বিএনপির রাজনীতি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য রোডব্লক
24 May 2016, Tuesday
বিশ্বনেতাদের সহায়তায় গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার জন্য বিএনপি বেপরোয়াভাবে চেষ্টা করছে; কিন্তু দলটি নিজেই পারিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে গণতন্ত্রের চর্চা না করে, তাহলে অন্যদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না।
খালেদা জিয়া মা হিসেবে তার পুত্রের দাবিকে জাতীয় স্বার্থের রাজনৈতিক দাবির ওপর স্থান দিয়ে আসছেন। বিএনপিতে মা ও ছেলের যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত বিএনপিকে শক্তিশালী করেনি বরং রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। বিএনপির ভেতরের রাজনৈতিক কর্মীদের অন্ধ আনুগত্য দেখে যে কেউ বিস্মিতবোধ করবেন। তারা কি দেখতে পারছেন না, বিএনপি রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার শক্তি নয় বরং পরিবর্তনের পথে প্রতিবন্ধক? এভাবে বিএনপি অগণতান্ত্রিক রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবেই কাজ করে যাচ্ছে। বলতে গেলে নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম ভোগ বৃথাই যাচ্ছে। তাদের ত্যাগ দলেরও কোনো কাজে আসছে না, দেশেরও কোনো উপকারে আসছে না।
যখন গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার জন্য একটি গণতান্ত্রিক দল প্রয়োজন, তখন বিএনপি সম্পূর্ণভাবে মাতা-পুত্রের যৌথ নেতৃত্বে একটি পারিবারিক ব্যাপার হিসেবে বিরাজ করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের ভয়াবহ বিবর্তন ধারাকে বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। মূল নেতৃত্বের বাইরে বিএনপিতে অনেকেই আছেন যারা হতাশায় ভুগছেন; কিন্তু নেতৃত্বের পর্যায়ে এ উপলব্ধি নেই যে গণতান্ত্রিক শাসনের যোগ্য না হয়ে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসার দিন শেষ হয়েছে। একথা সত্য, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ে এক ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে পালাবদলের নিশ্চিত পন্থায় ক্ষমতায় এসেছে। অবশ্য কোনো দলই সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনপ্রিয় হতে পারেনি।
আজ গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের ভীষণ প্রয়োজন। আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় থাকার জন্য এক ধরনের বর্ধিত পারিবারিক রাজনীতির কাছে নতিস্বীকার করেছে। আওয়ামী লীগের নিজস্ব গণতান্ত্রিক রাজনীতি বা স্বতন্ত্র নেতৃত্ব বলতে কিছু নেই। দেশে চলছে জিম্মি থাকার রাজনীতি। স্বাধীন দেশে জাতিকে জিম্মি রাখার রাজনীতি চলতে পারে না। এখন আমরা ক্ষমতায় দেখতে পাচ্ছি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের একদলীয় সরকারব্যবস্থা, যেখানে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং রাজনীতিকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শাসনতান্ত্রিক নিরপেক্ষ সত্তা ধ্বংস করা হচ্ছে।
এমনকি লন্ডনভিত্তিক অন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক ‘দি ইকোনমিস্ট’ এক প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সরকারি কর্মচারীদের কিভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে তা স্বীকার করেছে। আর এটা তো আমাদের সবার জানা আছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর সাংবাদিক এবং আইনজীবীরা কিভাবে রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে। এখনও একইভাবে তারা দলীয় রাজনীতির কর্মী হিসেবে থাকাই শ্রেয় মনে করছেন। ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের সহজ পথই তারা বেছে নিয়েছেন যা পাকিস্তান আমলে ছিল অচিন্তনীয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এ ধরনের চাকরির সুবিধাভোগী মানসিকতা তো সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মধ্যে একেবারেই ছিল না।
দীর্ঘকাল ধরে নানাভাবে একথা বলে আসছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের গণতান্ত্রিক লক্ষ্য। স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ধ্বংস প্রক্রিয়া সূচিত হয় সাংবাদিকদের রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে। এক কথায় বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ঘটনাচক্রে গণতন্ত্রের পরাজয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর পরাজয় তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রশ্ন জাগে আসলে আমরা কী পেয়েছি আর কী হারিয়েছি।
পালাবদলের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ সৃষ্টি হয় বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতায়। সরকারের ওপর আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়। দিনের পর দিন সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এক পর্যায়ে এভাবে ক্ষমতার পালাবদলের খেলা থেকে বিএনপি ছিটকে পড়ে। গণতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে এর আর পুনর্গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিএনপি বর্তমান সরকারের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। বরং নিজেদের বোকামির জন্য সরকারের স্বার্থেই বিএনপি ব্যবহৃত হচ্ছে, কারণ গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
বিএনপি অবশ্য স্বপ্ন দেখছে বাইরের চাপে নির্বাচনের মাধ্যমে পালাবদলের খেলায় আবার তারা ক্ষমতায় আসবে। তাদের হিসাব হচ্ছে, অবাধ নির্বাচন হলে বর্তমান সরকারের পতন অনিবার্য এবং বিএনপির ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পথ পরিষ্কার। এজন্যই তারা বিদেশীদের কাছে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আবেদন জানিয়ে আসছে বারবার। গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার অভাব সম্পর্কে তারা কিছুই উপলব্ধি করতে পারছে না।
বিএনপির ওপর আমাদের এতটা দীর্ঘ বিবরণ হাজির করার কারণ হচ্ছে গণতন্ত্রের স্লোগান দিলেই কোনো দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে পারে না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির সূত্রপাত করার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। শুধু আমরা নই, বাইরের দুনিয়াও শংকিতবোধ করছে, বাংলাদেশ দ্রুত ভয়ংকর নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সশস্ত্র উগ্রপন্থা বাস্তবিকই দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য বৈশ্বিক সাহায্য আমাদের কাজে লাগতে পারে। বাইরের কোনো দেশই চাইবে না যে আমাদের দেশে ভয়াবহ সংঘাত সৃষ্টি হোক। তাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে অন্যান্য দেশের জন্যও। কিন্তু বিএনপি সেক্ষেত্রে বিকল্প না হয়ে গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
দলীয় দুর্বলতার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা সব ধরনের নির্যাতন, হয়রানির শিকার হচ্ছে। কোনো কারণ না থাকলেও প্রতিশোধ গ্রহণের একটা অজুহাত তৈরি করা হচ্ছে; কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে তাকে প্রতিহত করার শক্তি দলটির নেই। এমনকি স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ীদেরও মিথ্যা মামলা দিয়ে পদচ্যুত করা হচ্ছে। বিএনপির সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়রের দৃষ্টান্তটি এ প্রসঙ্গে তোলা যেতে পারে। কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেল খাটানো হচ্ছে। শুধু মার খাচ্ছে আর বড় বড় কথা বলছে, কিন্তু বিরোধী রাজনীতি করার শক্তিও অর্জন করতে পারছে না বিএনপি। সরকারের কাছে বিএনপি দন্তবিহীন একটি দল। যেভাবে খুশি সেভাবেই দলটির নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও বিএনপি বদলাবে না, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক দল হবে না। দেশব্যাপী হতাশা বিরাজ করছে, কারণ কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের জন্য গণতান্ত্রিক বিকল্প নেই। কেবল হিংসা-বিদ্বেষই বিকল্প রাজনীতি হিসেবে বিরাজ করছে। দেশে শান্তি ও স্বস্তি আসার মতো কর্মকাণ্ড কোনো দলেরই নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার তার পথ পরিবর্তন করার কোনো মেজাজ দেখাচ্ছে না; কিন্তু উৎখাতের ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছে সর্বত্র।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন