এডেনঃ একটি প্রাচীন আগ্নেয় ইসলামী নগরী

লিখেছেন লিখেছেন মোতাহারুল ইসলাম ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৯:৫৮:৪২ রাত



এডেন বন্দর

এডেন ইয়েমেনের ২য় বৃহত্তম নগরী। একটি মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ গহবরের উপর এবং এখানকার পর্বত মালার পাদ দেশে অবস্থিত যা কিনা সমুদ্রের মাঝে একটি রাস্তা দ্বারা ভূখন্ডের সাথে সংযুক্ত। আর এ কারণেই এটি একটি অনন্য সাধারণ শহর। এই শহরের কিছু বসতি সমুদ্র উপকুলে আর কিছু মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালা মূখের উপরে দেখা যায়। প্রকৃত পক্ষে সবচেয়ে প্রাচীন বসতিকে বলা হয় আগ্নেয় জ্বালামুখের বসতি যা আক্ষরিক অর্থে জ্বালা মুখের উপরে অবস্থিত।



মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ।

শহরের সন্নিকটেই সিরা নামে একটি দ্বীপ আছে যা এর মাছের বাজারের জন্য বিখ্যাত। এই দ্বীপটি মূল শহরের সাথে একটি সেতু দ্বারা সংযুক্ত হয়েছে যা সাগরের জলরাশির উপর নির্মিত। এখানে একটি প্রাচীন দূর্গ রয়েছে।



সিরা

এডেনের জনবসতি পূর্ন অঞ্চল যেগুলো ইয়েমেন সমুদ্র উপকুলে অবস্থিত তার মধ্যে রয়েছে দ্বার সা’দ, শেখ ওসমান, মানসুরা, তয়াহি এবং মালা।

স্মরণাতীত কাল থেকে এডেনে মানূষের বসতি ছিল, সম্ভবত এ সভ্যতা ৫ হাজার বছরেরও পুরনো। এ শহরের কথা ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থ তৌরাতেও উল্লেখ আছে, যেখানে লেবাননের শহর সীদনের সাথে ব্যাসায়িক সম্পর্কের কথা উল্লেখ আছে, তখন এডেন ছিল আসান সম্রাজ্যের একটি বন্দর, সময়কাল খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী।



প্রাচীন শহর

কিংবদন্তি আছে হজরত নূহ আলাইহিয়াসসাল্লাম এর কিশ্তিও এই শহেরেই নির্মিত হয়েছিল। আরও বলা হয়ে থাকে হাবিল আর কাবিল দুই ভাই এই শহরেই সমাহিত হয়েছিল। এছাড়া বর্ণিত আছে আবান বিন ওস্মান বিন আফফান এই শহরে বাস করতেন।



এডেন এক সময় উমাইয়া এবং আব্বাসীয় খেলাফতের অংশ ছিল, তাছাড়া এ শহর আবিসিনীয়, মিশরীয় এবং ইউরোপীয় দের দ্বারাও শাসিত হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে “ইয়েমেন ফেলিক্স” নামটি ২০০০ বছর আগে একজন গ্রীক লেখকের অবদান।

এডেন এক সময় একটি ব্যাস্ত বাণিজ্যিক নৌ বন্দর ছিল, অনেক আন্তর্জাতিক/ সমুদ্র গামী জাহজ এখানে ভীড় করত, বিশেষ করে যে জাহাজ গুলো প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মাঝে বাণিজ্যের কাজে ব্যাবহৃত হতো।

পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ১৪৯৭ সালে উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত নৌ পথ আবিস্কার করার পর বন্দর হিসাবে এডেনের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। কিন্তু ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খালের উদ্বোধনের পর এডেন আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পায়।

এডেন প্রায় ১৩০ বছর উপনিবেশ হিসাবে ব্রিটিশ শাসিত ছিল। ব্রিটিশ দের এডেন ত্যাগের প্রাক্কালে এটি পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম নৌ বন্দর হিসাবে স্বীকৃত ছিল। ভারত এবং ইউরোপের মধ্যে চলাচল কারী যাত্রীবাহী জাহাজ সমূহের জন্য এডেন একটি উল্লেখযোগ্য যাত্রা বিরতির বন্দর ছিল।

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এডেন ইয়েমেন পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের রাজধানী ঘোষিত হয়। যদিও তখন আভ্যন্তরীন আদর্শগত এবং জাতিগত বিদ্বেষের কারণে এর জনগণ হানাহানিতে লিপ্ত ছিল, বিশেষ করে এই সঙ্ঘাত ছিল তখনকার উপজাতীয় শাসক এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ধ্বজা ধারী শাসকদের মধ্যে। এই আভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতের কারণে এডেন তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন কোম্পানীকে জাতীয়করণ, বাণিজ্যিক লেন-দেন পদ্ধতি কঠিনীকরণ এবং এর অধিবাসীদের বিদেশ ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানাবিধ বিধি-নিষেধ আরোপ করেছিল এবং দেশটি ইয়খন তার প্রতিবেশীদের সাথে সার্বক্ষণিক সঙ্ঘাতে জড়িত ছিল।

এখন কেউ এডেন এর দিকে তাকালে বলবে এর ‘উন্নয়ন ৫০ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে’। এর উন্নয়নের জন্য আরব এবং মুসলমানদের থেকে বিনিয়োগ, পর্যটন ইত্যাদি খাতে সাহায্য প্রয়োজন এবং আর প্রয়োজন মানবতাবাদী উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।

এডেনে সৌদি আরব কর্তৃক নির্মিত একটি আধুনিক / বৃহৎ হাসপাতাল আছে। এছাড়া আছে চীন কর্তৃক নির্মিত একটি লম্বা সুড়ঙ্গ এবং সাবেক পূর্ব জার্মানী কর্তৃক নির্মিত পাহাড়ি সেতু।

এডেনে পর্যটকদের জন্য বহু আকর্ষনীয় স্থান রয়েছে যেমন বৃহৎ প্রাচীন উন্মুক্ত বাঁধ যা ৯,০০০,০০০ গ্যালন বৃষ্টির পানি ধারণে সক্ষম, এই বাঁধ গুলি পর্বতমালার মাঝ খানে অবস্থিত। এগুলো ২০০০ বছরেরও আগে নির্মিত। এ গুলো এখন বিনোদনের স্থান, তাছাড়া প্রাচীন অধিবাসীদের কর্ম-নৈপুন্যের নিদর্শন হিসাবে পর্যটকদের কাছে এখনো আদৃত।

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, যিনি ঈসায়ী ১৪ শতকে বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন,তার লিখনীতেও এডেন এর বর্ণনা স্থান পেয়েছে। এমন এক সময় ছিল যখন অবহেলা ভরে এই বাঁধ গুলোকে বালি দ্বারা পূর্ণ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঈসায়ী ১৮৫৪ সালে, ব্রিটিশ শাসনামলে এই বালি পরিস্কার করার কাজ শুরু হয়। এডেনে অনেক প্রাচীন মসজিদ আছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইদারুস মসজিদ, যা ৬০০ বছর পূর্বে নির্মিত। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার যে সমাজতান্ত্রিক যুগে এই মসজিদ কে কেউ স্পর্শ না করলেও, কমুনিস্ট শাসনের সমাপনান্তে দেশটি যখন উত্তর ইয়েমেনের সাথে একীভুত হয়ে যায়, তারপর একদল চরম্পন্থি [ যারা নিজেদের ইসলামের সংরক্ষক দাবি করে ] মসজিদের পার্শ্বে অবস্থিত শেইখ আইদারুসের মাজারটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। মাজার সংরক্ষণ ধর্মদ্রোহী কাজ এ কারণে তারা উপরোক্ত ধ্বংস সাধনে ব্রতি হয়। এ ধরনের ধর্মদ্রোহী কাজ এর মূলোৎপাটন আলাপ আলোচনা তথা মানুষ কে সচেতন করার মাধ্যমে হওয়ায় শ্রেয়। এ মাজারটি ছাড়া আরো অনেক মাজার একই পরিণতি বরণ করেছিল, যা মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। [ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুয়ালাইহিয়াসসাল্লাম আলী রাজিয়াল্লাহুয়ানহুকে এক বিঘতের বেশি উঁচু সকল কবর মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন- অনুবাদক ]



আয়দারুস মসজিদ

এখানে পর্যটকদের আর একটি আকর্ষনীয় স্থান হল বিখ্যাত ফরাসী কবি আর্থার রাম্বু এর বাড়ী যিনি ১২০ বছর আগে এডেনের বাসিন্দা ছিলেন। এই বাড়িটি প্রাচীন ব্রিটিশ-গোথিক ঐতিহ্যে নির্মিত যা অতি উন্নত কারুকার্য খচিত খদাই করা টাইলস দ্বারা সজ্জিত, মাথার উউর আছে কাঠ নির্মিত মনোহর ছাদ। পরবর্তি সময়ে এই বাড়ীটি ফরাসী সংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে ব্যাবহৃত হত, কিন্তু বর্তমানে একে হোটেলে রূপদান করা হয়েছে।



ফরাসী কবি আর্থার রাম্বুর বাড়ী [সম্মুখ থেকে]



ফরাসী কবি আর্থার রাম্বুর বাড়ী [ভেতরে]

এছাড়া আরো কিছু প্রাচীন প্রাসাদ আছে, যে গুলো ব্রিটিশ স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হয়েছে।

এডেন ইতিহাসের মোড় ঘোরানো অনেক ঘটনার সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেমন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক শাসকদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম, আভ্যন্তরীন নেতৃত্বের বিরোধ ইত্যাদি।



নয়নাভিরাম সুর্যাস্ত

সানা থেকে এডেনে বাসে করে রাস্তার দুপার্শ্বের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। পাহাড়ের উপর বাড়ী গুলো বড়ই নয়নাভিরাম।

মূলঃ আব্দুল ওয়াহাব কাশিফ

ভাবানুবাদ এবং সম্পাদনাঃ মোতাহারুল ইসলাম

বিষয়: বিবিধ

২৮৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File