জঙ্গিবাদী তৎপরতা ও প্রতিরোধের পরিষ্কার চিত্র জানা চাই
03 April 2017, Monday
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিবাদীরা নিজেরাই বোমা ব্যবহার করে নিজেদের ছিন্নভিন্ন লাশ করে দিচ্ছে। পুড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদী বা সন্ত্রাসী কারা, তাদের উদ্দেশ্যই বা কী তা জানা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে সত্য জানা অসম্ভব করে সন্ত্রাস দমনের সাফল্য দাবি করা যাবে না। তবুও দাবি করা হচ্ছে, সিলেট ও কুমিল্লায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পুলিশের বিবেচনায় সফল হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আক্রমণ পরিকল্পনা প্রতিহত করা হয়েছে; কিন্তু কোথায় কীভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল তা-ও পুলিশের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
একদিকে বিস্ময়ের ব্যাপার, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করছে। অপরদিকে অপহৃত মানুষ গুম হচ্ছে। খবরে প্রকাশ, ক’দিন আগে চট্টগ্রামসহ চার জেলা থেকে ১২ জনকে তুলে নেয়া হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের মানুষ নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে আসছে। পরিবারের লোকদের কথা হচ্ছে অজ্ঞাত পরিচয় লোকরা তাদের নিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রশ্ন জাগছে, আমরা কি সন্ত্রাস দমন করছি না সন্ত্রাসী তৈরি করছি?
কিন্তু যে সত্যটি স্বীকার না করে উপায় নেই তা হল, সন্ত্রাসবাদের চিন্তা-ভাবনা ও জঙ্গিদের সঙ্গে কাদের সুসম্পর্ক আছে তার সঠিক তথ্য না পেলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা সম্ভব হবে না। সন্ত্রাসবাদের মূলে যেতে হলে সন্ত্রাসীদের জীবন্ত ধরতে হবে। আইনের আওতায় প্রকাশ্য বিচারের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জনগণকে জানাতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিয়েই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান সফল করতে হবে।
সবচেয়ে অবাক লাগছে যখন বলা হচ্ছে, জঙ্গিরা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে বসে আত্মহত্যা করেছে। জঙ্গিরা তো নিজেদের জীবনবাজি রেখে অন্যদের মৃত্যু ঘটাতে ব্যস্ত থাকে। পুলিশের উপস্থিতিতে এ ধরনের মৃত্যু ঘটতে দেয়া কতটা কাম্য আমার জানা নেই। বিষয়টি পুলিশকে ভেবে দেখতে হবে।
এর আগে একই সময়ে সিলেটে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের আস্তানা ‘গুঁড়িয়ে’ দিতে পুলিশ, র্যাব, সোয়াত ও সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে একযোগে অপারেশন চালাতে গিয়ে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং আহত হয়েছেন আরও অনেকে। গুরুতর আহত র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
গত বুধবার মৌলভীবাজার ও কুমিল্লায় জঙ্গিদের আরও দুটি ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া গেছে। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, জঙ্গিরা উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের কাছে রয়েছে পর্যাপ্ত বিস্ফোরক এবং আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের অবস্থানকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুড়লে তারাও মাঝে-মধ্যে গুলি ছোড়ে এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়তে থাকে।
পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্যকেও জড়ো করতে হয় এবং তাদের সহযোগিতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকরা জঙ্গিদের আস্তানার চারদিক থেকে স্থানীয় লোকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়।
সাধারণ লোকের জীবনহানি এড়ানোর জন্য ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়, যাতে আতিয়া মহলের মতো অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, যেখানে অপারেশন চালাতে গিয়ে কমপক্ষে চারজন বেসামরিক ব্যক্তি, দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং ছয় জঙ্গি নিহত হয়।
সিলেটের মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে দ্বিতীয় জঙ্গি আস্তানা পাওয়া গেছে। সেখানে ‘অপারেশন হিটব্যাক’ চালাতে দেখা গেল। ঘরের ভেতরে ৭ থেকে ৮টি লাশ ছিন্নভিন্নভাবে পড়ে আছে। ‘অপারেশন হিটব্যাক’ থেকে জানানো হয়েছে, জঙ্গিদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণের কারণেই তাদের জীবিত ধরা সম্ভব হয়নি। হাসপাতাল সূত্র থেকে জানানো হচ্ছে, তারা চারটি শিশু, দু’জন বয়স্ক মহিলা এবং একজন পুরুষের লাশ চিহ্নিত করেছে।
