ইসরাইলের ‘জন্মই তার আজন্ম পাপ’। দশকের পর দশক ধরে চক্রান্তের পথে এগিয়ে দেশটি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এরপর চক্রান্তের মধ্য দিয়েই ইসরাইলকে দিন দিন পরিপুষ্ট, শক্তিশালী ও ক্রমবর্ধিত করার তৎপরতা বজায় রয়েছে। এর উদ্যোক্তা ইহুদিবাদীরা হলেও তাদের ঘনিষ্ঠ, আন্তর্জাতিক খ্রিষ্টশক্তির সর্বাধিক সাহায্য ছাড়া কোনো দিন অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হওয়া সম্ভব ছিল না। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে যে, নোংরা ও ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল, তা জানা ও মনে রাখা শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ মাত্রেরই উচিত।
১৯৪৭-৪৮ সালে বিশ্বসংস্থাকে ব্যবহার করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ জবদরদখল করে। এর পেছনে ইঙ্গ-মার্কিন জুটির নগ্ন ভূমিকা ছিল সবচেয়ে লজ্জাকর। ফিলিস্তিনিদের ওপর দীর্ঘকালের নির্যাতন-বঞ্চনার পর জাতিসঙ্ঘে তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে, ইসরাইলের জন্মকালীন কূটনৈতিক তোড়জোড়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
ইহুদিদের নৃশংসতা ফিলিস্তিনে সেই তিরিশের দশক থেকেই। এটা প্রচণ্ড দানবীয় রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে এবং রাষ্ট্রটির জন্ম মুহূর্তে। ফিলিস্তিনের আরবরা তাদের মাতৃভূমির ওপর অবিচ্ছেদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম থেকেই যথাসাধ্য সংগ্রামের মাধ্যমে বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এ জন্য নর ও নারী, শিশু ও বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের স্বীকার করতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে চরম ত্যাগ এবং অসহনীয় কষ্ট। এবার গাজায় প্রতিবাদী জনতার ওপর ইসরাইলি ঘাতকদের হামলা ও হত্যার রক্তক্ষয়ী ঘটনা সুদীর্ঘ উপাখ্যানের সর্বশেষ অধ্যায়।ইসরাইলের জন্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। এর প্রতিষ্ঠা বিশ্বইহুদিবাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি নীলনকশা বাস্তবায়নের শেষ নয়, শুরু মাত্র। শুধু ফিলিস্তিন নয়, আশপাশের বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে ভবিষ্যতে ইহুদিদের একচ্ছত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে ইহুদিবাদীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আর এটা সম্ভব হচ্ছে শক্তিশালী লবি দ্বারা প্রভাবিত, বৃহত্তম বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক মদদে। ইসরাইল আয়তনে এখনো হয়তো ক্ষুদ্র। তবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী, চরম বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক এই দেশ তার আগ্রাসী নীতি ও সম্প্রসারণবাদী ভূমিকার কারণে সমগ্র বিশ্বের শান্তি ও স্থিতির প্রতি বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে।
ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সাধারণত যা প্রচার করা হয়, তা হলোÑ ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের হলোকাস্ট বা ইহুদি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। তখন ইহুদিদের নিজস্ব আবাসভূমি হিসেবে ইসরাইলের জন্ম হয়েছিল।’
বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এমনকি, আজ যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রধান মুরব্বি ও মদদদাতা, সে দেশটিরও সরকারের অনেকে প্রথমে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন না। জাতিসঙ্ঘ ইহুদিবাদীদের হুমকি ও প্রলোভনে প্রভাবিত হয়ে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পথ করে দিয়েছিল। একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রও তার শুভাকাক্সক্ষীদের কথায় কান না দিয়ে এবং প্রধানত প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের চাপে, ইসরাইলের অনুকূল ভূমিকা পালন শুরু করে দেয়।
২০১১ সালে অ্যালিসন ওয়েইর তার লেখায় ইসরাইলের জন্মের পেছনে জাতিসঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা তুলে ধরেছেন। এর থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনের একাংশে একটি ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিলেও এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই নিরাপত্তা পরিষদ কখনো তা কার্যকর করেনি। আসলে অন্যভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল জাতিসঙ্ঘকে সামনে রেখে এবং মার্কিন সরকারকে হাত করে। ইহুদিবাদীদের সহিংসতার হুমকি এবং অনেককে ঘুষ দেয়ার বদৌলতে সাধারণ পরিষদে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সমর্থনে প্রস্তাব পাস করা সম্ভব হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সামরিক বাহিনী বা পেন্টাগন, এমনকি নবগঠিত সিআইএ পর্যন্ত তখন ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার ব্যাপারে আপত্তি করেছিল। তবে মার্কিন প্রশাসন দেশটির নির্বাচনী হিসাবনিকাশ করে ইহুদিতোষণের স্বার্থে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে।
লক্ষ করার বিষয়, ইহুদিদের সহিংসতার ভয়ে সাধারণ পরিষদ নতিস্বীকার করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু এই ফোরামে ইসরাইলের পক্ষে প্রস্তাব পাসের পর ইহুদিরা আরো চাপ দিতে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়। ইহুদিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো অনেক দিন যাবৎ আরবদের নির্মূল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এবার তারা ফিলিস্তিনে একের পর এক গণহত্যা ও বহিষ্কারে লিপ্ত হলো। ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে যেন কোনো বাধা না থাকে, সে উদ্দেশ্যে এসব করা হয়েছিল। এই ঘাতকবাহিনীর হাতে তখন ফিলিস্তিনিদের তিন-চতুর্থাংশই জাতিগত নির্মূল অভিযানের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছিল। তাদের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখ হবে বলে ধারণা করা হয়। ইসরাইল যে ভূখণ্ডে কায়েম হয়েছে, সেখানে আগে শতকরা মাত্র ৫ ভাগ ছিল ইহুদি। বহু বছর যাবৎ ইহুদিদের পরিকল্পিত ও অব্যাহত অভিবাসনের পরও তারা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি হতে পারেনি। তবুও অন্যায়ভাবে সেখানে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও প্রথমে এর বিরোধিতা করেছে।
বিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময়জুড়ে ব্রিটেন শাসন করত ফিলিস্তিন। অপর দিকে, এই শতাব্দীর গোড়া থেকেই ইউরোপে রাজনৈতিক ইহুদিবাদের আন্দোলন শুরু হয়। ফিলিস্তিনের মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের জোরপূর্বক বের করে দিয়ে সেখানে শুধু ইহুদিদের জন্য একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল এ আন্দোলনের লক্ষ্য। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে বিশ্ব ইহুদি কংগ্রেসে এ জন্য সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এর হোতা ছিলেন থিওডোর হার্জেল নামের ইহুদিবাদী তাত্ত্বিক। পরিকল্পনা মোতাবেক কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে ভূমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ওদের গূঢ় মতলব অনুধাবন করে মাঝে মধ্যে আদিবাসিন্দা ফিলিস্তিনিরা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করত। অপর দিকে, ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনা ছিল, তারা ফিলিস্তিনে আরবদের জায়গাজমি কিনতে থাকবে, যত দিন না আদিবাসিন্দারা সেখান থেকে চলে যায়। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এই সন্ত্রাসবাদে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে হাগানা, ইরগুন, স্টার্ন প্রভৃতি সংগঠন। এগুলোর একটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেনাচেম বেগিন, যিনি পরবর্তী সময়ে একপর্যায়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ইহুদিবাদীরা দেখল, ‘জমি কিনে ভূমি দখল’ কৌশলে ফিলিস্তিনে বেশি ভূখণ্ড কুক্ষিগত করা যাচ্ছে না। তখন সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলো আদিবাসিন্দা আরব জনগণ এবং শাসক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তৎপর হলো। সন্ত্রাসবাদী বেগিন পরে গর্বভরে বলেছিলেন, ‘ইহুদিবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যে তো বটেই, বিশ্বে বৃহত্তর পরিসরে সন্ত্রাসবাদ এনেছে।’ নিয়তির নির্মম পরিহাস, তাদের সন্ত্রাসের শিকার ফিলিস্তিনি মুসলমানরা আজ ‘সন্ত্রাসবাদী’ আর সেই ইহুদিরা ‘শান্তির প্রবক্তা’ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
যা হোক, ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুর সুরাহার ভার জাতিসঙ্ঘের ওপর অর্পণ করে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা জমি কিনে অব্যাহত বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। এর পাশাপাশি সেখানে ভূমির মালিকানা ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে ইহুদিদের বেলায়।
এর দুই বছর আগে জাতিসঙ্ঘের জন্মকালে এর প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলোর একটি হিসেবে গৃহীত হয় : জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি ও সমর্থন। সে মোতাবেক, যে কারো প্রত্যাশা ছিল, কোনো ভূখণ্ডের বাসিন্দারা যাতে তাদের নিজস্ব স্বাধীন দেশ কায়েম করতে পারেন, সে জন্য সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে জাতিসঙ্ঘ সমর্থন দেবে।
বাস্তবে তা হয়নি ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে। ইহুদিবাদীরা জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদকে চাপ দেয়, যাতে তারা এমন প্রস্তাব গ্রহণ করে যেখানে উল্লেখ থাকবে যে, ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশ জায়গার মালিক ইহুদিরা! তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিল। মূলত পুরো ফিলিস্তিন জবরদখল করাই ছিল তাদের অশুভ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।
ইহুদিবাদীরা তখন চাচ্ছিল, ফিলিস্তিনকে ভাগ করে তাদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন করে দেয়া হোক। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ইহুদি রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী ছিল। কারণ ইহুদিবাদকে গণ্য করা হতো আমেরিকার মূলনীতি আর মার্কিন জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর লয় হেন্ডারসন তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা এক পত্রে হুঁশিয়ার করে দিলেন : ‘ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক সমর্থন জানানো ফিলিস্তিনের মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আশা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে যাবে। তদুপরি, নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থের ওপর এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
হেন্ডারসন জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিকটপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যে নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এত উন্নত অবস্থানে রয়েছে যে, আর কোনো বৃহৎ শক্তির এমন অবস্থান নেই। ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন জোগালে সেই মর্যাদা হারাতে হবে। তা ছাড়া, অনেক বছর যাবত আমাদের গণ্য করা হবে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। মনে করা হবে, যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিজের বিঘোষিত নীতিগুলোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে এখন।’ হেন্ডারসন উল্লেখ করেন, শুধু বলপ্রয়োগ করেই ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র বানিয়ে দেয়া হবে এবং এটা হবে নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন সঙ্কট স্থায়ী রূপ নেবে এবং ভবিষ্যতে আরো জটিল হয়ে উঠবে বলে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
লয় হেন্ডারসন ছিলেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তি। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে ইহুদিবাদীদের মতলব যে কতটা মারাত্মক, তা তিনি যথাসময়েই উপলব্ধি করে এ ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ না নিতে হোয়াইট হাউজকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা। এর পরিণতি আজকের পরিস্থিতি, তথা জাতিসঙ্ঘের তোয়াক্কা না করে এবং বিশ্বজনমতের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপন করার মতো ইহুদিবাদী উদ্যোগ।
হেন্ডারসনের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ফুটে ওঠে ৭০ বছর আগে তার উচ্চারিত সতর্কবাণীতে। তিনি ইহুদি চক্রান্তের বিষয়ে আরো যা বলেছিলেন, তা-ও জানিয়েছেন গ্রন্থকার ডোনাল্ড নেফ। হেন্ডারসন তার আলোচ্য চিঠিতে আরো লিখেছেন, ‘ফিলিস্তিন ভাগ করে (ইহুদিদের) আলাদা রাষ্ট্র গঠন জাতিসঙ্ঘ সনদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার গঠনের মূলনীতির বিরোধী। কারণ এতে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মতো মূলবিষয়কে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ইহুদিবাদীরা ধর্মভিত্তিক বর্ণবাদী রাষ্ট্রকে সমর্থন করে।’
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘মার্কিন প্রশাসনে হেন্ডারসন কি একাই এমন সুস্পষ্ট ও সাহসী বক্তব্য দিয়েছিলেন?’ জানা যায় তিনি লিখেছিলেন, ‘তার এই অভিমতগুলো স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংশ্লিষ্ট শাখার সবার। তিনি বলেছিলেন, যারাই এ বিষয়ে কাজ করেছেন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের এমন প্রায় সবাই একই ধরনের মতামত পোষণ করেন।’
তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, হেন্ডারসন বাড়িয়ে বলেননি। তদানীন্তন মার্কিন সরকারের কর্মকর্তার পর কর্মকর্তা, একের পর একটা এজেন্সি ইহুদিবাদীদের অপতৎপরতার বিরোধিতা করেছে। এমনকি, সিআইএ রিপোর্ট করেছিল, ইহুদিবাদী নেতারা এমন সব লক্ষ্য পূরণে কাজ করছেন যা ইহুদিদেরকে এবং সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যশক্তির কৌশলগত স্বার্থকে বিপন্ন করবে।’
এত কিছু সত্ত্বেও, দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণ স্বার্থচিন্তায়, অর্থাৎ নির্বাচনে ইহুদিদের সমর্থনকে প্রাধান্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান হেন্ডারসনের পরামর্শকে উপেক্ষা করেন। ট্রুম্যানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ক্লার্ক ক্লিফোর্ড বিশ্বাস করতেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন্য ইহুদিদের ভোট ও ভেট (চাঁদা) খুব দরকার। তাই তাদের রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন দেয়া উচিত। লক্ষণীয়, মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান, দুই দলই ইহুদিতোষণ ও ইসরাইলপোষণে সমান উৎসাহী ও তৎপর। ১৯৪৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রুম্যান এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডিউই-দু’জনই ইহুদিবাদীদের ‘ইসরাইল প্রজেক্টে’ একইভাবে ও অভিন্ন কারণে মদদ জুগিয়েছিলেন।
সে সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন মার্শাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খ্যাতনামা জেনারেল। সুপরিচিত মার্শাল প্লানের তিনিই প্রণেতা। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াকে জাতীয় স্বার্থের ওপরে স্থান দিতে দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। মার্শাল এহেন মনোভাবের নিন্দা করে বলেন, এটা হলো, ‘কয়েকটি ভোটের জন্য সুস্পষ্ট লুকোচুরি।’ তার মতে, এর ফলে প্রেসিডেন্টের দফতরের মর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হবে।’ ট্রুম্যানের উপদেষ্টা ক্লিফোর্ডের উল্লিখিত পরামর্শের সমালোচনা করে মার্শাল বলেছিলেন, সাফ বলে দিতে চাইÑ প্রেসিডেন্ট ক্লিফোর্ডের সে পরামর্শ গ্রহণ করলে আমি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেই ভোট দেবো।’
হেনরি এফ গ্রাডিকে বলা হতো, ‘স্নায়ুযুদ্ধের এক সঙ্কটময় সময়ে মার্কিন কূটনীতির সেরা সৈনিক।’ ফিলিস্তিন ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য ১৯৪৬ সালে গঠিত কমিশনের তিনি ছিলেন প্রধান। তিনি পর্যন্ত লিখেছেন, ‘মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য ইহুদি লবি ক্ষতিকর।’ তার কথা, ‘ইহুদিবাদীদের চাপেই যুক্তরাষ্ট্র আরব দেশগুলোর প্রতি মন্দ ইচ্ছা পোষণ করেছে। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে এসব দেশ আমাদের জন্য গুরুত্ব বহন করে।’
বিখ্যাত রুজভেন্টের ভাতিজা ছিলেন কারমিট রুজভেল্ট। তিনি একজন কিংবদন্তিতুল্য মার্কিন গোয়েন্দা। তার বক্তব্য, ইহুদিবাদীরা ইসরাইল প্রতিষ্ঠায় যেভাবে আমেরিকার সমর্থন বাগিয়ে নিয়েছে, তাতে দলীয় নয়, জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। নিজ দলের পক্ষে ভোট পাওয়ার জন্য জাতির স্বার্থের প্রশ্নে আপসের অধিকার নেই কোনো রাজনৈতিক নেতার।
ইসরাইলের রক্তপিপাসা তার অবৈধ জন্মের মুহূর্ত থেকেই। ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া’রূপী এই অস্বাভাবিক অপরাষ্ট্রশক্তি যখন সদ্যোজাত শিশু, তখন থেকেই সে বর্বর ও নিষ্ঠুর নরপিশাচের মতো নারকীয়তার পরিচয় দিয়ে আসছে। সেই ১৯৪৮ থেকে একাদিক্রমে ৭০ বছর ধরে অব্যাহতভাবে ও ক্রমবর্ধমান হারে ফিলিস্তিনি ভূমিপুত্রদের বিরুদ্ধে তার উন্মত্ত তাণ্ডবের নির্মমতা ঘটে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে, ঐতিহাসিক ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের জন্ম; আর গণহত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠার সাত দশক পূর্তি এবার উদযাপিত হলো। গাজায় গত ১৪ মে’র এই হত্যাকাণ্ডের উপলক্ষ ছিল পবিত্র জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস চালু করার ধৃষ্টতা। সে দিন যেন, মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি নর-নারী শিশুর রক্তে দখলদার ইহুদিবাদীরা উল্লাসে উদযাপন করেছে ‘মৃত্যুর উৎসব’।
পাদটীকা : এবার ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে- ‘চীন বাধা দেয়ায় রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাচ্ছে না।’ সত্যি কথা; কিন্তু একইভাবে বলতে হয়- ‘যুক্তরাষ্ট্র বাধা দেয়ায় ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধানে ইসরাইলকে বাধ্য করা যাচ্ছে না।’
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন