আজ পরম গুরু পীরে কামেল হজরত শাহ সুফি সামান পীরের ওফাত দিবস। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে আমরা যেমনি স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, যুদ্ধের মাঝে জুলাইর শেষের দিকে তেমনি ওলি-এ-কামেল শাহ সুফি সামানউল্যাহকে পেয়েছিলাম। এক বিরল অভাবনীয় সাধক পুরুষ। ধর্মীয় ক্ষেত্রে হুজুর মওলানা ভাসানী ছাড়া আর কারও মধ্যে অমন অগাধ জ্ঞান দেখিনি। শুনেছি হতেয়া রাজারবাড়ির এক গভীর জঙ্গলে ১২ বছর ধ্যানমগ্ন থেকে সাধনা করেছেন, আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমিও তার দ্বারা প্রচুর লাভবান হয়েছি। আগে আমি কোরআনের কিছুই জানতাম না। যুদ্ধের অবসরে কোরআনের যেসব আয়াত ব্যাখ্যা করেছেন এখন আল কোরআনের পাতা ওল্টালেই তার সেই জ্ঞান আমাকে আলোড়িত করে। কোরআন একেবারেই সহজ মনে হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় আমরা বড় হয়েছি। যে কারণে ইংরেজির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। বিশেষ করে আমার একেবারেই ছিল না। কিন্তু ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে একসময় কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান আমার জন্য জেনারেল গিয়াফের, ‘Other side of the hill’ নামে একটি বই কলকাতা থেকে পাঠিয়েছিলেন। জঙ্গলে ছনের ঘরে রাত কাটাতাম, মাথার কাছেই বইটি পড়ে ছিল অনেকদিন। ২-১ বার হাতে নিলেও যেহেতু ইংরেজি ভালো পড়তে পারি না, সেহেতু কষ্ট করে দু-এক পাতা পড়তাম এবং বোঝার চেষ্টা করতাম। এভাবেই পড়ে ছিল ৮-১০ মাস। তখন আমাদের চরম দুর্দিন। মোরারজি দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমাদের লোকজনদের জিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই সময় এক রাতে ঘুম আসছিল না। রাত দুই-আড়াইটার সময় আমাকে যারা দেখাশোনা করত তাদের মধ্যে বাবুল তালুকদারকে বলেছিলাম, বাতি জ্বালিয়ে দাও। হঠাৎই কেন যেন জেনারেল গিয়াফের সেই অমূল্য বইটি হাতে নিয়েছিলাম। ৭০০ পৃষ্ঠার সে বইটি বিশ্বের এক অমূল্য সম্পদ। তিন-সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার দিকে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। কষ্ট করে পড়তে শুরু করেছিলাম। বিদেশি বই যে এত সহজভাবে লেখা হয় জানতাম না, বলতে গেলে বাংলার মতো। অনেক কষ্ট করে ৩-৪ পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে আজান পড়ে গিয়েছিল। কষ্টে থাকলে আপনজন সন্তান-সন্ততির কথা যেমন মনে হয় তেমনি দয়াময় আল্লাহর জন্য প্রাণ কাঁদে। নামাজ আদায় করে আবার বইটি হাতে নিয়েছিলাম। হঠাৎই মনে হলো আমাদের তখন যে অবস্থা বইটিতে কীভাবে যেন তারই এক নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ভীষণ কষ্টের মধ্যে মারাত্মক চাপাচাপি চারিদিকে দুই ব্রিগেড ভারতীয় সৈন্য দিয়ে আমাদের ক্যাম্প ঘিরে রাখার পরও সাত দিনে বইটির দুই-আড়াই শ পৃষ্ঠা পড়েছিলাম। বইটি রাতদিন পড়েছি। শতবার পড়েছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল পুরো বই আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। তিন-চার বছর আগে কদরের রাতে টাঙ্গাইলে ছিলাম। রাত ১০টার দিকে জায়নামাজে বসে কোরআন পড়তে ইচ্ছা করছিল। বইয়ের আলমারিতে দেখি কোনো বাংলা কোরআন নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা বাংলা কোরআন পেলাম না। অথচ ৫০টা কোরআন থাকার কথা। কতজন কতভাবে আমাকে কোরআন উপহার দেন। কিন্তু সেদিন টাঙ্গাইলে একটিও পেলাম না। সৌদি আরব অ্যাম্বাসির দাওয়াতে যতবার গেছি ততবারই তারা আরবি আর ইংরেজি অনুবাদের কোরআন শরিফ দিয়েছেন। তার বেশ কয়েকটি ছিল। একটা নিয়ে বসেছিলাম। পড়তে গিয়ে চমৎকার লাগল। প্রথমেই সূরা কদর পড়ে নিয়েছিলাম। ইংরেজি আর বাংলার পার্থক্য মনে হলো না। তারপর সূরা ফাতিহা থেকে সূরা বাকারার ২৮৬ আয়াত কোথা দিয়ে শেষ করেছিলাম বুঝতে পারিনি। অর্থগুলো ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আর সেই তখন মহাজ্ঞানী সাধক শাহ সুফি সামানউল্যাহর কথা মনে পড়ছিল। স্বাধীনতার পর আমি যেমন তার ভক্ত ছিলাম, তিনিও আমার অনুরক্ত ছিলেন। সবাই আমাকে বলে বঙ্গবীর, সাধক মানুষ তিনি বলতেন ‘বঙ্গপীর’। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে সামান ফকিরকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এখন যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থাকেন এই বাড়িতেই। সামান ফকিরকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর থেকেই চিনতেন। টাঙ্গাইলে তার হাতে অস্ত্র দেওয়া থেকে শুরু করে অনেকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেদিন তিনি অভাবনীয় কা- ঘটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু থেকে ৪-৫ হাত দূরে বসেছিলেন সামান ফকির। আমি তার পাশে ছিলাম। একপর্যায়ে আমাকে ঠেলা দিয়ে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কই। আমি তো বঙ্গবন্ধু দেখি না।’ সামান ফকির গলগল করে কথা বলতেন। তার কথা শুনেই বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘এই যে আমি। আমাকে দেখছেন না।’ এই বলে তার সিট থেকে উঠে সামান ফকিরকে বুকে চেপে বলেছিলেন, ‘এই যে আমি। আপনি কেন আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না বলছেন!’ সামান ফকির খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো বঙ্গবন্ধু দেখি না। আমি না দেখলেও কি মিথ্যা বলব।’ পাগলের কথায় সেদিন অনেকেই হেসেছিল। আমি হেসেছিলাম কিনা বলতে পারব না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হা-হা করে হেসেছিলেন। এর ৬০-৬২ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা আমাদের চোখে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। কিন্তু ওলি-এ-কামেল সামানউল্যাহ ৬০-৬২ দিন আগে তার রুহানি চোখে বঙ্গবন্ধুকে দেখেননি। কত আধ্যাত্মিক এলেম থাকলে মানুষ এমন হয়। তিনি তার মৃত্যুর দিনক্ষণ আমাকে বলেছিলেন। তক্তারচালার নবীনের কাছে তার কবরের জন্য জায়গা চেয়ে ছটফট করতেন। আমি তাকে অনুরোধ করার এক দিন পর নবীন তার নামে জমি দলিল করে দিয়েছিলেন। তার দুই দিন পর তিনি সেখানে শয্যা নিয়েছিলেন। কত বড় আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হলে এমন করে মৃত্যুর দিনক্ষণ ঠিক করে দলিল করা জায়গায় শেষ শয্যা নিয়ে পরপারে যেতে পারেন! সেই ওলি-এ-কামেলের আজ ওফাত দিবস বা তিরোধান দিবস। আমরা তার ভক্তবৃন্দ তার অনুসারীরা দয়াময় প্রভুর কাছে কায়মনে প্রার্থনা করি, তাকে যেন বেহেশতের অতি সুন্দর স্থানে দয়া করে স্থান দেন।
এক দুই করে ধীরে ধীরে জীবন শেষ হতে চলল। কত ঝড়-ঝঞ্ঝা-ঘূর্ণি পার করলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ’৭১-এর ২৫ মার্চ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের অতর্কিত ঝাপিয়ে পড়া। যেহেতু আমরা মফস্বল শহরে ছিলাম তাই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণ তেমন স্পর্শ করেনি। হানাদারদের কাছে টাঙ্গাইলের পতন হয়েছিল ৩ এপ্রিল, ১৯৭১। আর আমাদের কাছে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় ১১ ডিসেম্বর। তাই যে কোনো জয়-পরাজয় খুবই ক্ষণস্থায়ী। আর অন্যায় জয়ের তো কোনো স্থায়িত্বই নেই। পরের বিপর্যয় বঙ্গবন্ধু হত্যা। পৃথিবীতে রাষ্ট্র নিয়ে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে অনেক দাঙ্গা-ফেসাদ হয়েছে, অনেক হত্যা হয়েছে। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মানব ইতিহাসে জিঘাংসার সবচাইতে বড় নজির। ১৪ তারিখ রাতেও যারা বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বলে মুখে ফেনা তুলত ১৫ তারিখ সকালে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। আজ আওয়ামী বীরেরা যে যত কথাই বলুন ওই মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবার-পরিজনকে মৃত্যুর মুখে রেখে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে না তুললে আজ যারা বীরদর্পী তারা মাটির ওপরে নয়, নিচে থাকতেন। সারা দুনিয়ার মানুষ মনে করত শেখ মুজিব খুবই অপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন তাই কোনো প্রতিবাদ হয়নি। শত্র“র কথাই সত্য হতো। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম, যারা সঙ্গী হয়েছিল তাদের অনেকেই এখন আর দুনিয়ায় নেই, না-ফেরার দেশে চলে গেছে। তাই কিছুদিন থেকেই মনে হয়েছিল চরম দুঃসময়ে চরম কষ্ট স্বীকার করে যারা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল তাদের সঙ্গে একবার কথা বলি, দেখা করি। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাক্ষাতের সময় চেয়েছিলাম। কদিন যাওয়ার পর জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সময় পাওয়া যাবে কি যাবে না। যে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী সব সময় অসম্ভব ব্যস্ত থাকেন। কেউ মানুক আর না মানুক আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ব্যস্ত। এর মধ্যে আবার এক সপ্তাহের জন্য জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। আমরা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ১৪ অক্টোবর জাতীয় মুক্তিবাহিনীর মহান প্রতিরোধ যোদ্ধাদের এক আলোচনা ও মতবিনিময় সভার আহ্বান করেছিলাম। বেশ কয়েকবার সময় চেয়ে না পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৩ অক্টোবর চিঠি দিয়েছি, ‘৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের ১৪ তারিখ এক সভার আহ্বান করেছি। সে সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার সঙ্গে কথা বলা নৈতিক কর্তব্য মনে করি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতি আপনার অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি আমার প্রতিও।’ সঙ্গে সঙ্গে আরও লিখেছি, ‘যদি নিতান্তই সময় দিতে অসুবিধা হয় ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের প্রতি কোনো পরামর্শ বা কোনো কথা থাকলে জানাবেন।’ গত দু-তিন দিন থেকে মনে হচ্ছে ১৪ তারিখে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ’৭৫-এর যোদ্ধাদের নিয়ে বসতে গিয়ে ৩ অক্টোবর সময় চেয়ে চিঠি দিয়ে সাক্ষাৎ পাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। সময়ের হিসাবটা একটু তড়িঘড়ি হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য ১৪ তারিখের সেই ঐতিহাসিক মহামিলনের দিন ২৮ অক্টোবরে স্থির করেছি। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মতামত পেলে ধন্য হব। আর না পেলে কী করার আছে। আমরা তো জননেত্রী শেখ হাসিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হবেন এটা জেনে প্রতিবাদ করিনি। আমরা জাতির পিতাকে হত্যা জঘন্যতম অপরাধ বিবেচনা করে প্রতিবাদ করেছি। তাই কিছু কিছু জায়গায় নিজে গিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সম্মান জানানোসহ আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলাম। সেই হিসেবে ৬ অক্টোবর সকাল ৭টায় টাঙ্গাইল থেকে রওনা হয়ে প্রথমে শেরপুর সার্কিট হাউসে। গাড়ি থেকে নেমে সার্কিট হাউসের বারান্দায় এক অভাবনীয় পরিবেশ দেখলাম। আমাদের কয়েক কর্মী ডাইনিং রুমে বসে ছিল। তাদের জন্য নিচের ড্রয়িং রুমও খোলা হয়নি। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন ড্রেস পরা খাদেম বললেন, ‘উন্নয়ন মেলা হচ্ছে। সব রুম বুক।’ ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে গেছি। ওয়াশ রুমে যাওয়া দরকার। বললাম, বাথরুমে যাব। এদিক-ওদিক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। এরপর কে বা কার ফোন পেয়ে ড্রয়িং রুম খুলে দিল। পেশাব করার প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই এখনো আমার পেশাব-পায়খানায় তেমন কোনো কষ্ট নেই। আমার বয়সে অনেকে বিছানা নষ্ট করে। আমার পেশাব করার ইচ্ছা হলে পেশাব করতে হয়। আগের মতো অনেক সময় চেপে রাখতে পারি না। এ রকম মনে হয় বেশি বয়সে কমবেশি সবারই হয়। পেশাব করে ড্রয়িং রুমে বসে ছিলাম। ১০টার কম এসি হবে না আস্তে আস্তে সবকটি চালু করে দিল। মিনিট ১৫ পর মনে হলো যেন হিমাগারে আছি। আমি বসে যখন কথা বলছিলাম তখন এনডিসি পিয়নকে ফোন করেছিলেন। ওপরের নির্দেশ ড্রয়িং রুমেও বসতে দেওয়া যাবে না। ড্রয়িং রুম যে খুলে দেওয়া হয়েছে সেটাও ভুল হয়েছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওপরের নির্দেশ কত ওপরের। লোকটি কাচুমাচু হয়ে বলছিল, ‘পিয়ন মানুষ, কত ওপরে তার আমরা কী জানি। এনডিসি সাহেব বলেছেন অনেক ওপরে।’ কদিন আগে চিঠি দিয়েছি। থাকার জায়গা না হলে, দিতে না পারলে যোগাযোগ করতেন। তাও করেননি। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল। তার মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও একটি। কদিন পরই নির্বাচন। একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতিকে যদি সার্কিট হাউস ব্যবহার করতে না দেওয়া হয় তাহলে আর নিরপেক্ষ নির্বাচন কী হবে। সবাই বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ। আমি তো একজন মুক্তিযোদ্ধাও। বেসামরিক বাঙালি হিসেবে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরউত্তম’প্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিমানবন্দর, সরকারি অতিথিশালা সবকিছুতে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে এমন নির্দেশ থাকার পরও যদি ওপরের নির্দেশে এ রকম করা হয় তাহলে দেশের কী হবে। ১০ বার ফোন করেও ডিসি আনারকলি মাহবুবকে পাইনি। ছেলে বাবা-মাকে ভাত দেয় না। প্রবঞ্চনা করে জমিজমা লিখে নিয়ে মা-বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে পত্রিকায় খবর দেখে ফরিদপুরের মধুখালীতে গিয়েছিলাম। খেয়েছিলাম ফরিদপুর সার্কিট হাউসে। ফরিদপুরের ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়াকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তার আচার-ব্যবহার লোকাচার কোনো কিছুতে খুঁত দেখিনি। তার স্বামী গোপালগঞ্জের ডিসি। এই চার-পাঁচ মাস আগে সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে এক উপসচিবের সঙ্গে দেখা। কী নিয়ে ফরিদপুরের ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়ার কথা উঠেছিল। তিনি তার এমন প্রশংসা করলেন আমি বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া আর কাউকে অমন প্রশংসা করতে শুনিনি। কিন্তু শেরপুরের ডিসি আনারকলি মাহবুবকে তো পেলামই না, ভালোমন্দ কী বলি। বাংলাদেশ খুব ছোট দেশ। লোকসংখ্যা যদিও অনেক। তবে কোনো কিছু জানতে সময় লাগে না। শেরপুরে মারাত্মক রাজনৈতিক উত্তেজনা। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস বা ব্রহ্মপুত্রে ডুবিয়ে মারতে কাউকে লাগবে না আওয়ামী লীগই যথেষ্ট। হর্তাকর্তা-বিধাতা মাননীয় মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। কিছুদিন আগে শেরপুর সদরের এমপি এবং শেরপুরের সভাপতি আতিউর রহমান আতিক বেগম মতিয়া চৌধুরী, শফিকুল ইসলাম জিন্নাসহ বেশ কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছেন। জেলা কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাক বা না থাক একে ওকে দিয়ে মতিয়া চৌধুরীও আতিক গ্র“পের কয়েকজনকে পাল্টা বহিষ্কার করেছেন। এ তো গেল জেলা। নালিতাবাড়ী-নকলা দুই উপজেলা নিয়ে মতিয়া চৌধুরীর আসন। একপাশে বদি, অন্যপাশে হালিম। সত্যিকারের ভোট হলে মতিয়া চৌধুরী ৫-৭ হাজারের বেশি পাবেন না। তার পরও খুঁটার জোরে পাঁঠা কোঁদে ভদ্র মহিলা তেমন কুঁদে চলেছেন। এ যাত্রায় বেরিয়েছিলাম ’৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের সম্মান জানাতে, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ করতে। নালিতাবাড়ীর অগ্রদূত সংঘের ১১ জন এক বিকালে বারোমারী ক্যাম্পে হাজির হয়েছিল। যুবকগুলো খেলাধুলা করত, শরীরচর্চা করত, সর্বোপরি ছাত্রলীগ করত। বড় ভালো লেগেছিল। সেখানে হায়দার ছিল, সঞ্জিত কুমার পাল (পাইলট) বিক্রমপুরের ছেলে। বোনের বিয়ে হয়েছিল নালিতাবাড়ী। বোনের টানে নালিতাবাড়ী এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। ছিল জসিম, গৌরাঙ্গ আরও যেন কে কে। যে সময় আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ করছিলাম সে সময় জিয়াউর রহমান খাল কাটা কর্মসূচি করছিলেন। শম্ভুগঞ্জে স্বেচ্ছাশ্রমে বেশ অনেকদিন মাটি কাটা হয়েছে। যার শুভ উদ্বোধন করেছিলেন জিয়াউর রহমান নিজে। সেখানে তিনি দু-তিনবার গেছেন। সেই খাল কাটায় বেগম মতিয়া চৌধুরী পাঁচ-সাত বার অংশ নিয়েছেন। বেশি বেশি যাতে কোদাল হাতে লোক হয় সেজন্য বড় বড় শিল্পী এনে বিচিত্রা অনুষ্ঠান করা হতো। সারা দিন গান-বাজনা বক্তৃতা চলত। সেখানে বেশ কয়েকবার বর্তমান মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অংশ নিয়েছেন, জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছেন। এসব শুধু আমার কথা নয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদীপের কথা, ড. রাজ্জাকের কথা। আমরা যখন জাতির পিতার মৃত্যুযন্ত্রণায় জ্বলছি তখন বেগম মতিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করে আমাদের জ্বালা শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে কি আওয়ামী লীগের স্বার্থে কাউকে বর্জন কাউকে গ্রহণ করতে একটুও বাধে না?
ঠিক সাড়ে ১১টায় নালিতাবাড়ী গিয়েছিলাম। প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সেক্রেটারি আরও কয়েকজন বেশ সমাদর করেছেন। কিন্তু সবার মধ্যে একটি আতঙ্কÑ মন্ত্রী আতঙ্ক। সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছিল। ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বলে বুঝলাম মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেমন টানাটানি কাড়াকাড়ি, টাকা নিয়ে এটাওটা করা, ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের নিয়েও তেমন কাড়াকাড়ি চলছে। কেউ কেউ তালিকা করছে প্রধানমন্ত্রীকে এটাওটা বুঝিয়ে কিছু কিছু বরাদ্দ নিচ্ছে, কিছু দিচ্ছে কিছু পেট ভারী করছে। এর আগে আবার কয়েকজন গরুর খামার, ছাগলের খামার, মহিষের খামার এসব করে টাকা নিয়েছেন। এটা নালিতাবাড়ীতেই বেশি। অন্যখানে তেমন প্রভাব নেই। দুপুরে গিয়েছিলাম হালুয়াঘাটের আবদুস সালামের বাড়ি। সালাম এক বিচিত্র মানুষ। আল্লাহ কাউকে দয়া করলে কেউ আটকাতে পারে না। ’৭৫-এ যেমন প্রতিরোধ সংগ্রামে ছিল ঠিক তেমনি জননেত্রী দেশে ফেরার পর তিনি কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মী চেয়েছিলেন। আমি তখন তাকে গোপালগঞ্জের বিজন কুমার সাহা, হালুয়াঘাটের আয়নাল, সালাম আরও ১০-১২ জনকে দিয়েছিলাম। ধানমন্ডির ৩২-এর বাড়ি বিজন দেখাশুনা করেছে আট-নয় বছর। সালামও ছিল সাত বছর। ওর আগে ভারতেও সালাম আমাকে দুই বছর দেখাশোনা করেছে। একসময় খুব আর্থিক কষ্টে কান্নাকাটি করছিল। আমার হাতে কখনো বেশি টাকা থাকে না। যা সামান্য ছিল হাতে দিয়ে বলেছিলাম সৎ পথে চেষ্টা কর। আল্লাহ নিশ্চয়ই দয়া করবেন। সত্যিই আল্লাহ সালামকে দয়া করেছেন। সত্যিই সে পরিশ্রম করে খায়। ’৭৫-এর কত বড় বড় কমান্ডার হালুয়াঘাটে যাদের বাড়ি তারা কেউ আওয়ামী লীগ করে, কেউ বিএনপি করে। এখন কেউ কেউ প্রতিরোধ সংগ্রামী বলতেও চায় না। কেউ কেউ তো মনে করে তারাই সব। শ চারেক লোকের জন্য নাকি লাখখানি করে টাকার থোক বরাদ্দ পাওয়া গেছে। জাতীয় মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ সংগ্রামী ছিল প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। বুঝতে পারি না ৪০০-এর তালিকা হয় কী করে। দেশে ফটকাবাজের অভাব নেই। যে যেদিকে পারে যাকে বেঁচে যাকে মেরে নিজে বাঁচতে পারে সেটাই ধান্ধা। সালামের বাড়ির দুপুরের খাবার ছিল অপূর্ব। আমি মাংসটাংস খাই না। শাক-সবজি-মাছ-ভর্তা খাই। তাই ছিল সালামের ব্যবস্থা। ৪টায় প্রতিরোধ সংগ্রামীদের বৈঠক। আমি ৪টা ১ মিনিটে সেখানে পৌঁছেছিলাম। জেলা পরিষদের ছোট্ট ঘর। কত হবে ঠাসাঠাসি করে ৮০-৯০ জন বসা যায়। বাইরে বারান্দায়ও হয়তো আরও ৫০ জন। সব ছিল ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামী। তাদের ২৮ তারিখ ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। যাদের টাকাপয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের কোনো অসুবিধা হলে অংশ নিতে বারণ করেছি। যাদের আগ্রহ আছে তাদের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেছি। তারা সবাই কথা দিয়েছে ’৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের কোনো দলমত নেই, তারা ঢাকা যাবে।
লেখক : রাজনীতিক
উৎসঃ বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন