প্রথম আলোর অনলাইনে খবরটা পড়ে চমকে উঠলাম। রোজ রাতের বেলা ফেসবুক বন্ধ রাখতে চায় সরকার। খবরের পরের লাইনেই অবশ্য আছে, বিটিআরসি সরকারের এ-সংক্রান্ত চিঠির জবাবে বলেছে, রাতের বেলা ফেসবুক বন্ধ করার চিন্তা অবাস্তব। পরের দিন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ফেসবুক বন্ধ করা হচ্ছে না।
ফেসবুক রাতের বেলা বন্ধ হচ্ছে না, এই আশ্বাস পেয়ে বাংলাদেশের দুই কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী হয়তো নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রা দিতে পারবেন। অন্য দিকে ডেইলি স্টার-এ ৬ এপ্রিল ২০১৭-তে ময়ূখ মাহতাব ‘ওপিনিয়ন’ বিভাগে যে প্রশ্নটি তুলেছেন, সেটাও ভাববার মতো। ফেসবুক বন্ধ অবাস্তব, তিনি বেসিসের সভাপতি মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন, মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, সরকার যদি কোনো একটা সময়ে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়, ব্যবহারকারীরা বিকল্প বের করে নেবে, আর বহু আউটসোর্সিং কর্মী এবং ই-বাণিজ্যকর্মীরা রাতের বেলা কাজ করেন—তাঁদের ক্ষতি হবে ইত্যাদি। কিন্তু ময়ূখ মাহতাব বলছেন, এই ধরনের কারিগরি কারণে ফেসবুক বন্ধ করা যাবে কি যাবে না, এটা তো মূল প্রশ্ন নয়, মূল প্রশ্ন হলো, আদৌ এটা বন্ধ করা উচিত কি না। কোনো একটা সাইট বন্ধ করলে বাণিজ্যের কী কী ক্ষতি হবে, এটা প্রধান বিবেচ্য নয়, প্রধান বিবেচ্য হলো, আমরা কোন সাইটে যাব, কখন যাব, সে বিষয়ে সরকার পুলিশগিরি করতে পারে কি না। একই বাক্যে ব্র্যাকেট দিয়ে লেখক বলছেন, অবশ্য সব সময়ই উপযুক্ত ব্যতিক্রম আছে, যেমন শিশু-পর্নোগ্রাফি এবং অস্ত্র বিক্রি। লেখকের মত হলো, মোটের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা একটা মৌলিক স্বাধীনতা, আর তা থেকে নাগরিককে বঞ্চিত করা যায় না।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে টেলিকম মন্ত্রণালয়ে চিঠি গেছে, ফেসবুক শিক্ষার্থীদের রাতের ঘুম এবং দিনের পড়ার ক্ষতি করছে, কাজেই তা রাত ১২টার পর বন্ধ করে দেওয়া যায় কি না, সেটাকেই বা আমরা কম গুরুত্বের সঙ্গে দেখি কী করে। নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের খবরদারি যত কম হয়, ততই মঙ্গল, সেই কথাটাও কর্তাব্যক্তিদের বারবার করে স্মরণ করিয়ে দেব। রাষ্ট্রকে বলব, খবরদার, তুমি খবরদারি করতে এসো না। কিন্তু ভাই-বন্ধুদের বলব, আর বেশি করে বলব নিজেকে, যেকোনো জিনিস ভালো কাজেও ব্যবহার করা যায়, খারাপ কাজেও ব্যবহার করা যায়, অতিরিক্ত যেকোনো কিছুই খারাপ। কাজেই নিজেকে যেন নিজেই গাইড করতে পারি, যতটুকু করলে আমার ভালো, পরিবারের ভালো, সমাজের ভালো, মানুষের ভালো, ততটুকুই যেন করি, পরিমিতি যেন অতিক্রম না করি।
ফেব্রুয়ারি মাসের আগে একটা উপন্যাস লিখতে গিয়ে দেখি কিছুতেই লিখতে পারি না। একটু পরপর ফোন আসে। জরুরি সব খবর। আপনার কোনো বন্ধু অকারণে গ্রেপ্তার হয়েছেন, কিংবা আপনার বন্ধুর ছেলের জন্মদিনে আপনার না গেলেই নয়। আর ফেসবুকেও উত্তেজনাকর সব বিষয় উত্থাপিত হচ্ছে। সেসব নিয়ে স্ট্যাটাস না দিলেই নয়। আর শুধু কি স্ট্যাটাস দিলেই হলো! কী কী মন্তব্য পড়ল, সেসব পড়ে তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া কিংবা পাল্টা দুটো স্ট্যাটাস রচনা না করলেও তো পেটের ভাত হজম হয় না। তখন একটা কাজ করলাম। মোবাইল ফোনের সুইচ দিলাম অফ করে, আর ফেসবুক করলাম ডিঅ্যাক্টিভেটেড। ব্যস। কিছুক্ষণের মধ্যেই জগৎ-সংসার ভুলে নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম একটা মাত্র কাজে—লেখায়। তখনই বোধ করলাম, ফেসবুক বন্ধ করার মতো আরাম আর কিছুতেই নেই। অকারণে বাইরের কোলাহল আমার ঘরে এসে ঢোকে না, আমার চিত্তের শান্তি নষ্ট করে না, আর বই পড়ার অগাধ সময় পাওয়া যায়, স্বজনদের দেওয়ার মতো সময় নিয়েও আর টানাটানি পড়ে না।
ভেবেছিলাম, আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা আর সক্রিয় করবই না। আমার অ্যাডমিনরা আছেন, তাঁরা পেজটা চালাবেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা ছাপা সংস্করণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিউইয়র্কে গিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। ১ হাজার ৪০০ আসনের হল নেওয়া হয়েছে। ইয়র্ক কলেজের এই মিলনায়তনে ফোবানার অনুষ্ঠান হয়েছে। বাংলাদেশের দুই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী গান করেছেন, কিন্তু হল নাকি পূর্ণ হয়নি। ২৬ মার্চ আমাদের অনুষ্ঠান। মহান স্বাধীনতা দিবস। নিউইয়র্ক শহরে একই সময়ে ছোট-বড় ১৬টা বাংলাদেশি অনুষ্ঠান। কাজেই প্রথম আলোর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ তো মানুষকে পৌঁছে দিতে হবে। টাইম স্কয়ারে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোর নিউইয়র্ক ব্যুরোপ্রধান ইব্রাহীম চৌধুরী, নর্দান লাইটস মিডিয়ার সাইফুল সিদ্দিক, ইকবাল আনোয়ার আর আমি ভাবলাম, এখনই তো একটা ফেসবুক লাইভ করে ফেলা যায়। হাতের মোবাইল ফোন তুলে ধরে ক্যামেরা অন করে আরম্ভ করলাম ফেসবুক লাইভ। মুহূর্তেই দাওয়াত পৌঁছে গেল অনেকের কাছে। যোগাযোগের এই রকম একটা জাদুকরি মাধ্যমকে নিশ্চয়ই আমাদের ব্যবহার করতে পারা উচিত। ব্যবহার মানে সদ্ব্যবহারই।
অন্যদিকে ফেসবুক, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সেলফি যে নেশার মতো, তা কখনো কখনো ক্ষতিরও কারণ হচ্ছে, সেসবও আমরা জানি। লেখাপড়ার ক্ষতি, পারিবারিক বন্ধনের ক্ষতি, খেলাধুলা ও কায়িক শ্রম না করার ক্ষতি, নার্সিসিজমের ক্ষতি—এসব নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে বিস্তর, গবেষণাও আছে সুপ্রচুর। অতিরিক্ত সবকিছু খারাপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তিও খারাপ, সে ক্ষতির প্রভাব পড়ে ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক জীবনে, সমাজজীবনে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতগুলো বড় সামাজিক দুর্যোগ দেশে-বিদেশে ঘটিয়েও ফেলেছে। আমরা জানি, রামুতে যে বৌদ্ধমন্দিরে হামলা হয়েছিল, সিলেটে যে মানুষের বাড়িঘরে হামলা হয়েছিল, তার পেছনে ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা ছবির উসকানি। ভারতেও একবার দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছিল এসএমএসের মাধ্যমে। তা বন্ধে ভারত সরকারকে বিশেষ রকমের প্রচারণারও আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
অন্যদিকে আছে খবর আর গুজবকে আলাদা করতে না পারার বিপদ। ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, ফেসবুক ইত্যাদি তথ্যের অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি করেছে। এখন ব্যক্তিমানুষও স্বাধীন। আগে কোনো একটা খবর প্রকাশের জন্য বড় প্রতিষ্ঠানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। একজন ব্যক্তিমানুষ কল্পনাও করতে পারতেন না তাঁর একটা বক্তৃতা টেলিভিশনে লাইভ প্রচারিত হচ্ছে। একজন নতুন কবি একটা কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতেন। শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদের কবিতা কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব বসু প্রকাশ করছেন, তাঁর মাধ্যমে এই কবিরা যেমন স্বীকৃতি পেতেন, তেমনি পেতেন আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা। কিন্তু এখন একজন নবীন কবিও তাঁর কবিতাটা সরাসরি ফেসবুকের টাইমলাইনে লিখে পোস্ট করে দিচ্ছেন। তাঁকে আর কোনো সম্পাদক কিংবা পত্রিকার বিবেচনা কিংবা অনুগ্রহের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। এটা ব্যক্তিমানুষকে আত্মপ্রকাশের এক অভূতপূর্ব সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু এর ফলে ভালো-মন্দ যাচাইয়ের সুযোগও কমে এসেছে। সবচেয়ে বিপদ হয়েছে খবরের ক্ষেত্রে। যে যা দেখছেন, তাই টুইট করছেন, কিংবা স্ট্যাটাস হিসেবে দিচ্ছেন। এর ফলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিবিধান হতে দেখছি। শিশুদের ওপর নির্মম নির্যাতন কিংবা খাদিজার ওপর আক্রমণের ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হওয়ার ফলেই এসব ক্ষেত্রে প্রতিবিধান নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে কোনটা খবর, কোনটা গুজব—আলাদা করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
