পুরনো কাহিনী ও নতুন কাণ্ড
08 June 2019, Saturday
৪ জুন মঙ্গলবার দিবাগত সন্ধ্যা। পরদিনই ঈদ হবে বলে প্রায় সবাই ধরে নিয়েছেন। সড়ক, নৌপথ আর রেলপথে ঘরমুখো অসংখ্য মানুষের অবর্ণনীয় ভিড়। অনেকে শেষ মুহূর্তে ঈদের শপিং সেরে নিচ্ছেন। ‘জাতীয় চাঁদদেখা কমিটি’ নিয়মমাফিক বৈঠকে বসেছে। সবার নজর টিভির পর্দার দিকে- কখন ঈদের খবর আসে, বলা তো যায় না। কিন্তু না, টিভিতে জানা যায়- দেশের কোথাও নতুন চাঁদ দেখা যায়নি। অতএব, বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতর, বুধবার নয়। ‘নিশ্চিতভাবে’ এ খবর প্রচারিত হওয়ায় অবশিষ্ট অনিশ্চয়তা ঝেড়ে অনেকে যথারীতি তারাবির জামাতে গেলেন। ধর্মপ্রাণ মানুষের কেউ কেউ ঈদের আগের রাত (তখনকার হিসাবে বুধবার দিবাগত রজনী) পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে বেশি সওয়াব হাসিল করবেন ঠিক করলেন। আর পথেঘাটে, স্টেশন-টার্মিনালে কিংবা যানজটে যারা রোজার দিনে গরমের মধ্যে সকাল থেকে আটকা পড়ে, বাড়িতে পৌঁছে ঈদের নামাজ পড়তে পারার আশা ছেড়েই দিয়েছেন, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। কেননা, বৃহস্পতিবার ঈদ হলে মাঝে একদিন সময় পাওয়া যাবে। এর মধ্যে বাড়ি পৌঁছা সম্ভব হবে বৈকি। না, আশা আর পূরণ হয়নি। কারণ, রাত সোয়া ১১টার দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নিজেই জানিয়ে দেন পরদিন ঈদ হবার কথা। শুনে অন্য সময়ের মতো আনন্দের চেয়ে বিস্ময় ছিল বেশি। চাঁদ দেখা কমিটির নতুন নজির স্থাপন করে দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠকে বসেছিল সে রাতে। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ‘যেহেতু দেশের কোথাও কোথাও শাওয়ালের চাঁদ দেখা যাওয়ার খবর এসেছে, অতএব বুধবারেই ঈদ পালিত হবে, বৃহস্পতিবার নয়।’ নিয়মমাফিক এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। মঙ্গলবার মক্কা-মদিনায় ঈদ হয়েছে, লন্ডনে ক্রিকেটার মাশরাফিরা ঈদ করেছেন, বাংলাদেশের পূর্বদিকে অবস্থিত মুসলিম দেশগুলোতেও একই দিনে হলো ঈদুল ফিতর। তাহলে আমাদের দেশে বুধবারেই তা হওয়ার কথা।
এবার জনমনে মূল প্রশ্ন সেটা নয়। কথা হলো, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি কমিটি জরুরি মিটিং করেছে। এই দ্বিতীয় বৈঠকেই বুধবার ঈদ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাহলে এবার শবেবরাত উপলক্ষে প্রয়োজনে দ্বিতীয়বার মিটিং ডাকা কি অসম্ভব ছিল? যদি তা করা হতো, তা হলে হয়তো শাবান মাসের চাঁদ দেখা নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তি ও বিতর্ক জন্ম নিত না।
যা হোক, ৫ জুন পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন এবং পরদিনও অনেকে বাড়ি গেছেন যথাসময়ে যেতে পারেননি বলে। আবার অনেকে জীবিকার তাগিদে এবং জরুরি কাজে ঈদের পরদিনই বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। তবে সরকারি চাকুরেসমেত পেশাজীবীদের বেশির ভাগ এবার ম্যারাথন ছুটি ভোগ করেছেন ঈদের আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি। তাদের ‘ছুটি’ শুরু হয়েছে ঈদের আগের শুক্রবার, শেষ হয়েছে ঈদের পরের শনিবার। মাঝে ৩ জুন সোমবার ব্যাংকে কিছু কাজ হলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল নামেমাত্র। স্টাফদের অবস্থা হয়েছিল ‘আইলাম আর গেলাম’। হাজিরা দিয়েই অনেককে ছুটতে হয়েছে বাড়ি যাওয়ার গাড়ি ধরার জন্য।
এবারো রোজার মাসে হত্যা, হানাহানি, ধর্ষণ, প্রতারণা ইত্যাদি নারকীয় অপরাধ সমানে চলেছে, তেমনি ঈদের দিনেও খারাপ খবর শুনতে হয়েছে। এবার মাহে রমজানে মসজিদে তারাবির জামাতে কুপিয়ে মুসল্লি হত্যার খবর নিশ্চয়ই বহু দিন ভুলবেন না অনেকে। তেমনি, ঈদের দিনেও বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ৭৪ বছরের অসুস্থ দেহে কারাযন্ত্রণা এবং তার সাথে কাউকে দেখা করতে না দেয়া সাক্ষ্য দেয়, ঈদ মানে সবার জন্য আনন্দ নয়। আর বিদেশের দুঃসংবাদের মধ্যে মুসলিম দেশ সুদানে গুলিতে অন্তত ১১৩ জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু ঈদের উৎসব অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীনেরা বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে প্রাধান্য দিতে টালবাহানা করার অভিযোগে জনতা রাজধানীর রাজপথে বিক্ষোভ করছিল। প্রথমে ৩৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে জানানো হয়, এ সংখ্যা বাড়তে পারে। কিছু পরে জানা যায়, ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঈদের রাতে তা বেড়ে একশ’রও বেশি হয়ে গেছে! এ অবস্থায়, আরব জগতের দেশটিতে এবার ঈদ কেমন উদযাপিত হলো, তা কাউকে বলে দিতে হয় না।
ট্রেনের বিপর্যয় ও রাস্তায় বিক্ষোভ
‘ঈদের আগে বাংলাদেশের ঈদ।’ এবার ঈদের প্রাক্কালে একটি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। এ দেশে তো ঈদ হয় সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত একদিন পরে। তাই এখানে অন্যদের আগে ঈদ উদযাপন অস্বাভাবিক এবং অসম্ভবও। আসলে ২ জুন ক্রিকেট বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়ে দিয়েছে আমাদের জাতীয় টিম। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের শুভসূচনাতেই রেকর্ড গড়ায় খুশিতে ভেসেছে সারা দেশ। এই আনন্দে শামিল হয়ে পত্রিকাটি ওই হেডিং দিয়েছে। বাংলাদেশের হাসি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখাই বড় কথা।
দেশের মানুষ নাড়ির টানে বাড়ির পানে দলে দলে ছুটছে জুন মাস আসার আগে থেকেই। অনেকেই পরিজনকে আগেভাগে দেশের বাড়ি (গ্রাম বা মফঃস্বল) পাঠিয়ে দেন যাতায়াত-বিড়ম্বনা এড়াতে। বেশির ভাগ চাকুরে ছুটি নেন ঈদের পরে। তবে ঈদের আগেও অনেককে ছুটি নিতে দেখা যায়, যারা এ ছুটি শেষ হওয়ার পর প্রথম দিনেই হাজির হয়ে যান কর্মস্থলে। যা হোক, বাড়িতে ঈদানন্দ উপভোগ করতে হলে আগে ছুটতে হয় ‘গাড়ির পানে’। এই গাড়ি স্থলযান ও জলযান- দুটোই হতে পারে। আজকাল অবশ্য পয়সাওয়ালাদের বিরাট অংশই আকাশযানে বাড়ি যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এবারও পুরনো লক্কড়মার্কা বাস-মিনিবাস কিংবা লঞ্চ ঘষে মেজে, রঙচঙ মাখিয়ে নতুন দেখানোর হাস্যকর প্রয়াস কম হয়নি। উদ্দেশ্য, এসব বাজে বা বুড়ো যানবাহন দিয়ে ঈদ মওসুমে যাত্রী টেনে কিছু পয়সা কামানো। কিন্তু, যতই বাহারি মেকআপ লাগিয়ে বৃদ্ধ যানকে যুবা সাজানো হোক না কেন, এগুলো মাঝপথে দুর্ঘটনা ঘটানোর শঙ্কা থাকে বেশি। এতে প্রাণ হারিয়ে ও আহত হয়ে বিপুল ক্ষতির শিকার হন নির্দোষ ও অসহায় যাত্রীরা, তার মেকআপ (ক্ষতিপূরণ) কোনো দিন সম্ভব নয়। এদিকে, প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে এবার শিডিউল বিপর্যয় যোগ হয়েছে বিশেষভাবে। রেলপথে ট্রেনের ৭-৮ ঘণ্টা বিলম্বে ঈদে ঘরমুখো নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র পত্রিকায় উঠেছে। ছবিতে দেখা যায়, এসব দুর্ভাগা যাত্রীর কেউ কেউ প্লাটফর্মে ঘুমিয়ে পড়েছেন ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে। এই দুঃখনিদ্রায় তারা বাড়ি গিয়ে সানন্দে ঈদ উদযাপনের স্বপ্ন দেখেছেন কিনা কে জানে। রেলমন্ত্রী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ করলেও সে স্বপ্ন হয়তো সবার পূরণ হয়নি। সরকারবান্ধব অনুগৃহীত ব্যক্তিদের মালিকানাধীন কোনো কোনো টিভি চ্যানেল বলেছে, মাননীয় মন্ত্রী ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন (তা হলে তিনি কি জনগণের কাছে আসলেই ক্ষমা চাননি?)।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন