তুফান ও নূর হোসেন বনাম গণতন্ত্র ও সুশাসন
19 August 2017, Saturday
এখানে প্রসঙ্গ দুটি। কিন্তু মূলকথা এক- গণতন্ত্র ও সুশাসন। নিরীহ নিরপরাধ একটি মেয়েকে বগুড়ার কুখ্যাত সন্ত্রাসী তুফান সরকার বলপূর্বক ধর্ষণ করেছে। এতেই সে ক্ষান্ত হয়নি বরং ধর্ষিতা ও তার মায়ের চুল কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছে। তুফানের স্ত্রী, স্ত্রীর কাউন্সিলর বোন এবং আরও তিন সহযোগী মিলে এ পাশবিক কাণ্ডটি ঘটিয়েছে।
তুফান একজন শ্রমিক লীগ নেতা আর তার বড় ভাই মতিন যুবলীগ নেতা। খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের মতো ছয়টি মামলার প্রধান আসামি এ তুফান সরকার। ২০১২ সাল থেকে সে উপরোক্ত মামলাগুলোর আসামি। একবার সে গ্রেফতারও হয়েছিল। কিন্তু জামিন পেতে দেরি হয়নি। কারণ তার পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন দলের হোমরাচোমরাদের সমর্থন ও সহযোগিতা।
বিনিময়ে নেতারা ভালো অঙ্কের অর্থ পেয়েছিল। বগুড়ায় প্রচার রয়েছে- তুফান নিয়মিত টাকা দিত রাজনৈতিক নেতাদের এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যকে।
মাধ্যমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়ার পর তুফান বড় ভাই যুবলীগ নেতা মতিনের সহযোগিতা এবং সমর্থনে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের ব্যবসায় নেমে পড়ে। হয়ে দাঁড়ায় বগুড়ার এক নম্বরের মাদক ব্যবসায়ী। তারপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চাঁদাবাজি হয়ে দাঁড়ায় তার আরেকটি বড় ব্যবসা। তুফানকে চাঁদা না দিয়ে বগুড়া শহরে ইজিবাইক, অটোরিকশা, রিকশা, ট্রাক এবং বাসের মতো যানবাহন কেউ চালাতে পারেনি। এসব যানবাহনের নানারকম চাঁদার একটি তালিকা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী জানতে পেরেছে। ক্রমেই বগুড়া শহরের অপরাধ জগতের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠে তুফান।
জানা যায়, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তারা তুফানের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানত। একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা এবং নিজে ও ক্যাডারদের অসংখ্য সন্ত্রাসী ঘটনার কথা শহরের কারও অজানা ছিল না। কিন্তু প্রশাসনের নীরবতা এবং সরকারি দলের কিছু নেতানেত্রীর সহযোগিতার কারণে সাধারণ মানুষ তার সন্ত্রাসকে নীরবে, নিরুপায়ভাবে মেনে নিয়েছিল। দেখা যায়, সে সন্ত্রাসের পথে কোটি কোটি টাকা এবং অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। বগুড়ায় উপচে পড়া টাকা সামাল দিতে না পেরে রাজধানী ঢাকায় সে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটও কেনে।
সেই বিএনপি আমল থেকে দেশের নানা জায়গায় এ ধরনের কিছু মাস্তান-সন্ত্রাসীর উত্থান ও লুটপাটের কাহিনী শোনা যায়। এদের একটি বৈশিষ্ট্য হল, এরা ক্ষমতাসীন দল বা দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী থাকে এবং মূল দলের দু-একজন বড় নেতা এদের গডফাদার বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে। সন্ত্রাস দ্বারা অর্জিত টাকার একটি অংশ গডফাদাররাও পায়। অন্য একটি অংশ প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু লোকজনও পেয়ে থাকে বলে শোনা যায়।
তুফানের মতো একই কাজ নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেনও করেছিল। একসময়ের ট্রাকের হেলপার নূর হোসেনও সন্ত্রাসের পথে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছিল। সেও সরকারি দলের সদস্য সেজেছিল। তারও গডফাদার ছিল শহরের এক নামকরা মাস্তান। এতই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল নূর হোসেন, শেষ পর্যন্ত ৭ খুনের হোতা হয়ে দাঁড়ায়। ছয় কোটি টাকায় কিনে নেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছুসংখ্যক লোকজনকে।
তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় খুন হয় সাত-সাতটি নিরপরাধ মানুষ। আগেই বলা হয়েছে, অপরাধী, রাজনীতিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে দেশের নানা জায়গায় ক্ষুদ্র অথচ ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র গড়ে উঠতে দেখা যায়, যা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দেখা যায়, তুফানের মতো বড় ধরনের অপকর্ম করলে যখন দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তখন দল তাদের বহিষ্কার করে। মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নিন্দা জানাতে উচ্চকণ্ঠ হয়ে ওঠে। লোক দেখানো এ প্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাসীর কী ক্ষতি হয়, তার অপরাধ কতটা লাঘব হয়, দলের ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন হয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তদের অপরাধের পরও ব্যক্ত করা হয়। ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের বহিষ্কার করা হয়।
প্রশ্ন হল, তুফান এবং নূর হোসেন-জাতীয় সন্ত্রাসীরা শাসক দলের লেবাস ধারণ করে কেন? উত্তর সহজ। মনে করার কারণ আছে- তাদের আশা এবং বিশ্বাস হল, সরকারি প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না। ইতিমধ্যে তারা সরকারি দলের দু-একজন গডফাদার বা মুরব্বি পেয়ে যায়।
দেশের শিক্ষিত-সচেতন মানুষের অনেকেই জানেন, সব সরকারের আমলেই সরকারি দলের কিছু নেতা সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় এবং নিজেরাও দুর্নীতির চর্চা করে। দেশ ও মানুষের জন্য রাজনীতি করে স্বল্পসংখ্যক মানুষ। নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং ক্ষমতা অর্জনই থাকে অধিকাংশের মূল লক্ষ্য। জনগণের সেবকের বিপরীতে তারা হতে চায় শাসক। রাষ্ট্রে জনগণের ক্ষমতা বৃদ্ধি তথা গণতন্ত্রের উন্নয়ন তাদের লক্ষ্য বললে ভুল হবে।
বর্তমানে এত যে নির্বাচনের ব্যাপারে হৈচৈ শুনি, তা দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের পাঁয়তারা মাত্র। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় দলগুলোর নির্বাচনের ব্যাপারে ব্যস্ততা হল, তাদের তথা দলের ক্ষমতা অর্জনের জন্য। তাতে দলের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় মাত্র, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।
সামরিক শাসকরা বন্দুকের বলে ক্ষমতা দখল করে। আর বেসামরিক শাসকরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। সে ভোটও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক, তা তারা তখনই চায়, যখন বিরোধী দলে থাকে। ক্ষমতা অর্জনের পর তারা সে ক্ষমতা খুব কমই জনগণের মঙ্গল এবং মুক্তির জন্য ব্যবহার করে। নিজেদের মঙ্গল এবং মুক্তিই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এ অপরাজনীতির ফসলই হল বগুড়ার তুফান এবং নারায়ণগঞ্জের নূর হোসেন।
তবে সবাইকে এক পাল্লায় পরিমাপ করা ঠিক হবে না। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ব্যাপারে শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু একা শেখ হাসিনা এবং তার স্বল্পসংখ্যক নেতা-মন্ত্রী যা বিশ্বাস করেন- তা অন্যসব নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না। করলে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনের এমন দুর্দশা ঘটত না।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে যেসব পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য করেছেন, তা উল্লেখ করা দরকার। কারণ এগুলো দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতির প্রমাণই তুলে ধরে। রায়ের কয়েকটি প্রধান বক্তব্য হচ্ছে- ১. রাজনীতি এখন আর মুক্ত নয়। এটা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ২. ক্ষমতার লোভ এখন প্লেগ রোগের মতো বিস্তার লাভ করেছে। ৩. ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার মতো কোনো নজরদারি প্রতিষ্ঠান (ওয়াচ ডগ) নেই। ৪. দুর্নীতি অবাধ এবং সর্বত্র বিরাজমান। ৫. এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা বাস করি, যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখেন না।
উপরোক্ত পর্যবেক্ষণগুলো যে বাস্তবে কত সত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত এসবের সম্মিলিত ফসল হচ্ছে একটি দুর্বৃত্তপীড়িত সমাজ, অকার্যকর রাষ্ট্র এবং দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন। আর এ ধরনের রাষ্ট্র এবং সমাজেই নূর হোসেন ও তুফানের মতো লোকজনের উত্থান ঘটে। ফলে নারায়ণগঞ্জে নিরীহ নিরপরাধ ৭ জন মানুষ খুন হয়।
আর বগুড়ায় একটি নিষ্পাপ কলেজছাত্রীর সম্ভ্রমহানি হয়। তারপর নির্যাতিতা ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। এভাবে দেশের নানা জায়গায় বিচারের বাণীকে নীরবে-নিভৃতে কাঁদতে দেখা যায়। এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্র ও সুশাসনকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। গণতন্ত্র এবং সুশাসন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিছু রাজনীতিকদের মুখে অহরহ যে গণতন্ত্রের কথা শোনা যায়, বাস্তবে তা একেবারেই হাস্যকর মনে হয়।
মো. মইনুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন