সম্প্রতি ‘দি নিউ নেশান’ পত্রিকায় নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সৌজন্যে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার লেখক ফরহাদ খোশরোখাবার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী। ওই নিবন্ধে লেখক বাস্তিল ডে উদযাপনের সময় ফ্রান্সের নিসে সন্ত্রাসী হামলার যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন : ‘সর্বোপরি ফ্রান্স তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।
দেশটির ব্যবস্থা এমন যাদের কাজ আছে তাদের অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে এবং যাদের কাজ নেই তাদের জন্য ব্যবস্থাটা যথেষ্ট উন্মুক্ত নয়, যাকে ঘিরে ক্রোধ জন্ম নিচ্ছে। বেকার যুবজনতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং যাদের উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই তারা এ ব্যবস্থার শিকার, এমনটিই সঠিক। তুচ্ছ অপরাধের জন্য প্রায়ই এরা জেল খাটে এবং এরাই জিহাদি প্রচারণার প্রধান লক্ষ্য।’
সংকটকালীন চিন্তাশীল সবাই সরকারকে সাহায্য করতে চায়, দেশকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের এটা মূল্যায়ন করতে দেখা যায় না। যারা সমস্যা সৃষ্টি করছে, যাদের পক্ষে সমস্যাকে আড়াল করতে পারলেই লাভ, তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ অনুযায়ী চলার কারণেই দেশব্যাপী সমগ্র জনগণকে এক গভীর আতংকে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছে।
সন্ত্রাসী তৎপরতার মূল কারণ তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বাংলাদেশ এমন একটি সন্ত্রাসী দেশ নয় যে, আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের অংশ হিসেবে চিত্রিত করতে হবে। তবে দেশটিতে সামাজিক, আর্থিক বিশৃংখলা ও আতংক বিরাজ করছে।
যারা সন্ত্রাসজনিত সংকট প্রতিরোধের জন্য জাতীয় ঐক্যের দাবিতে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, তারা তো কেউ বলছেন না যে জাতীয় ঐক্য হলেই কীভাবে সন্ত্রাস দমন হবে। তারা কি সরকারের সঙ্গে মিলে আইনশৃংখলা রক্ষাকারীদের জঙ্গিবিরোধী বন্দুকযুদ্ধে শক্তি ও সাহস জোগানোর কথা ভাবছেন? জাতীয় ঐক্য তো স্বাভাবিক সময়েও প্রয়োজন। ক্ষমতাসীনরা সব শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে জাতিকে পরিষ্কার দু’ভাগে বিভক্ত করেছে।
এক ভাগকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি, অপর ভাগকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। অর্থাৎ একপক্ষ বিজয়ী শক্তি, অপরপক্ষ পরাজিত শক্তি। শুধু রাজনীতিতেই নয়, যারা চাকরিতে ঢুকবেন ও পদোন্নতি পাবেন তাদের বিষয়েও বলা হচ্ছে, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমগ্র জাতির। এখন তা হয়েছে বিশেষ এক গোষ্ঠীর চেতনার বিষয়। তাই পারলে পরিষ্কারভাবেই বলতে হবে জাতীয় ঐক্য কিসের ভিত্তিতে এবং কী উদ্দেশ্যে হবে। জাতির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জাতিসত্তা প্রমাণের জন্য। জাতীয় ঐক্য আমিও চাই; কিন্তু অনৈক্যের রাজনীতির বিরুদ্ধে। জাতি তো ঐক্যবদ্ধ, দেশের রাজনীতিতে যত অনৈক্য। তাই রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি হতে হবে সুস্থ রাজনীতি। রাজনীতি হতে হবে জনগণের, তবেই তো জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে।
আমার মতে, সন্ত্রাসের কারণ সন্ত্রাসীরা নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। যদি কেউ সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ খুঁজতে চান তাহলে তাকে জানতে হবে দেশের বিদ্যমান অবস্থা, যে অবস্থার মধ্যে তরুণ প্রজন্ম বসবাস করছে এবং যে বাস্তবতা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করছে। চারদিকে তারা যে অবিচার, বিভেদ, দুর্নীতি দেখছে তা তাদের মনোজগতে প্রভাব ফেলছে। হতাশা যে তরুণদের একার তা নয়। সাধারণভাবে সমগ্র জনগোষ্ঠীর এবং তরুণরাই প্রতিবাদী হয়। তারা তাদের নিজেদের জন্যও সুন্দরতর জীবনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না।
এমন দলীয়করণের রাজনীতি দেশে চলছে যে, ব্যবসা-বাণিজ্য বা সরকারি চাকরি পেতে হলে তিনি সরকারদলীয় কিনা সেটাই বেশি বিবেচ্য হচ্ছে। যোগ্যতা বড় কথা নয়। সমাজজুড়ে চলছে নীতিহীনতা ও অসততার বাড়াবাড়ি। চলছে মেধা সম্পদের অপচয়। হতাশাগ্রস্ত বেকার তরুণদের চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ হতে দলীয় রাজনীতি সাহায্য করছে। তরুণদের ব্যবহার করা হচ্ছে পেশিশক্তির হাতিয়ার হিসেবে। সহিংস রাজনীতির কারণে তরুণদের জীবন দিতে হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজ করছে অরাজক পরিস্থিতি। শিক্ষার পরিবেশ নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষকরা দলীয় পরিচয় নিয়ে খুশিতে আছেন। শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব তাদের নয়। শিক্ষকরাই এখন বলবেন তাদের ছাত্রদের মধ্যে কাদের তারা সন্ত্রাসী হিসেবে সন্দেহ করেন। দলীয় শিক্ষকদের এখন এমন কাজ করতে বলা হচ্ছে যা বস্তুত পুলিশের কাজ। ফলে শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতির বিভাজন বেড়েই চলবে। ছাত্রদেরও এখন শিক্ষকদের ও পুলিশের নজরদারিতে থাকতে হবে। তাহলে তরুণরা কোথায় আশ্রয় পাবে, কোথায় শান্তি পাবে?
সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতা খুঁজলেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ধর্মপ্রাণ লোকদের মনে আঘাত হানা যাবে। এ সত্যও অস্বীকার করার জো নেই যে, চলমান সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে এ তরুণরাই। প্রত্যেক তরুণকেই ভাবতে হচ্ছে কখন সে পুলিশের নজরে পড়বে। গ্রেফতার হলেই হল। বিচারের কোনো নিশ্চয়তা নেই। সত্যিকারের দোষী কিনা তা প্রমাণের দায়িত্ব নেই কারও। দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হবে এটা বলাই যথেষ্ট নয়। পথ ও পন্থার কথাও ভাবতে হবে।
বাঙালি শিক্ষিত সমাজের সুবিধাবাদী মানসিকতা বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে নানাভাবে। তারা নিশ্চয়ই চেয়েছেন আমাদের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে চারিত্রিক সততা এবং সৎ সাহসের বিকাশ ঘটুক। কারণ, নীতি-চরিত্রহীন শিক্ষা দেশ-জাতির জন্য বিপদই ডেকে আনে।
তরুণদের মগজ ধোলাই করার কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি সন্ত্রাসী তৈরি করার মতলব নিয়ে কারও মগজ ধোলাই করতে চাইলেও তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় পাওয়া প্রয়োজন। যে তরুণ বেঁচে থাকাকে মূল্যহীন মনে করছে। সচ্ছল পরিবারের তরুণদের মধ্যে জীবনের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে কোনো চিন্তাভাবনা নেই এমন ধারণা ঠিক নয়। রোগের চিকিৎসা না করে রোগে আক্রান্তদের বিরুদ্ধে লড়াই করা- এর চেয়ে বোকামি আর কিছু হয় না। তরুণ সমাজকে কতভাবে সংকটের মধ্যে রাখা হয়েছে তা বুঝতে চেষ্টা করা হচ্ছে না।
স্বীকার না করে উপায় নেই, পুলিশকে অত্যন্ত চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেবল তাদের মাধ্যমে এর সমাধান হওয়ার নয়। তারা সাধারণ অপরাধীদের খবর রাখেন এবং তাদের দমনের ব্যাপারে সাহসও দেখাতে পারেন; কিন্তু অপরাধের উদ্দেশ্য যদি হয় রাজনৈতিক, তখন পুলিশ অকার্যকর না হয়ে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের যে সন্ত্রাসী হিসেবে ক্রসফায়ারে দেয়া হচ্ছে না, সেটা কি হলফ করে বলা যায়? বিনা বিচারে যে জেলে আটক রাখা হচ্ছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তাদের রাজনীতি বা মতবাদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন তো পুলিশ আনতে পারবে না।
পুলিশ তাদের নিজেদের ওপর চরম ঝুঁকি নিয়ে পুলিশি কায়দায় সন্ত্রাসবাদী অপরাধ মোকাবেলায় যথেষ্ট সক্রিয়। বিভিন্ন চেকপোস্টে তাদের কর্মব্যস্ততা দেখলে নিরাপত্তার জন্যও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়।
কিন্তু সন্ত্রাসবাদ তো কেবল অপরাধ দমনের বিষয় নয়। পুলিশি তৎপরতা ও রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ সমন্বিত না হলে সন্ত্রাসী অপরাধের অবসান ঘটানো যাবে না। এটা তো সাধারণ যুক্তির কথা। এমনকি পশ্চিমা খ্রিস্টানপ্রধান দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ’ দমনে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সংঘাত-সংঘর্ষমুক্ত সামাজিক ঐক্য কীভাবে সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে সেখানে চিন্তাভাবনার শেষ নেই। তারা যে কাউকে ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ বলে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ বা অনৈক্য ছড়াতে দিচ্ছে না।
তবে কিছু লোক আছেন যারা বলতে চান ধর্মান্ধ হয়ে তরুণরা ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়ে সন্ত্রাসী হিসেবে জিহাদে নেমেছে। তারা নিজের জীবনের তোয়াক্কা করছে না শুধু এ আশায় যে, ধর্মের নামে শহীদ হলে বেহেশতে সুখ-শান্তি পাওয়া যাবে। তাহলেও তো তাদের এ জগতে অশান্তিতে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলাম রক্ষার জন্য যুদ্ধে নামার তো কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে ধর্মযুদ্ধ শুরু করার কোনো কারণ কেউ খুঁজে পাবে না।
আন্তর্জাতিকভাবে এটা স্বীকার করা হচ্ছে যে, ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য লড়াই করছে, যতই তা নেতিবাচক হোক না কেন। এজন্য ইংরেজিতে বলা হয় : There is method even in madness, অর্থাৎ পাগলামির মধ্যেও উদ্দেশ্য থাকে।
আইসিস নিজেদের জিহাদি বলে দাবি করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সুতরাং তাদের লড়াইয়ের লক্ষ্য ইসলাম ধর্ম নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক সংগ্রাম। এটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষক স্বীকার করছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর পশ্চিমা দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে যে অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন করেছে সেই ক্ষোভই এ লক্ষ্য অর্জনের আকাক্সক্ষার পেছনে কাজ করছে।
স্বীকার করতে হবে, জিহাদিরা তরুণদের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কেমন করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হতে হয় সে শিক্ষা তাদের দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু প্রত্যেককে আমাদের তরুণদের সন্ত্রাসী পথে নিয়ে যাওয়ার কারণ উপলব্ধি করতে হবে- আপনারা যদি একে পাগলামি বলতে ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে বলতেই হয়, এ পাগলামির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে তারা কেবল অন্যদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি, নিজেদের জন্যও ভয়ংকর বিপদ ডেকে এনেছে। তাদের ভেতরের ক্ষোভ-হতাশার সুপ্ত আগুনকে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে; কিন্তু আগুন তো ভেতর থেকে আসছে। আমি ভেতরে থাকা সেই আগুনের কারণ খোলা মনে ভেবে দেখতে বলছি। বন্দুক দিয়ে এ আগুন নেভানো যাবে না বলেই আমাদের এত দুশ্চিন্তা। সন্তান যারই হোক না কেন, সে সামগ্রিকভাবে আমাদেরই সন্তান। একটি তরুণেরও অকালমৃত্যু দেখতে চাই না। সবার মনে সুন্দর ভবিষ্যতের আশা জাগানোই আমাদের মতো প্রবীণদের দায়িত্ব।
সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় বললে, সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে বিদ্যমান অনড় অশুভ বাস্তব অবস্থার কারণে সৃষ্ট হতাশা থেকে উদ্ভূত বেপরোয়া কার্যক্রম।
আইসিস জিহাদিরা জানে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ইসলামের নাম ব্যানার হিসেবে ব্যবহার করছে সব জায়গার হতাশাগ্রস্ত মুসলমান তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য, যাতে তারা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হতাশা ও ক্রোধের অংশীদার হতে পারে। তারা শুধু জঙ্গি, ধর্মীয় জঙ্গি নয়। বেকার যুবকদের জন্য তাদের হাতে অর্থ আছে এবং অস্ত্র আছে লড়াই করার জন্য। তারা মুসলিমবিরোধী ইসরাইলের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করছে না। তারা আসলে কাদের, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
তাই দেশের ভেতরে অন্যায়-অবিচার ও নির্যাতন চালিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত হবে না যাতে আন্তর্জাতিক নির্মম সন্ত্রাসী আন্দোলনকারীদের ভয়াবহ প্রভাব থেকে আমাদের হতাশাগ্রস্ত তরুণদের মুক্ত রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠে। সমস্যাটি সবার জন্যই গভীর উদ্বেগের। যে কারও হত্যা মানেই একটি জীবনের অবসান।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত আইসিস এবং অন্যান্য জিহাদির অনুপ্রবেশ আমরা সেসব দেশেই দেখতে পাচ্ছি যেসব মুসলিম দেশে রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইরাক ও সিরিয়াতেই সন্ত্রাসবাদ চরম আকার ধারণ করেছে এবং দেশ দুটি ছিন্নভিন্ন হয়ে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
নিজেদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার না করে সরকার আমাদের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসকে এমনভাবে চিত্রিত করার প্রয়াস নিচ্ছে যে, তাতে কোনো কোনো দেশের সরকারও সুযোগ বুুঝে বন্ধু সেজে এই সন্ত্রাস দমনে সাহায্য দেয়ার হাত বাড়াচ্ছে।
আমরা সবাই এত অশিক্ষিত বা বিবেক-বুদ্ধিবিবর্জিত নই যে জানি না কেন আমাদের সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেন আমাদের তরুণরা স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনার শিকার। কেনইবা আমাদের দেশে সুশাসন গড়ে উঠছে না। কেনইবা কিছু লোক দেশের সম্পদ বিনা বাধায় লুটপাট করতে পারছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আইন করে দুর্নীতি কমানো যায়নি। আমাদের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কথাটি সত্য। রাজনীতি করে দুর্নীতি বাড়ানো হলে আইন দুর্নীতির সহায়ক শক্তিই হয়।
সরকার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা নিয়ে ব্যস্ত। সরকার তো বিচারপতিদের বিচার করার ক্ষমতাও চাইছে। সন্ত্রাসী মামলায় কে জামিন পাবে এবং কে পাবে না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার গঠিত সমন্বয়কারী সেল, কোর্ট-আদালত নয়। এ ধরনের অদ্ভুত চিন্তাভাবনা দুঃখজনক। আমাদের সবাইকে যে এদেশে থাকতে হবে তা ভুলে যাওয়া হচ্ছে। যে কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখলেই সন্ত্রাস দমন হবে না। নির্দোষ-নিরপরাধ মানুষদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে।
সরকারের সঙ্গে আমি একমত যে, আমাদের সন্ত্রাস আমাদের অভ্যন্তরীণ। তবে আমাদের সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণ যে আমাদের নিজস্ব পরিস্থিতি, তাও বুঝতে হবে।
পুলিশ বলতে শুরু করেছে, সন্ত্রাসীরা বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান বিদেশ থেকে পাচ্ছে। আমরা কেন সবাই মিলে নিজেদের সন্ত্রাসমুক্ত রাখার চেষ্টা করছি না? সন্ত্রাসী তৎপরতার সুযোগ থাকলে বিদেশী অর্থ ও বিদেশী অস্ত্র পাওয়া যে কোনো সমস্যা নয়, তা আমাদের স্মরণ না করে দিলেও চলবে।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার ব্যর্থতাকে স্বীকার করে দাঁড়াতে পারলেই আমরা সফল জাতি হিসেবে অগ্রগতি ও শান্তি অর্জন করতে পারব। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অথবা জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে জাতীয় কোনো সংকটের সুষ্ঠু সমাধান আশা করা অবাস্তব।
দেশ যে ভয়াবহ খুন-খারাবির দিকে যাচ্ছে একথা আমার মতো অনেকেই বহুদিন থেকে বলে আসছেন। রাজনীতিতে শান্তি-স্বস্তি থাকবে না, আর দেশ ও জাতি শান্তিতে থাকবে- এটা বুদ্ধিমান লোকদের কথা নয়।
সত্যি কথা বলতে কী, যাদের শুভবুদ্ধির উদ্রেক হওয়া একান্ত প্রয়োজন তাদের কাছ থেকে যে সঠিক সাড়া পাওয়া যাবে, এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ বেড়ে যাচ্ছে- এটাই তাদের তৃপ্তি।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন