয়, ঘোড়াটা রাতের বেলা মারা গেছে।’
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘তুমি কি ১০০ ডলারের বিনিময়ে মরা ঘোড়া আমাকে দিতে পারো?’
চাষি ভেবে দেখলেন, মরা ঘোড়ার কোনো দাম নেই। তিনি সানন্দে রাজি হলেন।
জ্ঞানী ব্যক্তি মরা ঘোড়া নিয়ে চলে গেলেন।
পরে চাষি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মরা ঘোড়াটা নিয়ে আপনি কী করেছিলেন?’
‘আমি পাঁচ শ ডলার আয় করেছিলাম।’
‘কীভাবে?’
‘আমি লটারির আয়োজন করেছিলাম। পাঁচ ডলার করে টিকিট। প্রথম পুরস্কার একটা ঘোড়া। ১০২টা টিকিট বিক্রি হলো।’
চাষি বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মরা ঘোড়া নিয়ে কেউ আপত্তি করল না?’
জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, ‘মাত্র একজন আপত্তি করেছিলেন। যিনি লটারি জিতেছিলেন। তিনি বললেন, এই ঘোড়া তো মরা।’
আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনাকে ডবল টাকা ফেরত দিচ্ছি। আমি তাঁকে ১০ ডলার ফেরত দিয়ে দিলাম।’
ভারতের এক এমপিকে নিয়ে এই গল্প। তিনি একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনেছেন। সেটা নিয়ে তিনি বের হলেন। রাস্তার ধারে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তিনি নামবেন। একটু হাওয়া খাবেন। যেই না দরজা খুলেছেন, অমনি একটা ট্রাক এসে তার খোলা দরজা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করলেন। পুলিশ এল। তিনি বললেন, ‘দেখুন, একটা ট্রাক কী করেছে, আমার নতুন বিএমডব্লিউ গাড়ির দরজা ভেঙে নিয়ে চলে গেছে।’
পুলিশ তাকিয়ে দেখল ভালো করে। বলল, ‘স্যার, আপনি এই রকম কেন? আপনার গাড়ির দরজা নেই, শুধু এটা দেখছেন। ট্রাকটা যে আপনার হাত উড়িয়ে নিয়ে গেছে, এটা দেখলেন না?’
এমপি সাহেব তখন তাকালেন তাঁর হাতের দিকে। তাঁর একটা হাত নেই। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি কেঁদে উঠলেন, ‘আমার রোলেক্স ঘড়ি, আমার রোলেক্স ঘড়ি!’
এই গল্পটা আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বললাম না। কারণ, তা বিশ্বাসযোগ্য হতো না। বাংলাদেশে বিএমডব্লিউর বিক্রি বেড়েছে, এটা খবরের কাগজেই প্রকাশিত হয়েছে।
রোলেক্স ঘড়ির গায়ে একটা নম্বর থাকে, আর সেটা কোন গ্রাহক কিনেছেন, তাঁর ঠিকানা রোলেক্স সংরক্ষণ করে—সেটাও খুব একটা বাধা নয়।
তাহলে সমস্যা কী? সমস্যা হলো, আমাদের এমপি সাহেবেরা ভারতের এমপি সাহেবদের মতো এত কিপটে নন যে একটা বিএমডব্লিউ কিংবা রোলেক্স হারিয়ে তাঁরা বিলাপ করবেন। তাঁদের ওই রকম বিএমডব্লিউ কিংবা রোলেক্স মেলা আছে। এবং তাঁদের হাত বড়ই লম্বা।
একজন শিক্ষিকা তাঁর ক্লাসে রোজ একটা করে নতুন শব্দ শেখান। বাচ্চারা পরের দিন ওই শব্দ দিয়ে বাক্যরচনা করে নিয়ে আসে।
তিনি শেখালেন, ‘ফ্রুগাল।’
এর মানে হলো, যিনি সেভ করেন। ধরো, বাঁচান, পয়সা বাঁচান। খরচ বাঁচান।
পরের দিন এক ছাত্রী একটা প্যারাগ্রাফ লিখে নিয়ে এল—এক ছিল রাজকন্যা। এক দুষ্টু জাদুকর তাকে বন্দী করে রাখল একটা পাথরের ঘরের মধ্যে। একদিন এক রাজপুত্র সেই ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন রাজকন্যা চিৎকার করে বলল, ফ্রুগাল মি। আমাকে ফ্রুগাল করো।
টাকা দিয়ে ওষুধ কেনা যায়, স্বাস্থ্য নয়।
টাকা দিয়ে বই কেনা যায়, জ্ঞান নয়।
টাকা দিয়ে ভবন কেনা যায়, সংসার নয়।
টাকা দিয়ে বিছানা কেনা যায়, ঘুম নয়।
টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনা যায়, সময় নয়।
টাকা দিয়ে শরীর কেনা যায়, ভালোবাসা নয়।
তাহলে আপনি দেখছেন, টাকা দিয়ে আসল জিনিসগুলোই কেনা যায় না। অর্থই সকল অর্থের মূল। টাকা থাকা মানে ঝামেলা কিনে আনা। সম্পত্তি মানে অশেষ উদ্বেগ। এটা আপনার প্রশান্তি নষ্ট করবে, এটা আপনাকে ঘুমোতে দেবে না। সুখ দেবে না। জীবনকে উপভোগ করতে দেবে না। আমি আপনার বন্ধু। আপনার অশান্তি-কষ্ট আমার ভাগ করে নেওয়া উচিত। প্রিয় বন্ধু, আপনার টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দিন, এই দুঃখ-কষ্ট-অশান্তি-উদ্বেগ আমিই বহন করি। আপনি শান্তি, সুখ, জ্ঞান, ঘুম, ভালোবাসা, সময় নিয়ে শান্তিতে থাকুন। আপনার টাকা মানে সমস্ত উদ্বেগ, হতাশা, প্রেমহীনতা আমিই না হয় বাকি জীবনটা বয়ে বেড়ালাম।
এক বক্তা বলছেন উপস্থিত নাগরিকদের। আপনাদের জন্য একটা সুখবর আছে, আর একটা দুঃসংবাদ। সুখবর হলো, আমরা ভবন নির্মাণের সমস্ত টাকা পেয়ে গেছি। দুঃসংবাদ হলো, সেসব টাকার সবই আপনাদের পকেটে।
একই কথা কিন্তু আমরাও বলতে পারি, মাননীয় বক্তা, আমরা একটা সুন্দর দেশ বানানোর টাকা পেয়ে গেছি, আমাদের সমস্ত টাকা আপনাদের পকেটে (এবং বিদেশি ব্যাংকে)।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন