নামাজে মন ফেরানো - ৪

লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ১৮ নভেম্বর, ২০১৯, ১০:৪২:০৫ সকাল

(সূরাহ ফাতিহা কন্টিনিউড)

৩. "আর-রহমানির রাহিম"

আল্লাহ কেন তাঁর দয়ার কথা বলতে গিয়ে "আর-রহমান" শব্দটা ব্যবহার করলেন? এর পিছনে একটা চমৎকার কারণ আছে। আরবিতে "মায়ের গর্ভ" এবং "রহমান" - এই দুইটা শব্দ একই রুট ওয়ার্ড (root word = মূলশব্দ) থেকে এসেছে। আরবিতে একই রুট ওয়ার্ড থেকে যে শব্দগুলোর উৎপত্তি হয়, তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক থাকে। তাহলে, "মায়ের গর্ভ" এবং "আর-রহমান" এর মধ্যে সম্পর্ক কী?

একজন মা নয়মাস ধরে একটা বাচ্চাকে পেটে ধরে। শতকষ্টের মধ্যেও সবসময় খেয়াল রাখে, বাবু ঠিক আছে তো? নিজের খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা সবকিছু খুব সতর্কতার সাথে মেইন্টেইন করে। ছোট বাবুটা মায়ের পেটের ভিতর থেকে মায়ের প্লাসেন্টা (Placenta) দিয়ে সবরকমের পুষ্টি শুষে নিতে থাকে। এই বাবুকে দুনিয়াতে আনতে গিয়ে একজন মায়ের প্রচন্ড প্রসববেদনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেকে এই প্রক্রিয়ায় প্রাণ হারায়। যারা বেঁচে যায়, বাচ্চা হবার পর শুরু হয় আরেক কঠিন যাত্রা! রাতের পর রাত জেগে থাকা। দিনের পর দিন ডায়পার-ডিউটি! এক সেকেন্ডের জন্যে চোখের আড়াল হলেই ছোট্ট অবুঝ বাচ্চা ভয়ঙ্কর রকমের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে! যেই বাবুটা পেটের ভিতরে থেকেও কষ্ট দিলো, পেট থেকে বের হতে গিয়ে প্রায় মৃতপ্রায় করে দিলো, বের হয়েও সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখছে, অথচ তার একটু কান্নার শব্দ শুনলে কি অস্থির লাগে! বাচ্চার একটু অসুখ হলে মনে হয় মায়ের জান বের হয়ে যাচ্ছে! এ এক আজিব শ্রেণীর প্রজাতি মায়েরা! কল্পনা করতে পারেন আল্লাহ আমাদেরকে এই মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহ হচ্ছেন রহমানুর রাহিম।

"মায়ের গর্ভ" এবং "রহমান" এর মধ্যে সম্পর্কটা মাইন্ড ব্লোয়িং! বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে থাকে, সে কিন্তু তার মাকে দেখতে পারেনা। মা যে কিভাবে তার জন্যে পা টিপে টিপে হাঁটছে, একটু পর পর বমি করছে, বাচ্চার জন্যে দুয়া করছে, বাচ্চা নেক হবার জন্যে দিনরাত কুরআন তিলাওয়াত করছে - বাচ্চা কিন্তু তার কিছুই দেখতে পারে না! ঠিক একই ভাবে আমরা আল্লাহকে দেখতে পারছি না। আল্লাহ দিনের পর দিন আমাদের খেয়াল রেখে যাচ্ছেন, আমাদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন। ছোট্ট বাচ্চাটা যেমন তার মায়ের গর্ভে পরম মমতায় মোড়ানো, ঠিক সেইভাবে আমরা চারপাশ থেকে আল্লাহর রহমত আর দয়া দিয়ে পরিবেষ্টিত। ছোট বাচ্চা মাকে জ্বালিয়ে মাথা নষ্ট করে দেওয়ার পরেও যেমন বাচ্চাকে ছাড়া মায়ের চলে না; তেমনি আমরা মিনিটে মিনিটে আল্লাহর অবাধ্য হবার পরও আল্লাহ আমাদেরকে ছেড়ে দেন না! ইনি হলেন "আর রহমানির রহিম"!

৪. মালিকি ইয়াও মিদ্দীন:

আগের দুই আয়াতে আল্লাহর এমন মহানুভবতা এবং ভালোবাসার কথা শুনে বান্দা ভাবতে পারে - সুবহানাল্লাহ! আমার রবের এতো দয়া! তাহলে আমি যতই গুণাহ করি না কেন, তিনি তো শেষমেশ আমাকে ক্ষমাই করে দিবেন। এই ধরণের ভাবভঙ্গি থেকে মানুষ যেন আল্লাহর দয়াকে সহজলভ্য ভেবে পাপে জড়িয়ে না যায়, এজন্যে পরের আয়াতেই আল্লাহ বলছেন যে, তিনি হলেন "মালিকি ইয়াও মিদ্দীন"- তিনি কিয়ামত দিবসের মালিক! এমন এক দিনের মালিক আল্লাহ, যেদিন প্রতিটা কাজের পাই পাই হিসাব নেওয়া হবে। আল্লাহ তার দয়াতে যেমন অতুলনীয়, তেমনি তার ন্যায়বিচারও অকাট্য! তিনি মায়ের থেকেও আমাদের বেশি ভালোবাসেন দেখে আমরা যা ইচ্ছা তাই করে পাড় পেয়ে যাবো - সেটা হবে না!

৫. ইয়্যা কানা'বুদু ওয়া ইয়্যা কানাস তাঈ'ন -

অর্থঃ 'আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।''

প্রথম তিন আয়াতে আল্লাহর পরিচয় এভাবে পাওয়ার পর আমরা বান্দারা আল্লাহর কাছে নিজেদের পুরোপুরি সমপর্ণ করে দেই এই আয়াতের মাধ্যমে! যে আল্লাহ আমার রব, রহমানুর রহিম, মালিক - আমি কিভাবে তার ইবাদাত না করে থাকতে পারি? আয়াতের প্রথম অংশে ইবাদাত করার এবং পরের অংশে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, কারণ আমরা আল্লাহর সাহায্য ছাড়া তাঁর ইবাদাতটুকুও করতে পারবো না। আরবিতে অনেক শব্দই আছে যেটার মানে সাহায্য। কিন্তু এই আয়াতে "সাহায্য" বুঝতে আল্লাহ বাছাই করেছেন আরবি শব্দ "ইস্তিয়ানা"।"ইস্তিয়ানা"র বিশেষত্ব হচ্ছে, যেই ব্যক্তি সাহায্য চাচ্ছেন, সে নিজে অলরেডি নিজেকে সাহায্য করার জন্যে সবরকমের কাজ করে যাচ্ছে। পরিশ্রম করতে থাকা অবস্থায় সে যদি সাহায্য চায় সেটা হবে "ইস্তিয়ানা" বা "নাস্তাঈন"। আল্লাহর সাহায্য সস্তা না। আমরা নিজেরা কোনোরকমের চেষ্টা না করেই যদি খালি আল্লাহর কাছে "দাও! দাও!" করি, তাহলে হবেনা। আল্লাহর দিকে এক স্টেপ এগিয়ে আসলে আল্লাহ তা'য়ালা বান্দার দিকে দশ স্টেপ এগিয়ে আসবেন। কিন্তু অন্ততপক্ষে প্রথম স্টেপটা বান্দাকে নিতে হবে।

৬. ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম - আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।

আমরা তো আগের আয়াতে বলে ফেললাম যে "আল্লাহ শুধু তোমারই ইবাদাত করি". কিন্তু, এই ইবাদাতটা আমরা কিভাবে করবো? কি করলে সত্যিকার অর্থে আমাদের দ্বীন, দুনিয়া, আখিরাতের কল্যাণ হবে? তাই এই আয়াতে আমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে দিক-নির্দেশনা চাচ্ছি। "সীরাতাল মুস্তাকিমের" পথ চাচ্ছি। "সীরাত" মানে যেই পথটা স্ট্রেইট, সহজ এবং ক্লিয়ার! একটা রাস্তা যখন পুরোপুরি স্ট্রেইট হয়, তখন অনেক দূর থেকেও সেই রাস্তার শেষ মাথায় গন্তব্য ক্লিয়ারলি দেখা যায়. মুসলিমরাও তাদের গন্তব্য এবং জীবনে চলার পথের উদ্দেশ্য নিয়ে ক্লিয়ার - তারা চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জান্নাত!

৭. "সিরাতাল্লাযীনা আন আমতা আলাইহিম গইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ দল্লীন! আমিন। - "সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।"

এর আগের আয়াতে আমরা আল্লাহর কাছে ইন্সট্রাকশন চেয়েছি, এই আয়াতে আমরা চাচ্ছি জলজ্যান্ত রোল মডেল। ''সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ'' - এরা হচ্ছেন নবী-রসূল (সাHappy. তাঁরা যেই উদাহরণ সেট করে গিয়েছেন আমাদের জন্যে - আমরা সেটা ফলো করতে পারলে দুনিয়া-আখিরাতে কল্যাণ পাবো! শুধু ভালো উদাহরণ-ই না, পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্টের সাথে সাথে নেগেটিভ রিইনফোর্সমেন্টরও উদাহরণ আছে আয়াতের পরের অংশে. আমরা তাদের পথ চাই না "যাদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল হয়েছে" - এরা হচ্ছে সেসমস্ত লোক, যাদেরকে আল্লাহ সঠিক জ্ঞান দিয়েছেন, তার পরও তারা আল্লাহকে মানেনি। জেনে বুঝেও ইসলামকে পালন করেনি। তাদের জ্ঞান ছিল, কিন্তু কোনো সৎকর্ম ছিলোনা। অপরদিকে "ওয়ালাদ্দোল্লীন" হলো যারা পথভ্রষ্ট - তারা সেসমস্ত লোক যাদের হয়তো ভালো ভালো কর্ম আছে, কিন্তু তারা সেটা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যে করেনা। নিজের জন্যে বা দুনিয়ার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে করে - তাই তারা পথভ্রষ্ট! আমরা এই আয়াতে আল্লাহর কাছে ঈমানহীন কর্ম এবং কর্মহীন ঈমানের কাছ থেকে আশ্রয় চাই! এই দুইটাই আমাদের দুনিয়া-আখিরাত ধবংস করে দিতে যথেষ্ট!

বিষয়: বিবিধ

৭০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File