আজ রোববার, ২৫ মার্চ। দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কালোদিবস হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এই তারিখের কালরাতে সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সূত্রে। মার্চ মাসের ২৫তম দিবসে বিশ্বের ইতিহাসে আর যা কিছুই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশের জনগণ মনে করে, ৪৭ বছর আগের সে ভয়াবহ আর নৃশংস ঘটনাবলিই এ দিনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, উল্লেখযোগ্য এবং স্মরণীয়। তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ কালো পঁচিশের কৃষ্ণরজনীতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়েছিল। আসলে এই ‘লাইট’ ইতিহাসে আলোর বদলে যে অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, তাকে বলা যায়, ২৪ বছর বয়সী পাকিস্তানের Beginning of the End. একাত্তরের পঁচিশে মার্চে যারা প্রধানত ঢাকানগরীসহ বিভিন্ন স্থানে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন, আমরা তাদের স্মরণ করি গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সাথে।
কাকতালীয় হলেও সত্য, ৭১-এর মাত্র দুই বছর আগে একই দিনে বাংলাদেশসহ তৎকালীন পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি বিরাট ঘটনা ঘটেছিল। তা হলো, সেনাবাহিনী প্রধান ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারি। এই ইয়াহিয়াই ৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যার খলনায়করূপে ধিকৃত। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পরিণতি কেন সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল, তা গবেষকদের কাছে অতীব গুরুত্ববহ। সে বছরের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় দাবি না মেনে বরং প্রধান সেনাপতিকে সর্বময় রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে এই আইয়ুব নিজে সেনাপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন। ১৯৬৮ সালের শেষপ্রান্তে তার শাসনকালের কথিত ‘উন্নয়ন দশক’ উৎসবের সময়ই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা। যারা গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে বড় মনে করেন, তাদের শিক্ষা নেয়া উচিত কথিত লৌহমানব আইয়ুবের পরিণতি থেকে। যা হোক, তার কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে ইয়াহিয়া যে সামরিক শাসনের সূচনা করেন, তা ’৭১ সালেও ছিল অব্যাহত।
১৯৬৯ কিংবা ’৭১ সালে ছিলাম ঢাকার বাইরে একটি ছোট শহরে। মনে আছে, ’৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থানের চরম পর্যায়ে অনেক রাজবন্দী মুক্তি পেয়েছিলেন এবং অনেক বামপন্থী নেতা Underground থেকে উঠে এসেছিলেন। তেমনি একজন হলেন কমরেড মণি সিং। ২৭ মার্চ আমাদের সেই শহরে তার জনসভা হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ২৫ তারিখ রাতে গণেশ উল্টে গিয়ে ইয়াহিয়ার আবির্ভাব ক্ষমতার মঞ্চে। ওই সমাবেশ আর হতে পারেনি। আর ’৭১-এর ২৭ মার্চ দেশে হরতাল ডেকেছিল ’৭০-এর নির্বাচনে গণম্যান্ডেটজয়ী দল আওয়ামী লীগ। তার আগেই ২৫ মার্চ রাতে নেমে আসে হামলা, হনন, আগুন ও মৃত্যুর বিভীষিকা।
এবার ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস আর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সুসংবাদের প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশের সার্বিক ও সত্যিকার উন্নয়ন স্বাধীনতাকে সার্থক করবে, এই ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই।
বাংলাদেশে এখন রাজধানী থেকে মফঃস্বল- সর্বত্র বিপুল আয়োজন-আড়ম্বরে, বর্ণাঢ্য সাজসজ্জায় মহোৎসবের উল্লাস। কারণ, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) স্ট্যাটাস থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে শামিল। ফলে মঞ্জুরি এবং স্বল্প সুদে ঋণ লাভের সুযোগ বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও আপাতত সে সমস্যায় পড়তে হবে না বলে জানানো হয়েছে। সরকার সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে স্বাধীনতা বার্ষিকীর সাথে মিল রেখে। এর প্রতিপাদ্য : ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। এ জন্য ছোট বড়, সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য দফতর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। অবশ্য, এ দেশের গ্রামের সাধারণ মানুষ তো বটেই, শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত- এমন অসংখ্য মানুষের কাছেও স্পষ্ট নয়, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশের বৈরী বাস্তবতায় কী কী, কতটা ও কিভাবে পরিবর্তন ঘটবে। গণমানুষ যেসব আর্থিক রাজনৈতিক-সামাজিক সঙ্কটে ক্রমবর্ধমান হারে নিত্যদিন হিমশিম খাচ্ছেন, তা এবার কমবে কি না; অজস্র দীনদরিদ্র, নির্বিত্ত-ছিন্নমূলের জীবনে এর সুফল মিলবে কি না, এসবই জনমানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার এ উপলক্ষে দেশজুড়ে সেবা সপ্তাহের আয়োজন করেছে। আমাদের সব দফতর ও সংস্থা যদি সারা বছর জনসেবার দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতো, তা হলে দুর্নীতির দৌরাত্ম্য অনেক কমে যেত আর হয়রানি হরণ করত না নাগরিকদের মূল্যবান সময় ও শক্তি।
২২ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার প্রাক্কালে হঠাৎ খবর পেলাম, ‘আজ বাসা থেকে খাবার নেয়া যাবে না’। কারণ? বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুুবাদে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান হবে স্টেডিয়ামে, এ জন্য ব্যাগ নিতে মানা। শুনে খটকা লাগল। আসলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সংক্রান্ত ওই সমাবেশ হবে জাতীয় স্টেডিয়ামে বিকেলে। আর প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রামে প্রবেশের ব্যাপারে সব সময়ই কিছু কড়াকড়ি থাকে। আমি তো আর স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে ঢুকছি না। যাবো অফিসে নিত্যদিনের মতো। শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই খাবার নিয়ে কর্মস্থলে পৌঁছলাম। দুপুরে যথারীতি আহারপর্ব সমাধা করে কিছুক্ষণ পরে বের হলাম।
উন্নয়নের জোয়ারে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ, স্থানে স্থানে খোলা ড্রেনের ফাঁদ, চৈত্রের বাতাসে ধুলাবালুর তাণ্ডব, মূল সড়কের অর্ধেকজুড়ে হকারের হাঁকাহাঁকি, ইত্যাদির বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম মতিঝিল শাপলা চত্বরে। দুপুরের গনগনে গরমে এমনিতেই সবাই কাহিল, তার ওপর প্রচণ্ড যানজট। তবে আজ জটটা শুধু যানের নয়, জনেরও। ধোপদুরস্ত নারী পুরুষরা তাদের শাড়ি-কামিজ কিংবা শার্ট-পাঞ্জাবির ওপর রকমারি গেঞ্জি গায়ে দলে দলে যাচ্ছেন। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হলেও তারা ঠেলেঠুলে আগানোর চেষ্টা করছেন। হাতে ব্যানার-প্লাকার্ড। সবার গন্তব্য হওয়ার কথা স্টেডিয়ামের মহা অনুষ্ঠানে। কিন্তু দেখা গেল ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অফিসার ও অন্যান্য স্টাফ উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটের দিকে যেতে চান। ঠেলাধাক্কা দিয়েও সেখানে যাওয়া তখন কঠিন। কারণ শাপলা চত্বরের সদর রাস্তায় এত যানবাহন আর জনমানুষের বাধা কাটিয়ে বিপরীত স্রোতে চলা সহজ নয় মোটেও। এলডিসি থেকে উত্তরণে সাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে স্টেডিয়ামে। পশ্চিম দিকে বেশ কিছু দূরে এটি অবস্থিত। কিন্তু প্রথমে পূর্ব দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে সংশ্লিষ্ট অনেককে সমবেত হতে বলায় এই সুকঠিন উল্টো যাত্রা এবং তজ্জনিত চরম দুর্ভোগ সবার। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের লোকজন লম্বা লম্বা ব্যানার নিয়ে শাপলার উত্তরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছেন ভর দুপুরে।
এতে জট বেড়েছে, গাড়ির গতি কমেছে আরো। এমন এক উৎকট অবর্ণনীয় অবস্থায় দেখা গেল, হাতে ধরা ব্যানারে লেখা- ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। বাস্তবে যান ও যাত্রী, পথচারী ও র্যালির লোকজন- কেউ এগিয়ে যেতে পারছিলেন না। অথচ সবাই চান নিজ নিজ ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে। উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গিয়ে জাতি হিসেবে আমরা যেন এমন বেকায়দায় পড়ে না যাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এলডিসি থেকে এ দেশের উত্তরণে বিভিন্ন আমলের রাজনৈতিক সরকারকে প্রাপ্য প্রশংসা করেছেন। তিনি বাস্তবতার নিরিখে পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়নে দ্বিধা করেননি। তার ভাষায়- ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে গণতন্ত্র ও গুড গভর্ন্যান্সের খুব দরকার।’ এর পাশাপাশি তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের সূচনাটা সাধারণ মানুষের জীবনে খুব একটা প্রভাব বা পরিবর্তন আনবে, সেটা মনে করি না। তবে হতে পারে যে, এটা একটা সাময়িক তুষ্টি আর কি! প্রত্যক্ষভাবে দরিদ্র মানুষের কোনো লাভ বাহ্যিকভাবে দেখা যাবে না। সমাজের উঁচুস্তরে যারা আছে, যাদের ব্যবসা আছে, লিংক আছে, তাদের কিছু লাভ হবে ইমিডিয়েটলি। কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের যে অবস্থা- দারিদ্র্য, দুর্নীতি, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও বিনিয়োগব্যবস্থা, সামাজিক বিষয়গুলো স্বাস্থ্য, নিউট্রিশন- এগুলোর চট্ করে উন্নতি হবে, তা আমি আপাতত মনে করি না। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শিগগিরই সাধারণ মানুষের কোনো উন্নয়ন হবে, সেই আশা আপাতত করা যাচ্ছে না। তবে এটা উৎসবের একটা সামান্য উপাদান হতে পারে, যা মানুষকে কিছুটা আত্মতৃপ্তি দেবে। এর বেশি কিছু নয়।’
সালেহ উদ্দিন বলেছেন উৎসবের কথা। এই মহাউৎসব যে কেমন, তা গত ক’দিনে, বিশেষ করে বৃহস্পতিবার দিনভর সবাই টের পেয়েছেন।
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পর্যায়ে ওঠা পুরো জাতির জন্য নিঃসন্দেহে শুভবার্তা। কিন্তু এর সুফল শুধু সরকারি প্রপাগান্ডা আর মিডিয়ার মাতামাতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এ জাতির যে কোটি কোটি মানুষ আজো দরিদ্র ও অশিক্ষিত (শুধু ‘সাক্ষর’ হলে ‘শিক্ষিত’ হওয়া যায় না), তাদের জীবনে এই অগ্রযাত্রার সুফল অনুভূত হতে হবে অবশ্যই। তা না হলে, যতই রঙিন ছবি আর রকমারি স্বপ্ন দেখানো হোক, তাতে কোনো লাভ হবে না।
একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের কলামিস্ট গত বৃহস্পতিবার একজন মধ্যবিত্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘(টিভি নিউজের) হেডলাইনে পাঠিকা বলে চলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বেঁধে দেয়া তিনটি সূচকেই- মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতা- বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করেছে।’ ভদ্রলোকের সারা শরীরে এক ধরনের রোমাঞ্চ জাগে, এ যে দীর্ঘ সাধনায় পাওয়া প্রেমিকার একটি ‘হ্যাঁ’ সূচক হাসির মতো। কিন্তু এই চাকরিজীবী পরদিনই অফিসে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে একের পর এক তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে সিদ্ধান্ত নিলেন বর্জনের। কী বর্জন করবেন? উন্নয়নশীল, জিডিপি, মাথাপিছু আয়, সক্ষমতা, রিজার্ভ- এসব পরিভাষা আর তিনি শুনবেন না।
সুরসিক কলামিস্ট টিভি টকশোর ভিন্ন চেহারাও তুলে ধরতে ভুলে যাননি। লিখেছেন, ‘আজকাল উল্টোরথের যাত্রীদের খুব একটা ডাকা হয় না টকশোতে। সোজা রাস্তা ধরেন যারা, তাদের পোয়াবারো! হ্যাঁ, একদম সোজা চলতে হবে- ২০৪১ পর্যন্ত, কোথাও বাঁক নেয়া যাবে না। উন্নত দেশের ক্লাবে ঢুকব, তারপর বাদবাকি কথা।’ এরপর কলামটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘টকশোর অব্যবহিত পরই যখন খবর শুরু হলো, তখন আর শত আবরণেও উন্নয়নশীল শরীরের কুষ্ঠরোগ ঢেকে রাখা গেল না।’
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন