সাদ্দাদের বেহেশ!! সত্যি নাকি মিথ্যা???

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ রিগান ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৯:৫২:৪৭ সকাল

মালাকুল মউত নাকি জীবনে ২ বার কেঁদে ছিলেন। একবার একটা নৌকা ডুবে গেলো । এক প্রেগন্যান্ট মহিলা অনেক কষ্টে একটা ভাসমান কাঠে উঠে বসলো। সাথে সাথেই তার বাচ্চা প্রসব হল। আল্লাহ মালাকুল মউতকে বললেন এই মহিলার জান কবজ কর। মালাকুল মউত কেঁদে দিলেন। ভাগ্যক্রমে এই ছেলেটাই বড় হয়ে ব্যাপক ক্ষমতার মালিক হয়ে গেলো। চাল চলনে সে হল আল্লাহরদ্রোহী। সে নিজে পৃথিবীর বুকে একটা বেহেশত বানালো। আল্লাহ তাকে বলল তুমি তো সারা জীবনেও আমাকে সিজদা করনি তারপরেও আমি তোমাকে বেহেশত বানানোর ক্ষমতা দিয়েছি। তবে তুমি বেহেশতের গেটটা বানাবে একটু ছোট করে । সেখান দিয়ে তুমি মাথা একটু নিচু করে ঢুকবে। সেই নিচু হয়ে ঢুকাকেই আমি মনে করবো তুমি আমাকে সিজদা করেছো। কিন্তু লোকটা সেই আবদার টুকুও রাখলো না। সে গেটে ঢুকল প্রথমে তার পা দিয়ে। আল্লাহ সাথে সাথে মালাকুল মউতকে বলল এর জান কবজ কর। শুনে মালাকুল মউত কেঁদে দিলেন। বলল এত কষ্ট করে বেচারা বেহেশত বানালো আর সেই বেহেশত সে সামান্য দেখতেও পারলো না!!! আল্লাহ বলল না, এখনি তার জান কবজ কর। কাহিনীকারদের মতে লোকটার নাম সাদ্দাদ। এই হল সংক্ষেপে আমাদের সমাজে প্রচলিত সাদ্দাদের কাহিনী।অনেকে বাড়িয়ে বলেন আগে বেহেশত ছিলো ৭টি, লোকটার বানানো বেহেশত আল্লাহ নিয়ে নেওয়াতে বেহেশত হল ৮টি(নাউজিবিল্লা)।

তবে ইতিহাসে বা কোরআন হাদিসে সাদ্দাদ বলে কেউ বেহেশত বানিয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই। আছে অন্য নামের এক লোক। লোকটার নাম হাসান ইবনে সাবা বা হাসান সাবা বা হাসান সাব্বা। মুসলিমদের মাঝে প্রধান ২টি ভাগ, শিয়া এবং সুন্নি। এই শিয়াদের মধ্যে আছে আবার শত শত দল-উপদল। এই দল-উপদলের একটা হচ্ছে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়। আপনাদের অনেকেই প্রিন্স আগা খানের নাম শুনে থাকবেন। এই প্রিন্স আগা খান হচ্ছে এখন ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ইমাম বা ধর্মীয় নেতা। আগা খান একটা টাইটেল। এখন যে আগা খান আছে তার নাম প্রিন্ম করিম আগা খান । তো, এই ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ে জন্ম নেয় এই হাসান ইবনে সাবা ১০৫০ সালের দিকে। মানে প্রায় ১ হাজার বছর আগে। হাসান সাবার জন্মের প্রায় শ’ দুই-তিনেক বছর আগে জন্ম হয় এই ইসমাইলিয়া ফেরকার। হাসান সাবার বাবা ছোটবেলা থেকেই হাসান সাবাকে গড়ে তোলেন একজন পাক্কা ইসমাইলিয়া রূপে।হাসান সাবাকে শিক্ষা দেওয়া হয় যাদু বিদ্যা। শিক্ষা দেওয়া হয় মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার সব রকম পদ্ধতি। এছাড়া মানুষকে সম্মোহন করার মত ক্ষমতা হাসান সাবার ছিলো জন্ম থেকে। তবে ইসমাইলিয়াদের একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে এরা নিজেদের প্রকাশ্যে প্রায় সময়েই মুসলিম বলে দাবী করে যদিও তাদের ইমান আকিদা মুসলিমদের চেয়েও অনেক ব্যাতিক্রম। তো হাসান সাবার বাবাও তাকে এবং তার ছেলেকে প্রকাশ্যে সবার সামনে মুসলিম বলে প্রচার করতো। সেই সময় প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম বিশ্ব শাসন করছে সেলজুক তুর্কিরা। তারা ছিলো নিবেদিত প্রাণ সুন্নি মোসলমান।

হাসান সাবার বন্ধু ছিলো আবার সেলজুক তুর্কিদের উজির(প্রধানমন্ত্রী) হাসান তুসি বা নিযামূল-মূলক এবং জগত বিখ্যাত ওমর খৈয়াম। নিযামূল-মূলকের মাধ্যমে হাসান সাবা সেলজুক তুর্কিদের অধীনে ভাল পদে কাজ করার সুযোগও পায়। কিন্তু বিশ্বাস ঘাতক হাসান সাবা ষড়যন্ত্র করে ফাঁসাতে চেয়েছিলো নিযামূল-মূলকেই। ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়াতে বের করে দেওয়া হয় তাকে। সুন্নি সেলজুকদের বিরুদ্ধে লেগে যায় হাসান সাবা। সুন্নিদের পরাজিত করা আর নিজেদের ইসমাইলিয়া মতকে প্রচারের জন্য চল-চাতুরী করে অনেক কেল্লা দখল করে নেয় হাসান সাবা। তার সদর দপ্তর গড়ে তোলে ইরানের দুর্গম এক কেল্লায়।

পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই কেল্লার নাম “ আলমূত কেল্লা”। আলামূত মানে “ঈগলের বাসা”। অর্থ শুনেই বুঝতে পারছেন দুর্গটা কতটা সুরক্ষিত। ইউটিউবে আলামূত ক্যাসেল লিখে সার্চ দিয়ে দেখে নিতে পারেন।

নিজের মতবাদ প্রচারের জন্য সে হাজার হাজার জানবাজ সিপাহী তৈরি করলো। তাদের বলা হত “ফেদাইন” যার অর্থ নিবেদিত প্রান বা জানবাজ। এরা সরাসরি কারো সাথে যুদ্ধ করতো না। এদের বেশির ভাগ আক্রমনেই হত চোরাগুপ্তা।এরা তাদের ইমাম হাসান সাবার প্রতি এতই নিবেদিত ছিলো যে হাসান সাবার নামে তারা হাসতে হাসতে প্রাণও দিতে পারতো। এরা কোন শত্রুকে হত্যা করার পর নিজেরাই আত্মহত্যা করতো। মরার আগে বলতো হাসান সাবা জিন্দাবাদ বা শাইখুল জাবাল জিন্দাবাদ। হাসান সাবাকে তারা বলতো শাইখুল জাবাল বা পাহাড়ের মহান বৃদ্ধ।

এরা অহরহ এখানে সেখানে মানুষ মারতো। সেলজুক প্রশাসনের অনেক বড়বড় মানুষকে মেরে ফেলে এই ফেদাইন বাহিনী। সেলজুকিদের টনক নড়লো। তারা অনেক কষ্টে কিছু ফেদাইনকে পাকড়ো করলো, তাদের গোয়েন্দা লেলিয়ে দিলো হাসান সাবার পিছনে। তারা দেখতে চাইলো কি এমন শক্তি যেটার দ্বারা হাসান সাবা মানুষকে তার এর অনুগত করে ফেলে!!! হাসতে হাসতে মানুষ হাসান সাবার নামে প্রাণ দিয়ে দেয়!!!

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসলো এক ভয়াবহ ব্যাপার। হাসান সাবা নানা জাদুমন্ত্র আর চালাকি করে বোকা মানুষদের এই বিশ্বাস করালো যে সে আল্লাহর প্রেরিত মানুষ। অনেকে তাকে ইমাম বলতো, অনেকে বলতো নবী! হাসান সাবার সব চেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো তার নিজের ফর্মুলায় তৈরী এক প্রকার শরবত। যাতে সে হাশীশ নামের এক প্রকার নেশা দ্রব্য মিশিয়ে দিতো। কারো কারো মতে হাশীশ হল আধুনিক গাঁজা আবার কারো মতে হাশীশ হল হেরোইন। এই দ্রব্য কাউকে খাইয়ে দিলে সে এক ঘোরের রাজ্যে চলে যেতো। তখন হাসান সাবা চালতো তার সব চেয়ে বড় চাল। ইরানের এক অজ্ঞাত স্থানে সে কোরানে বর্ণিত বেহেশতের অনুকরণে এক জায়গা তৈরী করলো। সেই জায়গায় সে ছেড়ে দিলো কিছু সুন্দরী মেয়ে। মেয়েদের বানালো সে তার বেহেশতের “হুর”। তারপর সেই ঘোরে পড়া লোককে এনে ফেলা হত এই নকল বেহেশতে। নেশার ঘোরে থাকার কারনে লোকটা ভাবতো সে এসে পড়েছে বেহেশতে।

তারপর ঘোর থেকে জাগার পর সে হয়ে পড়তো হাসান সাবার অনুগত। হাসান সাবা যেটাই বলতো তারপর থেকে লোক গুলো সেটাই মেনে চলতো। এছাড়া হাসান সাবার জাদুকরী কথা বলার স্টাইল মানুষকে বেশী প্রভাবিত করতো। সাবার জ্ঞানও ছিলো প্রচুর। কথিত আছে সে তার দূর্গ আলামূতের ভিতরে এক বিরাট লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলো। ফলে তার ব্যাক্তিত্ত মানুষকে দারুণ প্রভাবিত করতো। তার অনুসারীরা এতই তার অনুগত ছিলো যে সেলজুক সুলতানের গদি প্রায় কেঁপে উঠতো। তার গুপ্তঘাতকের হাতে মারা পড়তে থাকে সেলজুকের ইমাম, ধর্মীয় নেতা, সেনা অফিসার এমন কি সেলজুক সুলতান আর উজিরে আজম নিযামূল মূলকও মারা পড়েন হাসানের বাহিনীর হাতে। গুপ্তঘাতকেরা হাশীশ নামক নেশা করত বলে এদের বাহিরের দুনিয়া ডাকতো হাশাশীন নামে। সেখান থেকেই ইংরেজি এশাশিন(Assassin) শব্দের উৎপত্তি। Assassin শব্দের অর্থ গুপ্তঘাতক।

হাসান সাবার দলের লোকেদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে সে সময়ের বড় বড় সুন্নী আলেমেরা এদের মারা ফরজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলো। ফলে বিভিন্ন শহরে তাদের খুঁজে খুঁজে পাইকারীদরে মারা হতে লাগলো। এই ব্যাপক হত্যার ফলে কমে আসতে থাকে হাসান সাবার অত্যাচার।

সব শেষে কেল্লা আলামূত অবরোধ করে সেলজুক তুর্কীরা। কিন্তু পাহাড়ের উপর কেল্লা হওয়াতে তেমন সুবিধা করতে পারেনি সুন্নি মুসলিমরা, জয়ও করতে পারছিলো না। এই দিকে দীর্ঘ দিন অবরোধে থাকার ফলে কেল্লার ভিতরে অভাব দেখা দেয়। সন্ধি চুক্তি করতে রাজি হয় হাসান সাবা। সুন্নিদের সাথে তার মতবাদ প্রচার করবেনা শর্তে চুক্তি করার ২ বছর পরে ১১২৪ সালে মারা যায় হাসান সাবা। তার মৃত্যুর পর তার দল ৩০টার মত দলে ভাগ হয়ে গিয়ে ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করতে লাগলো বিভিন্ন জায়গায়। ইসমাইলিয়াদের কাছে এখনো হাসান সাবা এক মহান মানুষ। আর সারা পৃথিবীর মুসলিম কাছে সে এক বাতীনি ফিতনার নাম। এখনো বিজ্ঞ আলেমেরা তার নাম শুনলে আঁতকে উঠে। প্রাচাত্যের দুনিয়া এখনো তার মোটিবেশন পাওয়ার নিয়ে গবেষণা করে। তাকে নিয়ে তথ্য এক সাথে খুব বেশি পাবেন না। তাকে নিয়ে এনাউতুল্লা আলতামিস শয়তানের বেহেশত নামের প্রায় ৬০০ পেজের এক বই লিখেছেন। সেটা পড়ে দেখতে পারেন এছাড়া গুগোল এবং ইউটিউবে সার্চ দিয়েও কিছু ডাটা পেতে পারেন। ইসমাইলিয়াদের নিয়ে ইংরেজিতেও কিছু বই লিখা হয়েছে। সে গুলো খুঁজে পড়ে দেখতে পারেন।

বিষয়: বিবিধ

৩৮৭৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381342
১৯ জানুয়ারি ২০১৭ সকাল ১১:৫৫
বিবর্ন সন্ধা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম,,

সত্য - মিথ্যা বুঝিনি
কিন্তু পড়ে মজা পেয়েছি Rolling on the Floor
381344
১৯ জানুয়ারি ২০১৭ সন্ধ্যা ০৭:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য ধন্যবাদ। আলামূত দুর্গেই ছিল হাসান আস সাবাহ এর তথাকথিত বেহশত। হাশশাসিন না ক্রুসেডার দের ভাড়াটিয়া হিসেবেও কাজ করত।
381353
২০ জানুয়ারি ২০১৭ সকাল ০৫:২৮
দ্য স্লেভ লিখেছেন : অনেক দারুন লাগল। এসাসিনরা এখনও ভিন্নভাবে আছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File