এবারের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও খবরের চেয়ে গুজব ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে বেশি, সেই কথা আলোচিত হচ্ছে। বড় সংবাদমাধ্যমগুলোও চিন্তায় পড়ে গেছে। সংবাদমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তা কি তার সেই দায়িত্ব পালন করবে, নাকি তা খবর, বিনোদন, ইনফোটেইনমেন্টের একটা খিচুড়ি দিতে থাকবে? ইন্টারনেট নিউজ পোর্টালগুলো দ্রুত হিট বাড়ানোর জন্য চমকদার সব শিরোনাম করছে।
আর আছে কাচের ঘরে বসবাস করার দুঃস্বপ্ন। আপনি কোথায় আছেন, কী করছেন, কী বলছেন, তার সবই প্রায় এখন প্রকাশিত। সেটা কতটা আপনার ইচ্ছাকৃত, কতটা অনিচ্ছাকৃত। এমনকি আমেরিকার মতো দেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নাগরিকের টেলিফোনে আড়ি পাতা আইনসিদ্ধ। বাংলাদেশেও আইন পাস করে টেলিফোনে আইন পাতার অনুমতি কোনো কোনো এজেন্সিকে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আমার মোবাইল ফোন অনুসরণ করে যে কেউ বলে দিতে পারে, আমি এখন কোথায় আছি। হ্যাকাররা আমার ঘরের বন্ধ ল্যাপটপ অন করে ক্যামেরা চালু করে নিয়ে দেখে নিতে পারে ঘরে কী ঘটছে। আর আমরা ফেসবুকে, ই-মেইলে, ইন্টারনেটে কখন কী করছি, যত গোপনীয়তার সঙ্গেই তা করি না কেন, কোথাও না কোথাও তা জমা হয়ে থাকছেই। এর বাইরে প্রকাশ্যে আমরা যে স্ট্যাটাস দিই, ছবি দিই, সেসব বিশ্লেষণ করে আমার মত, আমার মনোভাব, আমার অভিপ্রায় বের করে ফেলতে পারে যে কেউ। মাঝেমধ্যে সাবধানবাণী প্রচারিত হয় ফেসবুকেই, আপনার অবস্থান, ছবি সব সময় প্রকাশ করবেন না, অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের জন্য এসব ব্যবহার করতে পারে। তার মানে আমি বসবাস করছি কাচের ঘরে। মিলান কুন্ডেরা কাফকার উপন্যাস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দ্য আর্ট অব দ্য নভেল-এ বলেছিলেন, জোসেফ কে-র ঘরে দুজন লোক ঢুকে পড়েছে, এই যে তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ হলো, এটাই কাফকায়েস্ক দুঃস্বপ্নের প্রধান দিক।
তাহলে আমরা কী করব? নিষেধাজ্ঞা আরোপ করব? সংবাদমাধ্যম বিনোদন, গুজব, খবর, ইনফোটেইনমেন্টে মসলা বাড়িয়ে দেবে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সদ্য প্রকাশিত কারাগারের রোজনামচা বইয়ের একটা জায়গায় সেই চিরসত্য উপলব্ধিটা আছে। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছিল আওয়ামী লীগের হরতাল। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে, নির্জন সেলে। গুলি হয়েছে, মোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর সরকার স্বীকার করেছে। আসলে কতজন মারা গেছে, জানা যাচ্ছে না। কারণ, সব কাগজের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এ-সংক্রান্ত খবর ছাপা যাবে না। একসময় জেলে বসেই বঙ্গবন্ধু শুনতে পেলেন, শত শত লোক মারা গেছে। বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি, এটা হলো সত্য প্রকাশ করতে না দেওয়ার ফল। এখন গুজব ছড়াচ্ছে। তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। আর অক্সফোর্ড প্রকাশিত জার্নালিজম বইয়ে আইয়ান হারগ্রিভস বলছেন, এটা হচ্ছে একদিকে নেটওয়ার্কের যুগ, অন্যদিকে ভাইরাসের যুগ। এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একটাই দাওয়াই—তা হলো, নির্ভরযোগ্য, নির্ভুল, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা।
কাজেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়, সত্যের অবাধ প্রকাশের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই আমরা যুগের হুজুগে সৃষ্ট বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন