নির্বাচন, ফুটবল, গ্যাংবাজির এক দেশ
28 June 2018, Thursday
যে মানসিক জোশ থেকে কিশোর-তরুণেরা গ্যাং বানায়, সেই জোশকে খেলাধুলার খাতে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু না।
যে মানসিক জোশ থেকে কিশোর-তরুণেরা গ্যাং বানায়, সেই জোশকে খেলাধুলার খাতে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু না।
গাজীপুরের নির্বাচনের দিন সংবাদকর্মীদের সমস্ত তোড়জোড় ব্যর্থ করে জিতে গেল আর্জেন্টিনা। পরাজিত নাইজেরিয়া ও বিএনপি। নির্বাচনের খবরে স্বাদ নেই, ওদিকে খেলার খবরে ফজলি আমের মিঠা। সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন রেটিংয়ে সবার ওপরে ছিল খেলার খবর। টেলিভিশন চ্যানেলেও দর্শকের নজর রাজনীতির খেলার জয়-পরাজয়ের চেয়ে ফুটবল খেলার ফল নিয়েই মাতোয়ারা ছিল বেশি। খুলনার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিনের গণমাধ্যমের অবস্থাও বাঙালির রাজনৈতিক সচেতনতার গর্বকে লজ্জা দিয়েছিল। সেদিন অনলাইন পত্রিকার রেটিংয়ের শীর্ষে ছিল পড়ন্ত বয়সে রেলমন্ত্রীর যমজ সন্তান হওয়ার খবর। জনতার এই আচরণ কি যৌক্তিক?
রাজনীতি না খেলা: চ্যানেল বদলানো মানুষ
বুধবার সন্ধ্যার কথা। একদল বন্ধু খেলা দেখতে বসেছে। সবাই জার্মানির সমর্থক। উত্তেজনা, নিশপিশ, বকাবাদ্যের পর জার্মানির পরাজয় যেই নিশ্চিত হয়ে গেল অমনি একজন চ্যানেল বদলিয়ে গান শুনতে বসল। বাকিরাও মন ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। পরাজয়ের গুমোট আবহাওয়ায় কেউ বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেকেরই আশা নেই। স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনের ফল আগাম বলে দিতে পারে সবাই। এসব নিয়ে কিছু করারও আছে বলে ভাবছে না যারা, তারা তো মন-মনোযোগের চ্যানেল বদলে নেবেই। এবং নিচ্ছেও। বাংলাদেশের মানুষের চরম বিশ্বকাপ মাদকতায় মেতে ওঠার একটা কারণ হয়তো এই যে তারা এমন কিছুর মধ্যে থাকতে চায়; প্রশ্নফাঁসের পরীক্ষার মতো যা নকল, নীরস ও বিরক্তিকর হবে না। তারা এমন চরিত্রগুলোকে ভালোবাসতে চায়, যাদের মধ্যে সংগ্রাম আছে, নিষ্ঠা আছে, নায়কের মতো জ্বলে ওঠা আছে—যাদের জয়-পরাজয়ের ভাগীদার হতে পারে যে-কেউ। রাজনীতি তার সামনে এমন কোনো নেতা বা নায়ক আর সরবরাহ করছে না। করছে খেলা, কখনো ক্রিকেট আর কখনো-বা ফুটবল। বাংলাদেশের কিশোরীদের ক্রিকেটের এশিয়া কাপ জিতে আসার ঘটনাও যে অনাবিল আনন্দ ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল, বহুদিন রাজনীতির ময়দানে তেমন স্কোর কেউ করেছে বলে জানা নাই।
ফুটবলারদের কৌশল, দক্ষতা, আত্মরক্ষা বা আক্রমণের সময় তাদের লড়াকু ভঙ্গির মধ্যে মানুষ যার যার জীবনের সংগ্রাম ও সম্ভাবনার মহড়াই যেন দেখে। তালপাতার সেপাই বিজয়ী দলকে সমর্থন করে নিজের মধ্যে পালোয়ানের জোশ অনুভব করতে পারে। এই শরীরী খেলায় দর্শকের শরীরও টান টান হয়ে যায়, হাত-পা ছুড়ে, চিল্লিয়ে, রাগ বা উল্লাসে তারা একাকার হয়ে যায় স্টেডিয়ামের খেলোয়াড় ও দর্শকের সঙ্গে। খেলা শেষে মনে হয়, শরীর-মন যেন নিঃশেষিত হয়ে গেল—যেন অনেক পথ পার হয়ে এলাম।
মানুষ শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক প্রাণী। রাষ্ট্র ও রাজনীতির লাগাতার নেতিবাচক কার্যকলাপ থেকে মন সরানোর একটা জায়গা মানুষের দরকার ছিল। বিশ্বকাপের মাতোয়ারার মধ্যে তারা একটু দম ফেলার সুযোগ পেয়েছে। বন্ধু-পরিবার নিয়ে বাড়িতে একসঙ্গে বসতে পারছে, মাঝরাত অবধি অচেনা কিন্তু প্রিয় দলের সমর্থকের কাঁধে হাত রেখে রাস্তায় ঝোলানো বিশাল স্ক্রিনে খেলা দেখতে পারছে। ফুটবল নিয়ে পাগলামি, বাড়াবাড়ি, অন্ধ আবেগের পাশে এই ইতিবাচক আবেগের জোয়ারটাও সত্য। মানুষ সঙ্গ ভালোবাসে। একসঙ্গে মেতে ওঠার উপলক্ষ পেলে অনেকেই ছাড়তে চায় না। রাজনীতির জনসভা, মিছিল যে একাত্মতা আর দিতে পারছে না, সেই একাত্মতা তৈরি হতে পারে একসঙ্গে খেলা দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে।
‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ ও আর্জেন্টিনা–ব্রাজিল
একটা ‘কিন্তু’ তবু আছে। বাংলাদেশিরা ভীষণভাবে বিভক্ত জাতি। সবকিছুকেই আমরা দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি। খেলাতেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে দেশ তো বিভক্ত ছিলই। এখন বিশ্বকাপের মৌসুমে জাতি ভাগ হয়ে গেছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকে। বাঙালি আর বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের লড়াই ফুটবল জাতীয়তাবাদের জার্সি পড়ে ফেলেছে। দুই দলের মধ্যে দিনরাত অনলাইন খোঁচাখুঁচি বাস্তবেও দাগ কেটেছে। দুই পক্ষের সমর্থকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে কোপাকুপি-রক্তারক্তি করেও ফেলেছেন। ফুটবল মৌসুমে জাতীয় চরিত্রের এমন উদোম প্রদর্শনী ভালো লাগার কথা না।
এই বাইপোলারিটি বা দ্বিমুখী টান চরম হয়ে উঠলে অসুস্থতা আসে। মনোরোগের ভাষায় একে বলে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বিমেরু আচরণগত বিভ্রাট। এটা সুখ-দুঃখের এমন এক ভারসাম্যহীনতা, যার হয় সে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। তার হিসাব-নিকাশে ভুল হয়। ভালো থাকলেও সে ভোগে, খারাপ থাকলেও ভোগে। ভোগান্তি তার সহচর। একবার মনে পরমানন্দ জাগে, পরেই সে ডুবে যায় স্যাঁতসেঁতে বিষাদে। বাংলাদেশের দুটি রাজনৈতিক মেরুর মতো জাতীয় স্বভাবের মধ্যেও রয়েছে দুই বিপরীত মেরুর আবেগ: উচ্ছ্বাস ও বিষাদ। যখন একদল ক্ষমতার তেজে মহানন্দে বুক ফুলাচ্ছে, তখন অন্য দলের লোকেরা গভীর হতাশায় মুষড়ে পড়ছে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার হয় একই লোকের মনে। সমগ্র জাতিকে যদি একজন ব্যক্তি বলে ধরি, তবে ওই বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো স্পষ্ট দেখা যাবে। ফুটবল মৌসুমে উৎসবে মেতে ওঠা জাতি এখন আনন্দে আছে। বাইপোলার ডিসঅর্ডারের নিয়মে এর পরেই থাকবার কথা দুঃখের দরিয়া। খেলা শেষে আমাদের ফিরতে হবে সেই অকহতব্য বাস্তবতায়, যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়ছে; জীবন হয়ে পড়ছে কঠিন। ফুটবলের আফিমে মাসখানেক হয়তো ব্যথা ভুলে বুঁদ হয়ে থাকা যাবে টিভির পর্দায়; কিন্তু এই মধুমাস শেষ হয়ে আসছে নির্বাচনী হাঙ্গামার কঠিন সময়। আপনি রাজনীতি করেন না বলে লাভ নাই, রাজনীতি আপনাকে (ক্ষমতা প্রয়োগ) করবে। দেশসুদ্ধ শিশুর মতো ক্রীড়াসক্ত থাকার এই সময়ে রাজনীতির খেলোয়াড়েরা কিন্তু বসে নেই। আপনার-আমার ভাগ্যকে নিয়ে খেলার জন্য তারা তৈরি হচ্ছে। তখন ‘আমি তো ভাই খেলা নিয়ে ছিলাম’ বলে আপনি পার পাবেন না। সেই কঠিন ও অনিশ্চিত বাস্তবতার স্বাদ আপনাকে নিতে হবেই। সেই বাস্তবতায় স্বাগতম।
গ্যাংবাজি বনাম ক্লাব কালচার
খেলা দেখার সময় যে শক্তিশালী আবেগ, সংহতি ও রোমাঞ্চ আমাদের মধ্যে জাগে, পরে কেন তার কোনো রেশ আর থাকে না? এই আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে কেন আমরা পারি না এমন একটা টিম বানাতে, যারা বহন করবে আমাদেরই পতাকা, আর আমাদের দেবে আত্মবিশ্বাস? এখানেও কি বাইপোলারিটি নেই? দর্শক হিসেবে যতটা উদ্যমী আর হুজুগে আমরা, কাজের বেলায় তার সামান্যই দেখা মেলে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটির কথা ফুটবল সমঝদার সবাই জানেন। ম্যানচেস্টার ইংল্যান্ডের এক শিল্পশ্রমিকের শহর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই শহরে তরুণ গ্যাংগুলোর মারামারি আর ছোরা-সন্ত্রাসের মহামারি দেখা যায়। রাস্তায় প্রায়ই দুই গ্রুপের মারামারি লেগে যেত; শিকার হতো সাধারণ পথচারীরাও। ১৮৯০ সালের দিকে শহরটির কিছু দূরদর্শী মানুষ একটা বুদ্ধি করলেন। তাঁরা শহরজুড়ে শ্রমিক যুবকদের ক্লাব তৈরি করে বস্তিবাসী যুবকদের খেলা ও বিনোদনের সুযোগ করে দিলেন। তরুণ বয়সের গরম রক্ত সুস্থ খাতে বয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে মাস্তানি ছেড়ে দিল। মাস্তানির উন্মাদনার জায়গা নিল ফুটবল ‘উন্মাদনা’। সে সময়ই ওই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাব। বাকিটা ইতিহাস।
আধুনিক সময়েও ব্রাজিল ও কলম্বিয়া এই কৌশল নিয়ে সফল হয়েছে। মাস্তানপ্রবণ এলাকায় ফুটবল ক্লাব গড়ে দেওয়ার পর দেখা যায়, অপরাধ কমে গেছে। ওসব দেশ যে নিয়মিতভাবে ফুটবল প্রতিভা তুলে আনতে পারে, তার কারণ এসব সমাজমুখী উদ্যোগ। আমাদের কিশোর-তরুণেরা পাড়ায় পাড়ায় গ্যাংবাজি করে বেড়াচ্ছে। খুনোখুনি ও নেশায় নিজেরাও মরছে, দেশটাকেও ভোগাচ্ছে। যে মানসিক জোশ থেকে তারা গ্যাং বানায়, সেই জোশকে খেলাধুলার খাতে নিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু না। দুঃখিত, এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বের অভাব। রাজনৈতিক মাফিয়াতন্ত্র সহিংসতার জোশে জিইয়ে রাখছে নিজের গরজে। তাই যে গ্যাংগুলো ফুটবল ক্লাব হয়ে উঠতে পারত, তারা নির্বাচনের মাঠ দখলের পদাতিক হিসেবে প্রশিক্ষিত হচ্ছে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
উৎসঃ প্রথমআলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন