শবের মিছিলে মে দিবস পালিত : মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি আর নয়

লিখেছেন লিখেছেন নুরুল্লাহ মাসুম ০৩ মে, ২০১৩, ০৩:১৭:৩৩ দুপুর

শ্রমিক শ্রেণীর দাবী আদায়ের দিন- মে দিবস এবারে পালিত শত শত শবের মিছিলের মধ্য দিয়ে। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সংগ্রামী শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে মে দিবসের অর্জন। আট ঘন্টা শ্রম দিবস এবং নানান দাবী নিয়ে শ্রমিকদের সেই সংগ্রামে ৮/১০ জন শ্রমিকের রক্তের বিনিময়ে যদি বিশ্বব্যাপী অর্জন হয় মে দিবস, তবে বাংলাদেশের সাভারের চার শতাধিক শ্রমিকের রক্তের বিনিমিয়ে কি অর্জন হওয়া উচিত? জানি, এর উত্তর পাওয়া যাবে না। তবু বলতে হয়, এতগুলো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী, বিশেষত পোশাক শিল্পে নিয়েজিত লাখো শ্রমিক আদৌ কোন দাবী আদায় করতে পারবে কি না- এটাই আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কেবল মুনাফার লোভে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শিল্পটি এখন সত্যিকার অর্থে হুমকির মুখে। এমনিতে আমাদের দেশে শ্রমিকের শ্রমের দাম খুব সস্তা। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ সুযোগটা নেয় আমাদের শিল্প মালিকেরা- এবং এটাই স্বাভাবিক যে, মালিকপক্ষ চাইবে কত কম মূল্যে পণ্য উৎপাদন করে কতটা বেশী মুনাফা করতে পারে। এ প্রতিযোগিতা মালিকদের মধ্যে চিরন্তন; ফলত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত শোষিত হচ্ছে।

আমাদের সমাজেই কেবল নয়, বিশ্বের বহু দেশে বিশেষত অনুন্নত দেশগুলোয় নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরী পেয়ে থাকে। তবু, আমাদের দেশে অবহেলিত নারী সমাজ পোশাক শিল্পের হাত ধরে স্বাবলম্বীী হবার একটা পথ খুঁজে পিয়েছিল। মালিক পক্ষের নানান অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও নারী শ্রমিকরা নিজ নিজ পরিবারে যেমন স্বাবলম্বীতার ক্ষুদ্র স্তম্ভ হয়ে উঠছিল, তেমনি দেশে অর্জিত হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশীক মুদ্রা। অথচ, যাদের দিয়ে এ মুনাফা অর্জন হচ্ছে, সেই শ্রমিক শ্রেণীর উন্নয়নে মালিক পক্ষকে তেমন একটা উৎসাহী দেখা যায় না। লাখো বেকারের দেশে শ্রমিকের যেহেতু অভাব নেই, তাই মালিক পক্ষ সেই সুযোগটাই নিয়ে নিচ্ছে। খেসারত দিতে হয় স্মার্ট গার্মেন্টস, তাজরীন গার্মেন্টস এবং সবশেষে রানা প্লাজার পাঁচটি গার্মেন্টেস এর শ্রমিকদের- নিজের জীবন দিয়ে।

দুর্ঘটনা বলা যায় কি রানা প্লাজা ধসের ঘটনাকে? ভবনে ফাটল দেখে প্রকৌশলী যখন বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞ এনে পরীক্ষার কথা বলেন, তখন ভবন মালিক ক্ষমতার দাপটে বলেন, দু একটা পিলারে ফাটল ধরলে কিছু হয় না। বেতন-ভাতার ভয় দেখিয়ে, মেরে-পিটিয়ে যখন গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের কাজে যেতে- মৃত্যু ক‚পে ঢুকতে বাধ্য করেন; তখন তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হওয়া উচিত। অথচ মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, ভবন মালিক ও গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় মামরা হয়েছে দুর্ঘটনা জনিত। ফলে মৃত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ন্যায্য বিচার পাওয়া আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। ভবন নির্মানের অনুমোদন নিয়ে গেল সপ্তাহে লিখেছিলাম, পৌরসভা বা রাজউক- কে দায়িত্ব নেবে এই মর্মান্তি দুর্ঘটনার? সাভার উপজেলার প্রদান নির্বাহী ইউএনও কি একজন সিভিল সার্ভেন্ট হয়ে (প্রকৌশলী নন) কি করে ভবন নিরপাদ বলে সার্টিফাই করেন? সাভার পৌরসভার মেয়র কি দায়িত্ব অবহেলা করেননি? রাজউক কর্তৃপক্ষও কি দায়িত্ব অবহেলা করেননি? তবু মন্দের ভাল, আই-ওয়াশ হোক বা অন্য কিছু হোক- যে কারণেই হোক বৃহস্পতিবার সাভার পৌর মেয়র বরখাস্ত হয়েছেন, প্রত্যাহৃত হয়েছেন সাভারের ইউএনও; গ্রেফতার হয়েছেন সাভার পৌরসবার দুই প্রকৌশলী এবং সবশেষে ভবনের ডিজাইন করেছেন যে প্রকৌশলী, তিনিও গ্রেফতার হয়েছেন। প্রশ্ন, সাভারের পৌর মেয়র কেন গ্রেফতার হলেন না? ইউএনওকে কেবলি প্রত্যাহার করে কি কোন লাভ হলো? তারা কি আইনের উর্ধে কেউ?

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, যখন মিডিয়া প্রকাশ করে দিল, রানা প্লাজার মালিক রানা ক্ষমতাশীন দলের যুব সংগঠনের প্রভাবশালী নেতা এবং সে বিষয়ে শত শত বিলবোর্ড ও ফেস্টুন দেখা গেছে আমিন বাজার থেকে শুরু করে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত- অর্থাৎ সাভার উপজেলায় অবস্থি প্রতিটি বড় বড় রাস্তার ধারে। সেখানে সংসদে দাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলছেন রানা যুবলীগের কেউ নয়। অবাক হতে হয়, ক্ষমতাশীন দলে অপরাধী থাকবে না- এমন হলফ দেয়া যায় না। যদি থাকে তাদের উপযুক্ত বিচার হবে- শাস্তি পাবে। কেন প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতাকে এ নিয়ে সত্যের অপলাপ করতে হবে। বরং তিনি বলতে পারতেন, রানা যুবলীগের সদস্য বা নেতা হলেও তাকে গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করা হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত রানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে- এজন্য ধন্যবাদ। তবে দায়েরকৃত মামলাটি তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে আনার ক‚টকৌশল কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। ভবন ধস নিয়ে ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্ত্য নিয়ে সমালোচানর ঝড়ের জবাবে তিনি আরো শক্ত হয়ে বললেন, তিনি এমন কোন কথা বলেননি, মিডিয়ার চাল এটা। বিবিসি’র মত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম কেন এমন চাল চালবেন তার বিরুদ্ধে? বিষয়টা এমন, আমাদের নেতারা যখন কোন কথা বলে ফেঁসে যাচ্ছেন বলে মনে করেন, তখনি বিষয়টি মিডিয়ার ঘারে চাপিয়ে দিয়ে মনে মনে ¯^স্তি পান। আমরা কি পারবো এমনতরো ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে!

এবার শ্রমিকদের নিয়ে কিছু বরতে হয়। শ্রমিকরা বরাবরই শোষিত; তবু অবাক লাগে যখন কোন কারণে তারা বিক্ষোভ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে ওঠেন। ক্ষতি করেন সার্বিক অর্থে দেশের। তাহলে বলতে হয়, তারাও রাজনৈতিক দলের দাবার গুটি হয়ে যাচ্ছেন। আমরা আশা করবো- যে প্রতিষ্ঠান আপনার খোরাক জোগায়, সেটি রক্ষা করুন; রাভ আপনার-আমার-দেশের, সকলের। মালিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে লজ্জা ও ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে ওঠে। সাভারের ধংসস্তুপের মাঝে যখন নতুন জীবনের আগমন ঘটে, তখন জানতে ইচ্ছে করে, সেই অন্ত¯^ত্তা মা, কেন সরকারী নিয়মানুসারে ছয় মাস বা চার মাস আগে থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি পেলেন না? মালিকদের কাছে জানতে ইচ্ছে হয়, আপনাদের ঘরে কোন নারী কি মাতৃত্ব লাভ করেননি? তাদের জন্য আপনারা কত কিছুই না করেন? তবে, যে শ্রমিক মা আপনার জন্য, দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আপনাদের সহায়ক, তার মাতৃত্বের জন্য সামান্য প্রস্তুতিটুকুও কি নিতে দেবন না? এখন যদি বলি আপনাদের জন্য কেবল ঐ শ্রমিক মা হত্যার অভিযোগ আনা নয়, অনাগত এক ভবিষ্যত সন্তানের হত্যার অভিযোগে আপনারা অভিযুক্ত- কি উত্তর দেবেন আপনারা? মনুষ্যত্ব বলে একটা কথা এখনো রয়েছে। বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন, কেবল সংগঠন নয়- শক্তিশালী একটা সংস্থা, বিজিএমইএ; প্রতি বছর আপনারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিজেদের নির্বাচন সম্পন্ন করেন, ক্ষমতায় যাবার জন্য। আপনারা কি কখনো ভেবেছেন শ্রমিকদের কল্যএণর কথা। আপনাদের কি কোন টিম আছে যারা দেখবে শ্রমিকদের অধিকার সঠিকভাবে না হলেও ন্যুনতম সংরক্ষিত হচ্ছে? আপনারা আছেন কেবল মুনাফার দিকে চেয়ে- মানবতা বা মনুষ্যত্ব আপনাদের কাছে কাগুজে শবদ্ মাত্র। একটিবার ভাবুন, যদি এমন কোন দিন আসে, আপনারা কাজ করাবার জন্য কোন শ্রমিক পাবেন না, যেহেতু আপনার শ্রম আইন মানেন না। হাসবেন আমার কথা শুনে; হতেওতো পারে এমনি দিন ঘণিয়ে আসছে। তাছাড়া, ন্যুনতম শ্রমিক অধিকার না থাকার কারণে যদি আন্তর্জাতিক বাজার হারান, তখন কি করবেন আপনার? দেশতো বৈদেশিক মুদ্রা হারাবেই, আপনারা কি করবেন- এত মূল্যবান মেশিনারী দিয়ে? বিজিএমইএ-র কাছে জানতে ইচ্ছে করে, দেশে কতজন শ্রমিক গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করেন, এমন কোন তথ্য আপনাদের কাছে কি আছে? যদি থাকতো, তাহলে জুরাইন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে শেষ ঠিকানা হতো না ৩২ জন শ্রমিকের। তাছাড়া এ জাতীয় ডাটাবেস দক্ষ শ্রমশক্তি খুঁজে পেতেও সহায়ক হবে। এখনো সময় আছে, শ্রমিকদের নিয়ে ভাবুন- এতে আপনাদেরই উপকার হবে। বেঁচে যাবে খেটে খাওয়া মানুষগুলোও।

্ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে দেখেছি, শুনেছি কোন কোন গার্মেন্টস মালিক সরকারী বাধ্যবাধকতা থাকায় শ্রমিকদের জন্য গ্রæপ ইন্স্যুরেন্স করে থাকেন, তবে তা সর্বনিম্ন সংখ্যা দিয়ে। অর্থাৎ ২০ জন শ্রমিক থাকলে গ্রæপ ইন্স্যুরেন্স করার বাধ্যবাধকতা তারা ঠিকই পালন করেন ঐ ২০ জন দিয়ে; যদিও সেখানে কর্মরত শ্রমিক শত শত, কোথাওবো হাজার হাজার। আশা করবো, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতাসহ অনেকেই আহতদের দেখতে গেছেন, বিরোধী দল উদ্ধারকার্য পরিচালনার সুবিধার জন্য ২ মার্চ আহুত হরতাল প্রত্যাহার করেছেন; সবই ভাল লক্ষণ। অন্যদিকে সাভার ট্র্যাজিডিকে সরকারের উপর আল্লøাহর গজব বলে মন্তব্য করে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী বলেছেন, সরকার আল্লøাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারই পরিণামে এ গজব। তাদের কাছে জানতে চাই, আপনার যখন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আপামর তরুন-যুবককে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করেন, আপনি কি দেখেছেন, ঐ নাস্তিকেরাই সাভারে আহতদের জন্য সবার আগে রক্ত সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল? তারা উদ্ধার কাজেও যোগদান করেছিল? মানবতার কাজটি কি আপনাদের ইসরাম সমর্থন করে না? মুসলিম ছাড়া অন্যরা কি আল্লাহর বান্দা নয়? ইসলাম কি বলে, আর আপনার কি বলেন? যতটা জেনেছি-শিখেছি, একজন মুসলমান অন্য একজন মুসলমানকে নাস্তি বলতে পারে না। তাছাড়া ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটাও ইসলাম সমর্থন করে না। কি বলবেন আপনারা? মানবতার সেবায়, মানবতার পথে আসুন, আমরা জানি দুনিয়ার সকল ধর্ম মানবতার কথা বলে, কেবল উগ্র ধর্মান্ধ মানুষগুলো সেটা মানে না; তাইতো মানবতার এতটা অধপতন।

বিষয়: রাজনীতি

৯৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File