আল নূর কালচারাল সেন্টার দোহা এর পাক্ষিক আলোচনা সভা

লিখেছেন লিখেছেন খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ ০৯ নভেম্বর, ২০১৫, ১০:৫৮:১৯ রাত

গত ৬ ই নভেম্বর ২০১৫ শুক্রবার বাদে ইশা আল নূর কালচারাল সেন্টার দোহা এর পাক্ষিক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় দোহাস্থ ফানার মিলনায়তনে। আল নূর কালচারাল সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা ইউছুফ নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মুসলমানী জীবন বিষয়ে আলোচনা করি আমি। আলোচনার বিষয় ছিল মুসলমানী জীবন। তা নিম্নে দেয়া হল।

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

হামদ ও ছানার পর

সম্মানিত সভাপতি, উপস্থিত বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম ও দীন দরদি ভাইয়েরা। আমরা প্রথমেই আল্লাহ্‌ তা’লার লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করছি যে তিনি আমাদেরকে দয়া করে মুসলমান বানিয়েছেন। এবং আনলূর কালচারাল সেন্টার দোহা এর আজকের এই ইসলামী অনুষ্ঠানে আমাদেরকে আসার সুযোগ দিয়েছেন। আলহামদু লিল্লাহ।

আল্লাহ্‌ তালা আমাদেরকে কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু এমনি এমনি সৃষ্টি করেন নি। তিনি বলেনأَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ

তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? সুরা মুমিনুন ১১৫।

আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে তার উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন যে وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

আমার এবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। সুরা জারিয়াত ৫৬।

তাহলে বুঝাই গেল আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য। আমরা যদি আল্লাহর ইবাদাতই করতে থাকি তাহলে আমাদের খানাপিনা কে জোগাড় করবে? এর জবাবেও আল্লাহ্‌ বলেন, وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُم مِّنْ إِمْلَاقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে?480; কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। সুরা ইনআম ১৫১।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেন, وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا ۖ لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا ۖ نَّحْنُ نَرْزُقُكَ ۗ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَىٰ [٢٠:١٣٢]

আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাযের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোন রিযিক চাই না। আমি আপনাকে রিযিক দেই এবং আল্লাহ ভীরুতার পরিণাম শুভ। সুরা তোয়া হা ১৩২।

উপরের আয়াতগুলো থেকে বুঝা গেল যে আমাদেরকে অযথা সৃষ্টি করা হয়নি বরং আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য। আর আমাদেরকে রিজিক দেয়ার ওয়াদা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা’লা।

কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি যদি আমাদেরকে কিছু দেয়ার দায়িত্ব নেয় তখন আমরা নিশ্চিত থাকি যে তিনি তা আমাকে দিবেন। কারণ তার সেই ক্ষমতা আছে এবং তিনি ওয়াদাও খেলাপ করেন না। তাহলে আল্লাহ্‌ যখন আমাদের কাছে রিজিক পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন আমারা নিশ্চিন্তে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল হতে পারি। আমাদের রিজিক ঠিকমত পৌঁছে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। হাদিসে আছে إن الرزق ليطلب العبد كما يطلبه أجله অর্থ রিজিক বান্দাকে এমনভাবে তালাশ করে যেভাবে মৃত্য তাকে তালাশ করে। আবু দাউদ।

তো মৃত্যু কাওকে খোঁজে পায়নি এরকম কোনো নজির নাই। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে যে রিজিক আমাদের কাছে ঠিকই পৌঁছে যাবে। এই কোরান আল্লাহর বানী তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এটা আমরা ১০০% বিশ্বাস করি। এবার আসা যাক আমাদেরকে যে বলা হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য, এই ইবাদাত আসলে কী? অনেকেই মনে করেন যে শুধু নামাজ রোজা আর কোরান তেলায়াতের মত নির্দিষ্ট কিছু কাজকে ইবাদাত বলা হয়, আসলে তা সঠিক নয়। মানুষের জীবনের সমস্ত কাজই ইবাদাত। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুম যাওয়া পর্যন্ত এমনকি ঘুমটাও ইবাদত। ঘুম কীভাবে ইবাদত হয়? ঘুম তো আমি নিজের জন্য যাচ্ছি। হ্যাঁ নিজের জন্য ঘুমান অথবা ছেলে মেয়ে স্ত্রীর জন্য টাকা পয়সা রোজগার করুন, সব কিছুই আল্লাহর ইবাদাত হয়ে যাবে যখন তা আল্লাহর হুমুক মত হবে। ইসলাম ধর্ম কিছু নির্দিষ্ট কাজের নাম নয়। আর অন্যান্য ধর্মের মত যা ভাল মনে হয়েছে তাই ধর্মের কাজ মনে করারও সুযোগ ইসলামে নাই। ইসলাম মানুষের সমস্ত জীবনের সমস্ত দিকের দিকনির্দেশনা দিয়েছে যা অন্য কোনও ধর্ম দিতে পারেনি। তাই তারা যা ভাল লাগে সেটাকেই ধর্মের কাজ মনে করে থাকে। কিন্তু ইসলামে যেহেতু সব কিছুর নির্দেশনা আছে তাই আল্লাহর আদেশ রাসুল সঃ এর তরিকার নামই ইসলাম। এখানে আমাদের প্রয়োজনে আমাদের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যা আমরা যা করব এর সবকিছুর নিয়ম রয়েছে এবং সেই নিয়ম মেনে করলে তা আল্লাহর ইবাদত হয়ে যাবে। এর জন্য আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাব।

ঘুম কীভাবে এবাদত হয়। কথায় বলে আলেমের ঘুমও নাকি এবাদত। হ্যাঁ। আসলেই তাই। নিয়ম মেনে ঘুমালে আপনার ঘুমও ইবাদত হয়ে যাবে। একটি উপমা বলি। এটি হযরত আশরাফ আলী থানভী রহঃ তার কিতাবে বলেছেন। যেমন ধরুন কোনো কাটমিস্ত্রী আপনার বাড়িতে দিনের হিসেবে কাজ করছে। কিছুক্ষণ কাজ করার পরে সে একটু জিরাই, আবার কিছুক্ষণ কাজ করে তার যন্ত্রগুলোতে ধার দেয়। এই যে তার যন্ত্রে সে ধার দিচ্ছে এর জন্যেও কিন্তু আপনি তাকে বেতন দিচ্ছেন। এভাবে মুসলমানের ঘুমও ইবাদত।

কিছু কিছু মানুষ মনে করে যে কিছু নির্দিষ্ট আমলের নাম ইবাদত। না, এটা সঠিক নয়। সাধারণত যেসব কাজগুলোকে ইবাদাত মনে করা হয় সেগুলো ইবাদাত ঠিক আছে। কিন্তু আর সাথে সাথে ইসলাম মানুষের সমস্ত কাজকে ইবাদাত ঘোষণা করেছে। এইসব কাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন ১ আকায়েদ, ২ / ইবাদাত, ৩/ মুআমালাত বা লেনদেন, ৪/ মুআশারাত বা আচরণ।

এগুলোর প্রত্যেকটিতে হাজার হাজার বই পত্র লেখা হয়েছে। অল্প সময়ে সেদিকে যাওয়া সম্ভব নয়। আজ একেবারে শেষ নম্বরেরটা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে ইনশা আল্লাহ্‌। শেষ নম্বরটি হল মুআশারাত বা আচরণ। এটি আমাদের জীবনের সাথে উতপ্রোতভাবে জড়িত। এ থেকে কোনো মানুষ মুক্ত নয় হতে পারে না। কারণ মানুষ সামাজিক জীব। একা একা মানুষ বাস করতে পারে না। তাকে সমাজে প্রতিবেশীদের সাথে মিলে মিশে বাস করতে হয়। সুখে দুঃখে একে অপরের পাশে থাকতে হয়। এ কারণে মুআশারাত নিয়ে আমাদেরকে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া জরুরী। এই মুআশারাত ভাল হলে অনেক বেশি ছওয়াব পাওয়া যায়। অন্য দিকে মুআশারাত খারাপ হলে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

মুআশারাত এর মধ্যে সর্ব প্রথম আসবে বাড়ির লোকদের সাথে সদ্ব্যবহার। ছোটদেরকে স্নেহ আর বড়দেরকে সম্মান করা। হাদিসে আছে ليس منا من لم يرحم صغيرنا ويوقر كبيرنا অর্থ যে ব্যক্তি ছোটদের উপর দয়া করে না আর বড়দেরকে সম্মান করে না সে আমাদের মধ্য থেকে নয়।

ঘরের মধ্যেও মোটামুটি কিছুটা ভাল আচরণ করা হয়। কিন্তু আজকাল মারাত্মক আকার ধারণ করেছে প্রতিবেশীর সাথে দুর্ব্যবহার। এই প্রতিবেশীর সাথে ভাল আচরণের জন্য হাদিসে এত বেশি তাগিদ এসেছে যে রাসুল সঃ বলেন আমর তো মনে হচ্ছিল যে প্রতিবেশীকে আমার ওয়ারিচ বানিয়ে দেয়া হবে কিনা।

প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারের ফলে মানুষের সামাজিক জীবন শান্তিময় আর সুখের হয়। আর যদি প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাদের সাথে ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকে, অনেক সময় মারামারি কাটাকাটি মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়। পরিণতিতে সামাজিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি। কোরান ও হাদিস শরিফে প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারের জন্য বার বার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا [٤:٣٦]

আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। সুরা নিসা, ৩৬।

لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَىٰ حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا ۖ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ [٢:١٧٧]

সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার। সুরা বাকারা, ১৭৭।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, عن أبي هريرة ، أن رسول الله - صلى الله عليه وآله وسلم - قال : " والله لا يؤمن ، والله لا يؤمن ، والله لا يؤمن " قالوا : وما ذاك يا رسول الله ؟ قال : " جار لا يأمن جاره بوائقه " قالوا : وما بوائقه ؟ قال : " شره "হযরত রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কসম ওই ব্যক্তি ইমানদার নয়, আল্লাহর কসম ওই ব্যক্তি ইমানদার নয়, আল্লাহর কসম ওই ব্যক্তি ইমানদার নয়। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রসূলাল্লাহ! ওই ব্যক্তি কে? তিনি উত্তরে বলেন ওই ব্যক্তি যার অত্যাচার ও অপকার হতে তার প্রতিবেশী লোকেরা নিরাপদে থাকে না। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)

عن أبي هريرة رضي الله عنه ، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : من كان يؤمن بالله واليوم الآخر ، فليقل خيرا أو ليصمت ، ومن كان يؤمن بالله واليوم الآخر ، فليكرم جاره ، ومن كان يؤمن بالله واليوم الآخر ، فليكرم ضيفه رواه البخاري ومسلم . হযরত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার মেহমান-অতিথিকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাক ও কিয়ামতের দিনের বিশ্বাস রাখে সে যেন সর্বদা ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি ও মুসলিম শরীফ)

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، فُلانَةُ تَصُومُ النَّهَارَ ، وَتَقُومُ اللَّيْلَ ، وَتُؤْذِي جِيرَانَهَا ، قَالَ : " هِيَ فِي النَّارِ " ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، فُلانَةُ تُصَلِّي الْمَكْتُوبَاتِ ، وَتَصَدَّقُ بِالأَثْوَارِ مِنَ الأَقِطِ ، وَلا تُؤْذِي جِيرَانَهَا ، قَالَ : " هِيَ فِي الْجَنَّةِ " .

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রসূলুল্লাহ! অমুক মহিলা অধিক নামাজ, রোজা ও দান-সদকার কারণে তাকে স্মরণ করা হয়, তবে সে তার জবান দ্বারা তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে থাকে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী। ওই ব্যক্তি আরও জিজ্ঞাসা করল ইয়া রসূলুল্লাহ! অমুক মহিলা অল্প রোজা, অল্প দান-সদকা ও অল্প নামাজের বিষয় মানুষের মধ্যে আলোচনা করে। তবে সে পনিরের টুকরা বিশেষভাবে দান করে থাকে এবং তার জবান দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রসূলুল্লাহ (দHappy বললেন, সে জান্নাতি।

অতএব আমাদের উচিত প্রতিবেশীদের অধিকারগুলো যথারীতি আদায় করা। যেমন দান, সদকা, খাওয়ানো, সাহায্য-সহযোগিতা করা, ঋণদান, সেবা-শুশ্র“ষা, প্রতিবেশীদের কোনও ধরনের কষ্ট না দেওয়া এবং সর্বাবস্থায় তাদের কল্যাণ কামনা করা ইত্যাদি হক আদায় করা ঈমানের দাবি।

কিন্তু আজকাল আমরা অনেকেই প্রতিবেশীদের খোঁজ খবরই রাখি না। আমাদের আশেপাশে এমন গরীব পরিবারও আছে, যাদের গোস্ত খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো সেই কোরবানির ঈদের সময়। সারা বছর আর গোস্ত খাওয়া হয়নি। অথচ আপনার আমার বাড়িতে সপ্তাহে তিন চার দিন মাছ গোস্ত না হলে চলেই না। গ্রামের গরীব মানুষেরা প্রায় সময় খাল বিল থেকে কুড়িয়ে আনা শাক দিয়ে ভাত খায়। আমাদের উচিত রান্না করা ভালো তরকারি থেকে গরিব প্রতিবেশীকে কিছুটা দেওয়া। وعن ابن عباس - رضي الله عنهما - قال : سمعت رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول : ليس المؤمن بالذي يشبع وجاره جائع إلى جنبه " " . হযরত ইবনে আব্বাস (রাHappy হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি হযরত রসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ওই ব্যক্তি ইমানদার নয়, যে ব্যক্তি উদরপূর্তি করে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (বায়হাকী শরীফ)।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ‘তোমরা যখন তরকারী রান্না করবে তখন শুরবা [ঝোল] একটু বাড়িয়ে দিবে, যাতে তোমার প্রতিবেশীকেও কিছুটা দিতে পারো। [মুসলিম শরিফ ]

ভোগের মধ্যে যে আনন্দ আছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আনন্দ আছে ত্যাগের মধ্যে। তাইতো কবি বলেন।

''পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলই দাও

তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

আসে নাই কেহ অবনীপরে'

সকলের তরে সকলে আমরা

প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।''

প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহারে সওয়াবও পাওয়া যায় আবার তার সুফল আমাদের সামাজিক জীবনে আমরা নিজেরাই ভোগ করে উপকৃত হতে পারি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রত্যেকেই একে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। কেউ নিজে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমরা প্রত্যেকেরই প্রতিবেশীর সাহায্য নেয়া প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিবেশী তখনই আপনার আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে যখন তাদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক থাকবে। আর যদি তা না থাকে তাহলে কেউই কারো সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। তখন আমরা যে শুধু গুনাহগার হব তা নয়, আমরা মানবতার সীমা ছাড়িয়ে পশুত্বের স্তরে নেমে যাব। মানুষের সাহায্য করলে আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সাহায্য করবেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

، وَإِنَّ اللَّهَ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَادَامَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ

‘আল্লাহ্ ততক্ষণ তার বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সেই বান্দাহ্ তার ভাইয়ের সাহায্যে লিপ্ত থাকে।’ {মুসলিম, তিরমিজি }

আরেকটি হাদিসে আছে عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَسَلَّمَ : " الْخَلْقُ عِيَالُ اللَّهِ ، فَأَحَبُّ الْخَلْقِ إِلَى اللَّهِ مَنْ أَحْسَنَ إِلَى عِيَالِهِ " “মখলুক হচ্ছে আল্লাহর পরিবার বিশেষ, সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁর এ পরিবারের সংগে সদাচরণ করলো, আল্লাহর কাছে তাঁর মাখলুকের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়।’ (বায়হাকী)

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজকাল আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে প্রতিবেশীর উপকার বাস্তবেও করে না আর মনে মনেও প্রতিবেশীর ভাল হোক তা চায় না। একে অপরকে হিংসা করে। কারো উন্নতি দেখলে মন খারাপ করে। শুধু অন্যের ক্ষতি কিভাবে করা যায় তার পেছনে লেগে থাকে। এটা একটা মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। এটা মুসলমানের আচরণ হতে পারে না। হাদিসে আছে “المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده”। অর্থাৎ প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। অন্য হাদিসে আরও আছে عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " الْحَسَدُ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ كَمَا تَأْكُلُ النَّارُ الْحَطَبَ ، وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ الْمَاءُ النَّارَ ، وَالصَّلاةُ نُورُ الْمُؤْمِنِ ، وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ مِنَ النَّارِ “হিংসা ইবাদতকে এভাবে জ্বালিয়ে দেয় যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে দেয়”। ছদকা গোনাহকে নিভিয়ে দেয় যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়, আর নামাজ মুমিনের নূর, আর রোজা আগুন থেকে বাঁচার ঢাল স্বরূপ। অন্য হাদিসে আছে, عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال { إياكم والحسد فإن الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب খবরদার হিংসা থেকে বেঁচে থাক, কেননা হিংসা নেক আমলকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে। আবু দাউদ।

এক হিংসুকের কিসসা প্রচলিত আছে। যে কিনা তার প্রতিবেশীর উন্নতি সহ্য করতে পারতো না, বরং প্রতিবেশীর ক্ষতি কামনা করতো। এক দিন সেই ব্যক্তির কাছে এক ফেরেশতা এসে বলল হে অমুক আমি আল্লাহর হুকুমে এসেছি তোমার কাছে। তুমি যা চাইবে তাই দেব তোমাকে। তবে একটি শর্ত আছে, তা হলো: তোমাকে যা দেওয়া হবে তার দ্বিগুণ দেওয়া হবে তোমার প্রতিবেশীকে। অর্থাৎ তুমি যদি একটি বাড়ি চাও তা তোমাকে দেওয়া হবে আর তোমার প্রতিবেশীকে দেওয়া হবে দু’টি বাড়ি। তুমি এক কোটি টাকা চাইলে তা তুমি পাবে আর তোমার প্রতিবেশী পাবে দুই কোটি টাকা। তুমি কি চাও বল। তখন সে হিংসুক বলল “আমি চাই যে আমার একটি চোখ কানা করে দেওয়া হোক”। এখানে হিংসুক ব্যক্তি নিজের এক চোখ কানা করে হলেও প্রতিবেশীর দুই চোখ কানা করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এর চেয়ে খারাপ প্রতিবেশী আর কে হতে পারে।

আজকাল আমাদের অবস্থাও হয়েছে সেই হিংসুকের মত। কারো মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে কিভাবে মেয়ের বদনাম করে ছেলে পক্ষকে তাড়িয়ে দেবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় অনেকের মধ্যে। নিজের গাঁটের পয়সায় গাড়ি ভাড়া দিয়ে বদনাম করতে যায়। তাহলে আমরা কিভাবে নিজেকে মুসলমান হিসেবে দাবি করতে পারি! আমাদের এই স্বভাবের পরিবর্তন হওয়া দরকার। মুসলমান হিসেবে নিজের চরিত্র গঠন এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভলো আচরণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাতে আমাদের নিজেদের সামাজিক জীবনও সুখের হবে এবং আল্লাহ তা’লার কঠিন শাস্তি থেকেও আমরা বাঁচতে পারব।

প্রতিবেশীদের মধ্যে আরেকটি মারাত্মক অপরাধ প্রবণতা প্রচলিত আছে তাহলো গীবত করা। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ বর্ণনা করার নাম গীবত। এই গীবতের কারণে অনেক সময় ঝগড়া-ফ্যাসাদ পর্যন্ত হয়ে যায়। এই গীবত এত বেশি করা হয় যেন এটা কোনো অপরাধই না। অথচ গীবত করা মহাপাপ। আল্লাহ তালা বলেন।

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ]

মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গোনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। সুরা হুজুরাত, ১০-১২।

প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য নিম্নবর্ণিত কাজগুলোর প্রতি আমাদের খেয়াল রাখা দরকার :

* আগে সালাম দেওয়া।

* হাসি মুখে কথা বলা।

* খোঁজ-খবর নেয়া, কুশলাদী জিজ্ঞেস করা।

* ধার-কর্জ দেওয়া।

* অসুখ-বিসুখ হলে সেবা করা।

* সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণ করা।

* মাঝে মাঝে হাদিয়া দেওয়া।

* গরীব প্রতিবেশীদেরকে আর্থিক সাহায্য করা।

* যে কোনো ভাল কাজে সহযোগিতা করা।

* প্রতিবেশীর গীবত না করা।

* ঝগড়া-ফ্যাসাদ মীমাংসা করা।

আমরা যদি প্রতিবেশীদের সাথে এভাবে চলি তাহলে আশা করা যায় আমাদের সামাজিক জীবন আরো সুন্দর, আরো সুখের এবং আরো আনন্দময় হবে ইনশা’আল্লাহ।

*০*০*০*০

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।

তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মার পরিশুদ্ধি করা প্রয়োজন।

লোভ লালসাকে যদি ত্যাগ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, জবাবদিহিতার ভয় যদি অন্তরে সদা জাগ্রত থাকে, ধরা না পড়ে রেহাই নেই বরং অপরাধী ধরা পড়বেই এরকম দৃঢ় বিশ্বাস যদি মনে থাকে, আর রোজ কিয়ামতে কারো ক্ষমতা থাকবে না একমাত্র পরাক্রমশালী আল্লাহ তালার ক্ষমতাই চলবে, তাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে না এই বিশ্বাস নিয়ে যদি কেউ দায়িত্ব পালন করে তাহলে কারো পক্ষে অপরাধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই কথাগুলি অনেকেরই মুখস্থ আছে তার পরেও তারা অপরাধ করছে। কিন্তু কেন? তাহলে বাঁচার উপায় কি?

আমরা এমন অনেক কিছুই জানি যা জানা থাকা সত্ত্বেও উপায় উপকরণ আর প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে তার উপর আমল করতে পারি না। আর যদি উপায় উপকরণ আর প্রশিক্ষণ থাকে তাহলে জানা বিষয়গুলোর উপর আমরা আমল করে দেখাতে পারি খুব সহজেই।

মানুষের মধ্যে সাধারণত অহংকার, হিংসা, দুনিয়ার লোভ-লালসা, আখেরাত সম্পর্কে উদাসীনতা, গুনাহের প্রতি আগ্রহ ইত্যাদি দোষ-ত্র“টিগুলি থাকে। এই সমস্ত দোষ-ত্র“টিগুলি শয়তানের কুমন্ত্রণারদ্বারা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল্লাহর নেক বান্দাগণ রিয়াজাত আর মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করেছেন তাই তারা শয়তানের এসমস্ত ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন এবং সহজে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারেন। আর যারা তাদের সংস্পর্শে এসে তাদের কাছ থেকে শয়তান আর নফসের ধোঁকা থেকে বাঁচার বিভিন্ন তদবির শিখেন তারাও শয়তানের ধোঁকা সম্পর্কে সহজে অবগত হন এবং তারাও সহজে বাঁচতে পারেন। আল্লাহর নেক বান্দাগণের বাতানো রাস্তায় চলার কারণে নফসের বিভিন্ন দোষ-ত্র“টি আস্তে আস্তে ত্যাগ করা সহজ হয়ে যায়। এটাই হল অপরাধ ত্যাগ করা আর ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার সহজ করার প্রশিক্ষণ; যাকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। অর্থাৎ অন্তর পবিত্র করা।

আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত (সুরা জুমুআহ Ñ আয়াত ২)।

ভালো বা মন্দ যেকোনোও কাজ করার আগে মানুষ তা করার ইচ্ছে করে অন্তরে। অন্তরই মানুষের এক প্রকার পরিচালক বলা যায়। যাকে আরবীতে বলা হয় কলব قلب অন্তরের ইচ্ছেটাকেই পরে মানুষ কর্মে পরিণত করে। এই অন্তর যদি ভাল হয় তাহলে মানুষের কাজও ভাল হয় আর অন্তর যদি খারাপ হয় তাহলে মানুষের কাজও খারাপ হয়। হাদিসে এসেছে হযরত রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: الا إن فى الجسد مضغة إذا صلحت صلح الجسد كله وإذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب অর্থাৎ 'জেনে রেখো, মানবদেহের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো রয়েছে। যখন তা সংশোধিত ও বিশুদ্ধ হয়ে যায়, পুরো শরীরই তখন বিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন তাহা অপবিত্র বা অশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন গোটা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। অতএব জেনে রেখো যে, তা হচ্ছে অন্তর (সহিহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান)।

তাযকিয়া বলা হয় অন্তরের পবিত্রতাকে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তা-চেতনাকে নির্লজ্জতা আর দুনিয়াবি লোভ-লালসা থেকে পবিত্র করে তাতে আখিরাতের ভয় আর আল্লাহর মুহাব্বাত সৃষ্টি করে দেওয়া। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে যেসব দোষ-ত্রুটি থাকে, তা কিছু আমল এর মাধ্যমে বের করে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন রিয়া [লোকদেখানো ইবাদত] অহংকার, লোভ লালসা, দুনিয়ার মুহাব্বাত, হিংসা, কৃপণতা ইত্যাদি। মানুষ সাধারণত নিজের দোষ নিজে দেখে না। তাই যে সমস্ত পূণ্যাত্মা-নেককার ব্যক্তি তাঁদের অন্তরকে পবিত্র করেছেন তাদের সান্নিধ্যে এসে তাঁদের সহযোগিতায় তাযকিয়ার মাধ্যমে এসব দোষ-ত্রুটি মন থেকে বের করে দিয়ে এই মনের অভিমুখ ও গতিপথকে হেদায়েত আর নেকীর দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে তখন সেই অন্তরে আল্লাহর ভয় সদা জাগ্রত থাকে। আখেরাতে হিসাব দেওয়ার কথা মানুষ আর ভুলে না। তখন সে পাপ কাজ থেকে এমনভাবে দূরে থাকতে চায় যেভাবে মানুষ বিষাক্ত সাপ থেকে দূরে থাকতে চায়। রাতের অন্ধকারে যেখানে কেউ তাকে দেখছে না সেখানেও পাপের উপকরণ থাকা সত্ত্বেও তার মন পাপের দিকে যায় না। সেখানেও সে আল্লাহর ভয়ে পাপ থেকে বিরত থাকতে পারে।

এ কারণে পবিত্র কোরআনে তাযকিয়ায়ে নফসের ব্যাপারে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে:

আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَن تَزَكَّىٰ

নিশ্চয় যে পরিশুদ্ধ হল সে-ই সাফল্য লাভ করবে (সুরা আ’লাÑ আয়াত ১৪)।

অন্য আয়াতে আছে قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا

যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।

وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا

এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। সুরা আল শামস, ৯-১০।

এই দুটি আয়াতের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় কল্যাণ আর সফলতা তাযকিয়ায়ে নফসের সাথে সম্পর্কিত। দিল বা অন্তর পাক পবিত্র থাকলেই নেক কাজ করা যায়। যাতে নিহিত রয়েছে দুনিয়াবি ইজ্জত, মানসিক প্রশান্তি আর পরকালীন নেয়ামত, তথা জান্নাতের চিরস্থায়ী জীবন। সর্বোপরি আল্লাহ তা‘য়ালার সন্তুষ্টি।

আমরা জানি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের আগে আরব জাতি ছিল বর্বর, জুলুমবাজ, মানুষের ধন-সম্পদ নির্দ্বিধায় লুট করত তারা এবং সব ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু নবী করিম (সা.)-এর সান্নিধ্যে আসার ফলে সাহাবায়ে কেরামের অন্তর পবিত্র হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা জাহিলী-যুগের সব অপরাধ ছেড়ে দিতে পেরেছিল মুহূর্তে এবং ঈমান আনার সাথে সাথে আল্লাহতা’লা তাঁদের অতীত পাপগুলো মুছে দিয়েছিলেন। ফলে তাদের স্বভাবে এমন পরিবর্তন এসেছিল যে যারা এক সময় মানুষের ধন-সম্পদ লুট করতো সেই তারাই নিজের খাবার অন্যের মুখে তুলে দিয়েছিল। পরোপকারিতা এবং মানবসেবার এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল যা ইতিহাসে বিরল।

ঘুষ আর দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা যায় কিন্তু শান্তি অর্জন করা যায় না। অপরাধ আর অশান্তি একটা আরেকটার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। যারা অপরাধ করে তারা মানসিক অশান্তিতে ভোগে। অপরাধবোধ তাদের মনের শান্তি কেড়ে নেয়। আর যারা ন্যায়-নীতি মেনে চলে তাদের অন্তরে শান্তি বিরাজমান থাকে। এছাড়া দুনিয়াতে শাস্তি হোক বা না হোক আখেরাতে সব অপরাধের বিচার হবে। তখন অন্যায়ভাবে উপার্জিত সম্পদ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। তবে যারা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অন্তর পবিত্র করেছেন এবং অপরাধ ছেড়ে দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন তারা আল্লাহ তা’য়ালার কঠিন আযাব থেকে রক্ষা পাবেন। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন- يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ

যে দিবসে ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন উপকারে আসবে না;

إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে। (সূরা শুআরা : ৮৮,৮৯)

এতে সহজেই অনুমেয় যে,আত্মাকে বিশুদ্ধ করা কতটুকু প্রয়োজন।

শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া [রাহ.] এর কাছে একজন জিজ্ঞেস করলেন তাসাওউফ কি ? তখন তিনি বললেন তাসাওউফের শুরু "إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، (নিশ্চয় আমলের গ্রহণ যোগ্যতা নিয়তের উপর নির্ভরশীল)। আর শেষ أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّك تَرَاهُ، ‘আল্লাহ্‌র ইবাদত এইভাবে কর যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ’Ñএর উপর। দৃশ্যত এখানে শুধু দুটি বাক্য। কিন্তু এই দু’টি বাক্যের মধ্যে তাসাওউফের মূল বিষয় ও অন্তর্নিহিত মর্ম সন্নিহিত। আর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিতে এখানে তার বর্ণনা করে বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যতই আমল করুক না কেন, যদি নিয়ত শুদ্ধ না হয় ইচ্ছায় না থাকে স্বচ্ছতা তাহলে কোনও আমলই ফায়দা দেবে না। তাই তাসাওউফের ছাত্রকে সর্ব প্রথম নিয়ত শুদ্ধ করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়। এখান থেকেই তার সফরের শুরু। যখন নিয়ত শুদ্ধ হয়ে যায় তখন আল্লাহতা’লার রহমত অবতীর্ণ হতে থাকে। মারেফাতের এই রাস্তা মানুষকে সেই স্তরে পৌঁছে দেয় যে স্তরে উপনীত হলে সে ইবাদত করার সময় আল্লাহতা’লাকে দেখতে পাওয়ার অনুভূতিতে অবগাহন করে। যখন কেউ এই স্তরে উপনীত হয় তখন তার চরিত্র সুন্দর, মার্জিত ও প্রশংসনীয় হয়ে উঠে।

তাসাওউফের আসল উদ্দেশ্য শরিয়ত মত চলা। শরিয়ত বাদ দিয়ে তরিকতের কোনো-ই মূল্য নেই। বুজুর্গানে দীন মানুষের আত্মশুদ্ধির জন্য যে-সমস্ত পন্থা অবলম্বনের কথা বলে থাকেন তা আসল উদ্দেশ্য নয় বরং পন্থা ও উপলক্ষ। আসল উদ্দেশ্য হল বুজুর্গানে দীনের সহযোগিতায় কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত শরিয়ত মতে চলা।

পরিশেষে বলতে চাই আমরা যদি তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অপরাধ আর দুর্নীতি করার ইচ্ছা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারি এবং আল্লাহ তালার কাছে পাপ পুণ্যের হিসাব দেওয়ার ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখতে পারি, তাহলে আমাদের দ্বারা অপরাধ করা আর সহজ হবেনা বরং ন্যায় নীতি মেনে চলা আমাদের পক্ষে অনেক সহজ হবে। তখন দেশ উন্নতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাবে আর মানুষের মধ্যে বিরাজ করবে স্বর্গীয় শান্তি।

বিষয়: বিবিধ

১৩১৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

349160
০৯ নভেম্বর ২০১৫ রাত ১১:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১০ নভেম্বর ২০১৫ রাত ১২:১২
289801
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
349252
১০ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:২৮
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : সুন্দর পোষ্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ । Good Luck
১০ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪০
289896
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ বাহার ভাই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File