জাতীয় পোষাক ও জাতীয় চরিত্রঃ একটা তুলনামূলক সমীক্ষা

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৭ মে, ২০১৯, ১০:৩৩:৫৩ সকাল



একটা জাতির পোশাক দেখে সে জাতির চরিত্র খানিকটা বোধ হয় আঁচ করা যায়। ঠাট্টা করছিনা ! খুলে বলি?

এই যেমন – আমাদের জাতীয় পোষাক, লুঙ্গীর কথাই ধরা যাক। ! কোন ঘোর প্যাঁচ নেই- বোতাম নেই- বেল্ট নেই, দর্জির কাঁচি –নেই, সোজা সাপ্টা একটা কাপড়ের চোং। পরতে গিয়েও খুব একটা ঝামেলা পোহাতে হয় না। মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে দিন, কোমরে একটা হালকা প্যাঁচ, মামলা ডিসমিস। মুক্ত বাতাস চলাচল, আপনার নিম্নাংগ - অংগ প্রত্যংগ বিজ্ঞানসমত ভাবে সুরক্ষিত, কোন শিরা ধমনী বা নার্ভ এর উপর লুঙ্গী মাত্রাধিক্য চাপ ফেলবে না! গরমের উপযোগী, সহজ, সরল, বাহুল্য বর্জিত পোষাক! ঘুমানোর জন্য অতি উপযোগী। গা এলিয়ে দেয়ার জন্যই যেন ২৪/৭ মুখিয়ে আছে! টয়লেট – বাথরুম? এমন সভ্য পোষাক আজও ২য়টা তৈরি হয়নি দুনিয়ায়! সুন্নাতে খাতনা? সামনের দিকে এক হাতে লুঙ্গী উঁচু করে তুলে ধরে সে শ্লথ হাঁটার দৃশ্য! ক্লাসিক! আর কোন পোশাকে এই জটিল অবস্থায় ইজ্জত রক্ষা করা সম্ভব? আমার মনে হয়- লুঙ্গীর জন্মই হয়েছে এমন জটিল পরিস্থিতির কথা মনে করে।

আমাদের দেশের আমজনতাও তেমনি, সহজ সরল। লুঙ্গীর মত। ভুল বুঝবেন না, আমাদের মধ্যে জিলিপীর প্যাঁচঅলারাও আছেন (তাদের অনেকেই কিন্তু লুঙ্গী ঘৃণা করেন! তাদের পিতৃপুরুষের যে সখ্যতা ছিল লুঙ্গীর সাথে - পারলে সে সত্য অস্বীকার করেন), তবে এখানে সেসকল ‘অসাধারণ ব্যাক্তি নয়, সাধারন মানুষের কথা হচ্ছে- ম্যাঙ্গো পিপল, যারা নিতান্তই লুঙ্গী পরে পরে লুঙ্গী স্বভাবের! দ্রব্যগুণ বলে কথা !

‘লুঙ্গী- স্বভাব’ এই দলের জিন্দেগীও সরল জিন্দেগী । এ দল সাড়া দিন মাঠে ঘাটে আপিসে নিজেদের কাজ কর্ম করেন, জীবিকার প্রয়োজন মিটলে ঘরে ফিরেন, হাত মুখ ধুয়ে দুটো খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমান। জলবৎ তরলং জীবন। কিন্তু সমস্যা হল, তাদের আবেগও কিন্তু লুঙ্গীর মতই সরল। একটু ঝড়ো বাতাসে লুঙ্গী যেমন মাথায় উঠে – এদের আবেগও খুব দ্রুত মাথায় উঠে। কাউকে দেবতা বানিয়ে – মস্তকে বসিয়ে পূজাপার্বন শুরু করতেও এদের যেমন সময় লাগে না, আবার মাথা থেকে নামিয়ে পায়ের নিচে পিষেও ফেলে তারা একই দ্রুততায়! দুটো কাজই তারা করে অস্থির আবেগে। জাতি হিসেবে আমরা যে আবেগ প্রবণ- এ সত্যটা যারা জানে, তারা সে আবেগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করে। আবেগ ধরিয়ে দিতে পারলেই আমরা মোটামূটি উন্মাদ হয়ে আকাশে উঠে যাই। আবেগের ভুত মাথা থেকে নামলে সাথে সাথে পপাত ধরনীতল। এই আকাশ পাতাল বৈপিরীত্য – আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক জটিলতার জন্ম দেয় –এবং ক্রমাগত দিচ্ছে।

ব্রিটিশদের দেখুন – ধরা চুড়া! পা থেকে টাইট, কোমরে টাইট, বুকে গলায় টাইট! কোমরে বেল্ট এর এক্সট্রা বন্ধন, গলায় টাইয়ের নট’ এর ফাঁস! এরা যেন একশান এর জন্য সর্বদা তৈরি। তা যে ধরণের একশানই হোক।

সে একশানের ফল দেখুন! ব্রিটিশ ভারত ২৫০ বছর এদের অধীনে ছিল, এরা দখল করেছে আমেরিকা ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড, আক্ষরিক অর্থেই ঘিরে আছে ভূ গোলক- এই কোট প্যান্টালুন পরা শ্বেতাঙ্গ জনগোস্টি! তারা টাইট দিয়ে রেখেছে সাড়া দুনিয়াকেই। আফ্রিকাকেও কব্জা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাখতে পারল না। অবশ্য তারা ব্রিটিশদের প্যান্টালুন দেখে আঁতকে উঠেছিল! আরে- দেখ দেখ! এটা পরলে তো ওদের বায়ু ত্যাগের কোন – রাস্তা নেই! তারা হাসাহাসি করেছে ব্রিটদের টাইট প্যান্টালুন দেখে! শেষপর্যন্ত তারা প্যান্টালুনওলাদের তাড়িয়েছে মনে করছে- কিন্তু আফ্রিকার সোনার আর হীরার খনিগুলোর – খনিজ পদার্থ ভর্তি মাইনগুলো কাদের হাতে? প্যান্টালুনঅলাদের খাটো করে দেখলে খবর আছে! দুনিয়া জুড়ে লুটপাট করে সম্পদশালী হয়েছে তারা। বাঁকা আঙ্গুলের মাথায় ঘি উঠানো তাদের প্রথম পছন্দ। ছলাকলা মিথ্যা প্রবঞ্চনা- ট্রিকস- সাথে দুঃসাহস আর আত্মবিশ্বাস, তাদের হাতে ‘রাজদন্ড ধ্রিয়ে দিয়েছে! বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!

আমরা এত কিছু দেখেও যে সরল সেই সরল সোজাই থেকে গেলাম। লুঙ্গীর সে সরলতা তা আমাদের ধর্মের সাথেও মিলে; দিনে কমপক্ষে ১৭ বার সুরা ফাতেহা পড়ি আমরা- বলি ‘ইহদিনাস সিরাত আল মুস্তাক্কীম, ইয়া আল্লাহ্‌, আমাকে সরল সোজাপথ দেখাও! দিনে সতেরবার প্রার্থনার এ উচ্চারন, এর একটা তাছির আছে না! অবশ্য সহজ সরল হওয়ার জ্বালা আছে, সেটা অন্যত্র। বিপদের মুহূর্তে লুঙ্গীর সে হালকা প্যাঁচ খুলে যায় সবার আগে; বাঙ্গালী তখন আর সব কিছু ফেলে লুঙ্গী-ঠেকাতে ব্যাস্ত হয়। পলাশীর আম্রকাননে, সিরাজদ্দৌলার বাহিনী যখন লর্ড ক্লাইভ এর মুষ্টিমেয় বাহিনীর হাতে হেস্তনেস্ত হচ্ছিল, সে বাগানকে ঘিরে থাকা, মজা দেখা দর্শক বাঙ্গালী তখন লুঙ্গীর কোঁচা ধরে বসেছিল; বিশ্বাস হল না ? ক্লাইভ বলেছে সে কথা! “সমবেত জনতা একটা করে ঢিল ছুঁড়লেও আমাদের ভরা ডুবি কেউ ঠেকাতে পারত না’! পাগল! সে ঝড় বৃষ্টির মুহূর্তে তারা লুঙ্গী ছেড়ে দিয়ে, ব্রিটদের উপর ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে- বেইজ্জত হবে নাকি? ইজ্জত- আমাদের সমাজ জীবনে এক অতি- মর্যাদাময় অনুষঙ্গ।

হালে রোগ ঢুকেছে দ্রুত বড় লোক হওয়ার, এই সরল লুঙ্গী ছেড়েছুঁড়ে তারা দ্রুত প্যান্টালুন কালচার গ্রহণ করছে। দেশে যে ভেজাল আর ভেজাল, এর পেছনেও সেই দ্রুত বড়লোক হওয়ার মনঃস্তত্ব। লাভের মার্জিন বড় করতে গিয়ে তারা পণ্যে ভেজাল দেয়ার মত অপরাধ করছে। করছে গনভাবে! পার্থক্য এটাই- ব্রিটিশরা নিজে বড়লোক হতে গিয়ে মারত অন্যদের, আমরা মারছি আমাদের জাত ভাইকেই! লুঙ্গীর সারল্য বলে কথা!

সরল বলেই হয়তো ভয়ও আমাদের বেশি। কাছা আর কোঁচা ঠেকানোর জন্য আমরা স্বাধীনতা হারাতেও দ্বিধা করিনা। আর যারা এটা জানে তারা আমাদের এ আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে- আমরাও তাদের আঙ্গুলী হেলনে উঠতে বললে উঠি, বসতে বললে বসি। লুঙ্গী ঠেকাতে গিয়ে আমাদের একাজটা করতে হয়। এমনিতে আমরা বাঘের বাচ্চা, সময়ের সাহসী সন্তান। আমার ভোট আরেকজন দিয়ে যাচ্ছে, ভোটের আগের রাতেই ব্যালট দিয়ে ভর্তি হয়ে যায় বক্স, এ সব আমাদের খুব একটা স্পর্শ করে না। জাতি হিসেবে আমরা খুবই হাসিখুশি; সেখানেও লুঙ্গীর অবদান! সব ব্যাপারেই আমরা খুব দ্রুত উদ্বেলিত হয়ে উঠি, তবে সে উত্তাপ ধরে রাখতে পারিনা। লুঙ্গীর কারনে আমাদের শরীরে - নার্ভে দ্রুত শীতলীকরন প্রক্রিয়া কাজ করে; দুদিনেই আমরা আবার সব ভুলে যাই।

একটা জাতি নিজের উন্নয়নের জন্য মাস্টারপ্লান হাতে নেয়, খেয়ে না খেয়ে হলেও তা বাস্তবায়ন করে, আজকের দুঃসময় আগামীতে আর থাকবে না- এ লক্ষ্যে এগিয়ে চলে! ঘাস খেয়ে হলেও পাকিস্তান আনবিক বোমা অর্জন করবে –বলেছিল ভুট্টো! করেছে তাঁরা- যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা তাদের লক্ষ্য থেকে সরেনি ! আনবিক বোমা বানিয়ে ছেড়েছে ! পাকিস্তানের হাজারো সমস্যা, কিন্তু একটা শান্তনা আছে, দুনিয়ায় এমন কেউ নেই- তারা পাকিস্তানকে মারতে এলে, না মরে – জীবিত ফিরে যাবে! দেশে এক দল ক্ষমতায় আসুক বা অন্য দল আসুক, লক্ষ্যে পৌঁছুতে হবেই, কাজেই সে মাষ্টার প্লানের অদল বদল হয়নি। কিন্তু আমাদের লুঙ্গী কালচার – খুব দ্রুত আপসাইড ডাউন হয়, আমরা গা করিনা; যেন এটাই স্বাভাবিক। পরিবর্তনই জীবন! আমরা সহজেই মেনে নেই এটা! ফল হয়েছে, আমরা ঘুরে মরছি একই বৃত্তে! এ দল যদি একটু সে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে এগিয়ে যাই, তো পরের বছর ক্ষমতা বদল হয়, এবাউট টার্ন! এখন পাকিস্তান আমাদের নিয়ন্ত্রন করেনা, করে পাকিস্তানের কলাবরেটর নামে জুজুর ভয়! স্বাধীনতার পক্ষে না বিপক্ষে! আরে ছাগলের দল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আর এর পক্ষে বিপক্ষে কী! আর যদিও বা স্বাধীনতার বিরোধীদের হাতেই দেশ চলে, তাহলে কি দেশটা আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে? কখনো সম্ভব? জুজুর ভয় আর কতদিন! আমরা লুঙ্গীর মত সরল- তাই বোধ হয় সেই ‘জুজুর ভ্যেই প্রতিক্রিয়া দেখাই- আরে ! তাইতো! স্বাধীনতা বিরোধী! উঃ ! জানে বাঁচব না কেউ! আর একারনেই ৫০ বছরেও চোর বদমাইশদের দমন করা যায়নি, ৭২ এর রিলিফের কম্বলচোরের দল এখন দুম্বার মাংস চুরি করে, রাস্তার কার্পেটিং এর পিচ, লোহার রড চুরি করে, বাঁশ দিয়ে বদলে দেয়- আর জাতিকে দেয় অখন্ড বাঁশ! বিদেশী সাহায্য- আর উন্নয়নের বাজেটের বড় অংশ এ চোরদের পকেট ঘুরে আবার বিদেশে চলে যায়, চোরদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করে, ভবন / মার্কেট কেনে, আমরা আবার সেই চোরদেরকেই ভোট দেই, নেতা বানাই, তাদের পেছনেই স্লোগান দেই! আমাদের লুঙ্গীর প্যাঁচ বড়ই ঢিলা; দোষ আমাদের নয়, লুঙ্গীর।



বিষয়: বিবিধ

৮৫২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386648
২৮ মে ২০১৯ রাত ০৩:১২
আমি আল বদর বলছি লিখেছেন : মুটা মুটি ছোট খাটো একটি ইতিহাস পরে নিলাম লুঙ্গী নিয়ে
১৬ জুন ২০১৯ সন্ধ্যা ০৭:৪১
318399
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ !
386649
২৮ মে ২০১৯ সকাল ০৫:৫০
টাংসু ফকীর লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
১৬ জুন ২০১৯ সন্ধ্যা ০৭:৪১
318398
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ
386654
০৬ জুন ২০১৯ রাত ০৯:৪৪
শেখের পোলা লিখেছেন : জয় লুঙ্গীর জয়! লুঙ্গী বাঁচলে আমিও থাকব।
১৬ জুন ২০১৯ সন্ধ্যা ০৭:৪০
318397
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ জনাব!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File