কুমিল্লা শহরে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ স্থগিত রাখে; কিন্তু শুক্রবার অভিযান চালিয়ে সেখানে কোনো সন্ত্রাসীকে পাওয়া যায়নি। কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে।
গণতান্ত্রিক দেশগুলো ইসলামী জঙ্গিবাদীদের গণতন্ত্রের শত্রু মনে করে এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। তারা তাদের হত্যার জন্য হত্যা করে না। এসব দেশের সন্ত্রাসীরা ঘরে বসে শিশুদের নিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে না। সন্ত্রাসীরা সংসার নিয়ে চিন্তা করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
সত্যিকার সন্ত্রাসীদের কাছে নিজেদের মৃত্যু কোনো বিষয় নয়। তাদের মৃত্যু হলেও মতবাদ অন্যদের মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। তাই চরমপন্থী মতবাদের মৃত্যু ঘটাতে হবে আমাদের গণতান্ত্রিক মতবাদের সহনশীলতা ও মহত্ত্ব দেখিয়ে। মুক্তচিন্তা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত করে।
মার্চ মাসে পার্লামেন্টের কাছে সংঘটিত জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে তার দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পার্লামেন্ট সদস্যদের স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের মতো ব্রিটিশ মূল্যবোধ রক্ষায় তার রয়েছে দৃঢ় প্রত্যয়। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধবিরোধী। তাই তিনি সন্ত্রাসবাদকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেবেন না যাতে গণতন্ত্র পরাভূত হয়। এক কথায়, ইসলামী জঙ্গিবাদের মতবাদকে তিনি পরাস্ত করবেন গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করে। খুনের বিপরীতে খুন করে নয়।
সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের সাফল্য নিয়ে গোটা জাতি বড় ধরনের আতংকের মধ্যে রয়েছে এবং পুলিশি শক্তির ওপর সরকারের সম্পূর্ণ নির্ভরতা তাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। ধর্মীয় হোক বা না হোক, সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা রূপ। সন্ত্রাসী মতবাদের মোকাবেলা না করে সন্ত্রাসী সন্দেহের কিছু লোকের মৃত্যু ঘটালেই সন্ত্রাসী মতবাদ বা চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনার মৃত্যু ঘটবে না।
জঙ্গিদের বড় আকারের সশস্ত্র প্রস্তুতির তথ্য আমাদের সবাইকে সন্ত্রস্ত করে তুলছে। জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশি তৎপরতাই সরকারের কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে। এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্যও নিচ্ছে; কিন্তু সন্ত্রাসী তৎপরতা তো বেড়েই চলছে। মনে হচ্ছে পুলিশ সঠিক তথ্য বা ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট ছাড়াই অগ্রসর হচ্ছে।
পুলিশকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়ার কাজে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাই বলছেন। গুঁড়িয়ে দেয়ার ভাষা সন্ত্রাস দমনের ভাষা নয়। সর্বত্র পুলিশের অবস্থান দৃশ্যমান। জনগণের পক্ষে সাধারণভাবে চলাফেরা করা কঠিন করা হচ্ছে। খোদ রাজধানীর নানা স্থানে পুলিশ চেকপোস্ট স্থাপন করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুলিশের পক্ষে আইনশৃংখলা রক্ষার নিয়মিত দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়ছে।
জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে চাইলে আমি অবশ্যই বলব, সরকারকে আরও খোলামেলা হতে হবে এবং সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশি তৎপরতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে। সংসদ কতটা জনপ্রতিনিধিত্বশীল তা নিয়ে আমাদের অনেকে প্রশ্ন করতে পারে; কিন্তু সরকার তো সংসদকে জনপ্রতিনিধিদের ঘর হিসেবে গুরুত্ব দেবে। সংসদকেও জানানো হচ্ছে না সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানগুলো সম্পর্কে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সন্ত্রাস দমনের অগ্রগতি নিয়ে সংসদকে অবহেলা করা হয় না। সংসদ সদস্যদের মধ্যে কোনোরূপ সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার সচেতনতা দেখানো সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সরকার নিজেদের সৃষ্ট সংসদেও বিষয়টি পেশ করছে না। এজন্য প্রশ্ন উঠছে তাহলে সন্ত্রাস দমন নিয়েও কি রাজনীতি চলছে?
জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় পুলিশি বিকল্প শক্তির প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু জঙ্গি দমনের কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের অস্ত্র-যুদ্ধকেই যদি একমাত্র ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে অস্ত্র সংঘাতের প্রতিযোগিতাই বাড়বে। পুলিশকে পাল্টা সন্ত্রাসী হতে হবে; যা কিছুতেই কাম্য নয়।
আমাদের দেশে সন্ত্রাসবাদ যে গণতন্ত্রবিরোধী, এ কথা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে বলা হয় না যে, সন্ত্রাসবাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেমন সহনশীলতা, বাক স্বাধীনতা, নির্বাচন অথবা জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী নয়। সরকার জঙ্গিদের ধর্মীয় গোঁড়ামিকে বড় করে দেখাচ্ছে; কিন্তু বলা হচ্ছে না ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সন্ত্রাসীদের চরমপন্থী মতবাদ মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণার মতো আমাদের সরকারও ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামিকে দোষারোপ করে চলছে।
জঙ্গিদের সত্যিকার পরিচয় কী, তাদের লক্ষ্য কী এ সম্পর্কে জনগণের কোনো পরিষ্কার ধারণা দেয়া হচ্ছে না। কেবল ধর্মীয় গোঁড়ামির লোকেরাই নয়, ইংরেজি শিক্ষিত আধুনিক তরুণরাও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ সূত্রেই আমরা এ তথ্য পাচ্ছি। এটা স্বীকার করতে হবে যে, একজন মগজধোলাইকৃত ব্যক্তিও বিপথগামী হতে পারে। তাই মগজধোলাইয়ের অর্থ কী তা-ও জনগণকে বোঝাতে হবে। সন্ত্রাসীদের মতবাদ কেন আমাদের জন্য বিপজ্জনক, তা-ও বলা হচ্ছে না। শুধু ধর্মীয় মৌলবাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। আমাদের মুসলিম জনগণের কাছে ধর্মীয় গোঁড়ামি কোনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। কারণ, তারা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করে না। জনগণের গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে ধর্মীয় গোঁড়াদের কোনো স্থান বাংলাদেশে থাকবে না।
আমরা আগেও মুসলমান ছিলাম, এখনও মুসলমান আছি এবং এ ব্যাপারে একটা ঐকমত্য আছে যে, ইসলামের অনুশীলনে আমরা কখনও উগ্রপন্থাকে প্রশ্রয় দেব না। সে কারণে ধারণার ভিত্তিতে কিংবা পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে আমাদের জঙ্গিবাদকে দেখাটা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তাই সত্য উদঘাটনের জন্য একটা ভয়মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার, যেখানে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার পন্থা নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্ক হতে পারে। আমরা জঙ্গিবাদ রুখতে গিয়ে গণতন্ত্রের ধ্বংস দেখতে চাই না। কারণ সেটা হবে জঙ্গিবাদের বিজয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন