অনুভবে কল্পনাতে যে মিশে রয়

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২২ আগস্ট, ২০১৪, ১০:৫৪:৩৫ রাত



ঈদের সময়টাতে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ানোর মজাটাই আলাদা। সকল রাস্তা একদম ফাঁকা থাকে।আর গাড়ীও একেবারে কম। তবে আজ হারুন সাহেব মজা করতে বের হননি। তিনি নাজিমউদ্দীন রোডে যাবার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে যাচ্ছেন। দশ বছর সাজা খাটছে এমন একজনের সাথে দেখা করতে হবে।

নিজের অনুজ। বিডিআর বিদ্রোহে ওর শাস্তি হয়েছে। এর আগে কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কারাগারে ছিল। তখন একবার দেখা করেছিলেন। তা প্রায় চার বছর হতে চললো। এতগুলো বছর নিজের ভিতরে নিজেকে দগ্ধ করেছেন। কেন জানি দেখা করতে পারেননি। একটা সর্বগ্রাসী ভাঙ্গাচুড়া নিজের ভিতরে অনুভব করেছেন কেবল। ইচ্ছে থাকলেও দেখা করতে যাননি। যে ভাইকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, সেই প্রিয় অনুজকে চৌদ্দ শিকের ওপারে দেখতে হবে! একটু ছুঁতে পারবেন না... ভালোভাবে কথাও বলতে পারবেন না... আর বলবেনই বা কি? বলার আছেই বা কি?

বঙ্গবাজার ফ্লাইওভারের নীচে বাস থামতেই নেমে এলেন। একটা রিক্সা নিয়ে গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলেন। তখন ন'টা পার হয়েছে কেবল। এগারোটায় দেখা করার সময় নির্ধারিত। পুরনো ঢাকা তার নিজস্ব রুপের বাইরে কেমন যেন অন্য এক অবগুণ্ঠনে ঢেকে আছে। বেশীরভাগ দোকানপাটই বন্ধ। কয়েকটি 'বাকরখানি'র দোকান খোলা দেখতে পেলেন। ঈদের আজ তৃতীয় দিন। বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছেন। একটু ভালো-মন্দ বাসার খাবার, যেখানে প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া মিশানো রয়েছে, ভাইটি সেগুলো খাবে... আর ... আর কি? রিক্সা থেকে নেমে ভাবতে ভাবতে আগান।

নির্দিষ্ট স্থানে খাবারগুলো জমা দিয়ে দেখা করার ফর্ম পূরণ করে জমা দিলেন। খাবার যারা গ্রহন করছিল, তাদেরকে 'বখশিশ' দিতে হল। এখানে ঘাটে ঘাটে টাকার ছড়াছড়ি। একটু ম্লান হাসলেন। টাকা ছাড়া কোনো কিছুই হবার যো নেই। ফর্ম জমা দিতে গিয়ে কয়েকজনকে 'এক্সট্রা' টাকা দিতে দেখলেন দায়িত্বরত রক্ষীদেরকে। একজন ফর্মের সাথে 'ভোটার আইডি'র ফটোকপি দিতে অপারগ। বাসা থেকে আনতে ভুলে গেছেন। ১৫০ টাকা ভুলের মাশুল দিয়ে তার প্রিয়জনের সাথে দেখা করার ফর্ম জমা দিলেন। তারপরও খুশী মনে হল তাকে। কষ্টের ভিতরে এটুকু খুশী হচ্ছেন এমন হাজারো মানুষ রয়েছে।

এখনো প্রায় ঘন্টাখানিকেরও ওপরে অপেক্ষা করতে হবে। নিজের মোবাইল ও মানিব্যাগ নির্দিষ্ট স্থানে জমা দিয়ে টোকেন নিলেন। এখানেও অতিরিক্ত কিছু টাকা দিতে হল। তবে যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে গ্রহনকারীরা আদায় করছে। নির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ উল্লেখ করা নেই। আর প্রিয়জনের কাছে আসা মানুষগুলো এমনিতেই চিন্তা-ভাবনায় অধীর... তাই একটা ঘোরের ভিতরে সবাই 'চাহিবা মাত্র' দিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

একবার ওয়েটিং রুমে গেলেন। এখানে দুটো টয়লেট রয়েছে। তবে দেশের সবচেয়ে খারাপ টয়লেটের অবস্থাও মনে হয় এর থেকে ভালো। ভিতরে গিয়েই গা গুলিয়ে উঠে হারুন সাহেবের। কোনোমতে নিজেকে সামলে বের হয়ে খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ান। রোদের ভিতরে সকলে অপেক্ষা করছেন। হারুন সাহেবও তাদের ভীড়ের ভিতরে গিয়ে একজন হয়ে যান।

সামনে বিশাল দেয়াল। দেয়ালের গায়ে লেখা আছে, ' বাঊন্ডারির পাশে দাঁড়ানো নিষেধ। আইন অমান্যকারীকে আইনের আওতায় নেয়া হবে'। অথচ বেশীরভাগ মানুষই দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে খোশগল্প করছে। আসলে খোশগল্প না। এরা সবাই সময় পার করছে। কারারক্ষী এবং টহল পুলিশও তাদেরকে দেখছে। কিন্তু কারো কোনো বিকার নেই। আসলে আমাদের দেশে আইন মনে হয় কাগজে-কলমে লিখার ভিতরেই সীমাবদ্ধ। আর যা নিষেধ সবাই সেটাই বেশী করে করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

পৌনে এগারোটায় হারুন সাহেব দর্শনার্থীদের প্রবেশ করার স্থান দিয়ে ঢুকলেন। দোতলায় সাবেক বিডিআর মামলার আসামীদের সাথে দেখা করার জন্য নির্ধারিত। লোহার সিড়ি দিয়ে উঠলেন। স্বল্প পরিসর যায়গায় অনেক মানুষ। ভিতরে বাহিরে কয়েক পাল্লা শিকের দ্বারা দেখা করার যায়গাটি ঘিরে দেয়া।

'বড় ভাইয়া!' পরিচিত শব্দে শিকের ওপারে নিজের অনুজকে দেখেন। সেও প্রিয় বড় ভাইকে দেখে। একটা আনন্দ তীব্র বেদনাকে সাথে করে হৃদয়কে দলিত-মথিত করে চলে যায়। শিকের ভিতর দিয়ে প্রিয় মুখটিকে দেখেন... কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা চেহারা ঝাপসা অবয়ব নিয়ে দৃশ্যমান হয়। নিজের গাল বেয়ে উষ্ণ জলের কয়েকটি ফোটা নিম্নগামী হতেই গলার কাছে কি একটা যেন আটকে থাকার অনুভূতির সাথে নীল বেদনায় দম বন্ধ হয়ে আসে। মুহুর্তেই নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেস্টা...

আধাঘন্টা দেখা করার সময়। দশমিনিট কেটে যাবার পর আর বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পায়না দুজনের কেউই। প্রচন্ড চীৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। মহিলা-শিশু এবং আরো অনেক পুরুষের ভিড়ে কেমন এক ভয়ংকর পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না... ঠেলাঠেলি করে সবাই শিকের ওপারে প্রিয়জনের যতটুকু কাছে পারে যেতে চাইছে। অনুভবে তারা কল্পনার রথে চড়ে বাস্তবের সীমানাকে দূর করতে চাইছে যেন! প্রিয় মানুষগুলো তাদের এক একজনের ভাবনাতে মিশে থাকা সেই আগের সময়ের ওপারের এক একজন স্বাধীন মানুষে পরিণত হয়... কিন্ত আসলেই কি তাই?

সময়সীমা পার হবার পরে সকলের সাথে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হারুন সাহেবও নেমে আসেন। তার সাথে যারা যারা নেমে আসছেন এদের সকলেরই এক একটি গল্প রয়েছে। যে গল্পের শুরুটা অন্য কোনো ভিন্ন যায়গায়... কিন্তু এখন তাদের গল্পটির প্রান্তসীমা এই এখানে, ইটপাথরের এক নিষ্ঠুর সু-উচ্চ সীমানা প্রাচীরের ওপারে এসে সাময়িক থেমে আছে। নির্দিষ্ট সময় পার হলেই আবার তাদের নির্জীব গল্পের পাত্রপাত্রীরা প্রাণ ফিরে পাবে... লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙে রঙ্গীন হবে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড! কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত এদের সবার জীবনই সাদা-কালো জমিনে নীল রঙের তীব্রতায় পরিশ্রান্ত এক বিরহী বিকেল!

কারা-ক্যান্টিন থেকে সাধারণ জিনিসগুলো প্রিয় অনুজের জন্য তিন-চারগুন দামে কিনে দিতে দিতে হারুন সাহেব ভাবেন, এখন পর্যন্ত বিডিআর বিদ্রোহের সেই দিনটিতে আসলেই কি ঘটেছিল, আজো জানা হলো না। যে ভাইটি ছেলে বেলায় একটা পিপড়া মারতেও হৃদয়ে ব্যথা পেত... বড় হয়েও যার অন্য কোনো ক্রাইম রেকর্ড ছিল না... মনের দিক থেকে এমন শান্ত মানুষটি কিভাবে একটি দিনে এমন অশান্ত হয়ে উঠতে পারে?! যে সকল সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতি সম্পুর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই নিজের মনে তার অনেক প্রশ্ন জমে উঠে। সবসময়ই উঠেছে। আসলেই সেদিন কি হয়েছিল? নতুন সরকারের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর পিলখানায় সফরের দিনেও তো এই ঘটনাটি হতে পারতো? কেন হলো না? সেই রহস্যময় জীপে করে কারা সেদিন পিলখানায় ঢুকেছিল? তারা কিভাবে অদৃশ্য হল?

যাদেরকে বছরের পর বছর হাজতে রেখে বিচার করা হল, তারা সবাই ই কি আসলেই দোষী? সিআইডি'র জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কাহিনীই নিজ অনুজের কাছে জানতে পেরেছেন। কিভাবে তাদেরকে টর্চার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে... জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে পাঠানোর ভয় দেখিয়ে জবানবন্দী নেয়া হয়েছে, এমন অনেক কাহিনীই রয়েছে। কিন্তু যেহেতু আইনের মাধ্যমে এই সাধারণ সদস্যদেরকে একটা বিচারের রায় দিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই প্রকাশ্যে এখন আর কিছুই বলার নেই।

হারুন সাহেব ফাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরছেন... নিজের দেশের বিচারবিভাগের প্রতি তার শ্রদ্ধা না থেকেও মানতে বাধ্য হচ্ছেন। তার ভাই শাস্তি পেয়েছে বলেই যে এই শ্রদ্ধাহীন অবস্থা তা নয়। নিজের চাকরির সুবাদে বহু মামলায় টাকার বিনিময়ে মামলা দফারফা হতে দেখেছেন... আল্লাহ পাকের প্রতিকী আসনে আসীন দন্ডপ্রদানের ব্যক্তিদেরকে টাকার বিনিময়ে বিক্রী হতে দেখেছেন... সেই দৃষ্টি দিয়ে সকলকে এক পাল্লায় না মাপলেও অধিকাংশই যে এই ধরনের তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আর ক্ষমতার রাজনীতির নোংরা কুটচালে স্বাধীন হয়েও পরাধীন জীবনযাপনে বাধ্য আমাদের বিচারবিভাগ। সেখানে প্রধান নির্বাহীর ক্রীড়নক হতে সিস্টেমে বাধ্য না হলেও বিচারবিভাগের চেয়ারটি কেন জানি নীচুই হয়ে থাকে। না হলে ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীনের সরকারের সময়ে যখন একের পর এক রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বিচারের আওতায় এসেছিলেন, আবার তারাই একের পর এক নির্লজ্জ জামিনের স্রোতে শির উচু করে বের হয়েছিলেন! তবে সেদিন বিচারকেরা কি ঐ সরকারের টপ এক্সিকিটিভদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেই রায় দিচ্ছিলেন না? এখনো কি দেন না?

নিজের হৃদয়ে লালিত এক ঠান্ডা আগুন মুহুর্তে হারুন সাহেবের মতো এক ছাপোষা চাকরিজীবীকে ওলট পালোট করে দেয়। সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটা অসম এবং অক্ষম ক্রোধ তার সারা শরীরকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। পায়ের সামনে একটা তরল পানীয়ের খালি পরিত্যক্ত ক্যান দেখতে পান... সর্বশক্তি দিয়ে সেটাকে লাথি মারতেই সেটি উড়ে গিয়ে দেয়ালে একটা পোষ্টারের উপরে গিয়ে লাগে। সেখানে এ দেশের টপ এক্সিকিউটিভ হাসিমুখে চেয়ে আছেন। একজন সাধারণ পাবলিকের লাথিকে সাথে নিয়ে সেই ক্যানটি প্রধান নির্বাহীর মুখে আঘাত করে... তাতে ছবির মানুষটির কিছুই হয়না... হাসিটা তেমনি অমলিন থাকে। কিন্তু এভাবে একজন... দুজন... তিন...চার করে করে লাখো হারুন সাহেবেরা প্রস্তুত হয়ে আছেন... নিজেদের পীঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে... তাদের অনুভবে কল্পনাতে কিছু অক্ষমতা মিশে আছে, তা থেকে পরিত্রানের আশায় এভাবেই তারা যখন এক একটি কিক দিতে এগিয়ে আসবেন, করাপ্টেড সিস্টেমের বুনিয়াদ কিছুটা হলেও হেলে তো পড়বেই।

তবে সেই দিনটি কবে তা হারুন সাহেবও যেমন জানেন না, আমিও জানিনা। আপনারা কেউ জানেন কি? Good Luck Good Luck

বিষয়: বিবিধ

৯৮৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

257246
২৩ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:৫৯
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : চমৎকার লিখেন আপনি ভাইয়া। আমাদের এক আত্মীয় এই দুর্ঘটনার শিকার। বুঝতে পারি সেই পরিবারগুলোর সময়টা কিভাবে কেটেছে। ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Rose
২৩ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪৩
201009
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে এটি একটি রাষ্ট্রীয় ট্রাজেডি। সকল পরিবারের প্রতি (সামরিক বাহিনীর নিহত অফিসার এবং বিডিআর এর জওয়ান )রইলো সহমর্মিতা। শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
257274
২৩ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৩:৪৭
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২৩ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪৩
201010
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
257291
২৩ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:১৭
কাহাফ লিখেছেন : না জানলেও আশায় আছি, জালিমের এই মসনদ গুড়িয়ে দিতে আবার জেগে উঠবে মুক্তিকামী মজলুম জনতা......।
২৩ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:৪৪
201011
মামুন লিখেছেন : শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ রইলো আপনার জন্য। ভালো থাকবেন।Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File