রাষ্ট্র স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নেয় অনেকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে
22 June 2015, Monday
সমকালীন বিতর্কিত ইস্যুগুলোকে কিভাবে দেখা হচ্ছে, কিংবা কী ধরনের মানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে এবং ব্যক্তিস্বার্থের পায়রবি করা হচ্ছে কি না, যার পরিণতি বা ফলাফল ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভোগ করতে হবে, এই নিরিখে প্রতিটি প্রজন্মকে বিচার করা হয়। বিষয়টি আমাদের সমাজের শিক্ষিত অংশ জানলেও তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। আগামী প্রজন্মের তরুণদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার জন্য আমরা কিভাবে আমাদের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলো মোকাবেলা করছি আলোচ্য নিরিখে তারও বিচার হবে এবং আমাদেরও সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের প্রজন্মকে যে ভয়ঙ্কর সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা হলো, রাজনৈতিক ব্যবস্থার অসততা, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। সরকার কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে কেবল সেটা বোঝায় না, নাগরিক হিসেবে আমরা নিজেদের মধ্যে এবং প্রত্যেকের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করি তাও বোঝায়। স্বৈরাচার উদ্ভূত নৈরাজ্য শুধু সরকারের মাধ্যমে সূচিতও হয় না এবং সরকার এর সমাপ্তিও একা টানতে পারে না, বরং তা অন্যদের স্বেচ্ছাচারিতাকে অনুসরণ করতে থাকে। স্বৈরাচারের অধীনে বিচারিক প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়া সেটা নিশ্চয়ই নয়। সুতরাং আমাদের জানতে হবে কেমন করে একটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
যদি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থাকে আমরা সফল করতে চাই, তাহলে কেবল সরকার গণতান্ত্রিক আচরণ করলে হবে না, গোটা সমাজকেও গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রেও একথা সমভাবে সত্য। সমাজের একটা বৃহদাংশ স্বেচ্ছাচারী না হওয়া পর্যন্ত স্বৈরাচার কায়েম হতে পারে না।
স্বৈরাচারী শাসন এক ব্যক্তির শাসন, এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। এ কথা বলে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো একটা দেশের রাজনীতি কেবল সরকারের চরিত্র নির্ধারণ করে না, ব্যাপক জনসাধারণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও নির্ধারণ করে থাকে। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে কী করবে না, জনগণ অস্থিতিশীলতার আবর্তের মধ্যে থাকবে কি থাকবে না, বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় চলবে, না বিচারিক প্রক্রিয়ায় চলবে, এসব কিছু নির্ধারিত হয়ে থাকে রাজনীতির মাধ্যমে। এটা গণতন্ত্র না স্বৈরতন্ত্র এ কথা বললে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায়- যা কেবল সরকারের চরিত্রকেই বোঝায় না বরং বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে যে জনগোষ্ঠী থাকে তাদের জীবনধারাকেও বুঝিয়ে থাকে।
আমরা এই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় দেখছি রাজনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্র অবহেলিত থাকায় জনগণের প্রতি কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়নি, সাধারণভাবে অনেকেরই আচার-আচরণেও কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সরকার যখন গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে সহনশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সমঝোতার নীতি অনুসরণ করে, তখন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণের ক্ষেত্রেও তার শুভ প্রতিফলন পড়তে দেখা যায়। একইভাবে গণতান্ত্রিক ধারণাজাত আইনের শাসন জনগণকে এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে যে, বিরোধ মীমাংসায় নিরপেক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে, পেশিশক্তি ব্যবহার করে একতরফা রায় দেয়া চলবে না। শান্তিপূর্ণ উপায়ে যদি বিরোধ নিষ্পত্তি করা না যায় তাহলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে, শক্তির আশ্রয় নেয়া যাবে না এবং আইনের এই প্রক্রিয়া চালু থাকলে তা জনসাধারণের চিন্তা-চেতনাকে সঠিক পথে চালিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব না রেখে পারে না। এভাবেই জনসাধারণ আইন মেনে চলতে শেখে এবং সভ্যতার পথে এগিয়ে যায়। দেশের ভেতরেও তখন শান্তি বিরাজ করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদেরও গণতন্ত্রী হতে হয় এবং সরকারকে গণতন্ত্রের পথে রাখতে ভূমিকা পালন করতে হয়। এর বিপরীতটা স্বৈরতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্বৈরব্যবস্থায় প্রত্যেকের মধ্যেই স্বৈরআচরণ দেখা যায়। কারণ জাতীয় পর্যায়ে সরকারি ব্যবস্থা জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো স্বৈরপন্থায় নিষ্পত্তি করা হয়। যুক্তি বা তর্ক-বিতর্কের কোনো সুযোগ থাকে না। একতরফাভাবে সবকিছু করা তখন জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। স্বৈরব্যবস্থায় সরকার জনমতের তোয়াক্কা না করার ব্যাপারটি তার পথ ও পদ্ধতি। জনমত প্রকাশের স্বাধীনতাই রাখা হয় না; স্বৈরশাসনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা বিরোধী দলের ভূমিকা অস্বীকার করেই ক্ষমতাসীনেরা জনস্বার্থেরই অবহেলা করে থাকে। আমলাদের উন্নয়ন, জনমত এবং জনস্বার্থ বিবর্জিত একতরফা উন্নয়নের কর্মকাণ্ড। এতে উন্নয়নের নামে দুর্নীতিরই প্রকাশ পেয়ে থাকে বেশি। নির্বাচনসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পঙ্গু করে রাখা গণতন্ত্র হতে পারে না। স্বৈরব্যবস্থায় এভাবে জনগণকে যে শান্তিতে রাখা হয় সেখানে জীবনের কোনো স্পন্দন থাকে না, শুধু বিরাজ করে কবরের শান্তি।
জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি একতরফাভাবে সবকিছু করার একটা উগ্র আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। এক ধরনের আক্রমণাত্মক ভঙ্গির প্রসার ঘটে চলেছে, যার মূলকথা হচ্ছে জোর যার মুল্লুক তার অথবা রাষ্ট্রীয় শক্তিই পারে একজন মানুষকে মহান নেতা বানাতে এবং যেখানে জোর যার মুল্লুক তার, এই নীতি চলে সেখানে নিরপেক্ষ বিচারের ধারণা বা আইনের পবিত্রতার কথা বলা অর্থহীন।
পুলিশ ও র্যাবের সব ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরও হত্যা ও অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা বাড়ছে, কিন্তু অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কমছে না। যেহেতু সরকারের জবাবদিহিতা বলতে কিছু নেইÑ বিরোধী দলের অস্তিত্বই রাখা হয়নি। সেহেতু ভিন্নমতের গুরুত্ব থাকছে না। সরকার সমর্থক আমলা যা সঠিক মনে করেন, তাই সঠিক।
একজন সংসদ সদস্যের পুত্র তার অস্ত্র ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করল না এবং দু’জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সামান্য ট্রাফিক জ্যামে হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে। জনগণের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের দাবি করেন তাদের দিয়ে আরো অনেক বেশি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। হত্যা করার একটি তালিকা সম্পর্কে খবর বেরিয়েছে। সাধারণভাবে ভয়ভীতি এবং নিরাপত্তাহীনতা ক্রমবর্ধমান। আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি অপরাধের সাথে পুলিশের সম্পৃক্ততায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শান্তিশৃঙ্খলার ইস্যুকে সেসব অবস্থায় রাজনৈতিক ইস্যু থেকে বিচ্ছিন্ন না করে একসাথে মিলিয়ে দেখে এসবের সমাধানের জন্য রাজনৈতিক কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
এখনো আমাদের একটা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানাদি রয়েছে, হোক না সেসব যতই রুগ্ণ। সুতরাং আমাদের ভাবনা স্বৈরতন্ত্রীদের মতোই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এখন আমরা যে অবস্থানে রয়েছি সেখান থেকেই গণতন্ত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। যখন সরকারপ্রধান বিলেতে গিয়ে সেদেশের সংসদ সদস্যদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, সরকার বিলেতি টাইপের সংসদীয় গণতন্ত্র বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কাজটি সহজ নয় জেনেও সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হওয়া উচিত কারা সরকার চালাচ্ছে এবং কারা সরকারকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। আমরা আমাদের রাজনৈতিক সত্তার সাথে অর্থাৎ আমরা যে সবাই একাধিক একনায়কত্বের অধীনে আছি, কারো একার একনায়কত্বে নয় সেটাই বুঝতে হবে। এ সরকারকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে একাধিক একনায়ক যাদের নিজেদের রক্ষার প্রশ্নটিও সরকার রক্ষার সাথে জড়িত।
বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকা এবং অসম্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ যদি কারো কাম্য হয়, তবে নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য তার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। একনায়কত্বে আমরা যা চাই এটা অবশ্যই তা নয়। দেশ জনগণের তাই গণতন্ত্র ভিন্ন, নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা কারো জানা নেই। স্বৈরশাসনে ক্ষমতার সঙ্ঘাত অনিবার্য। সমঝোতা ও সহাবস্থানের সুযোগ সেখানে থাকে না। সমঝোতা ও সহাবস্থানের মন-মানসিকতা ব্যতিরেকে কী ব্যক্তি জীবনে, কী রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা আসতে পারে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন