পেট্রোল বোমা : রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন উপসর্গ

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:১৭:৪৩ রাত



হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, ভাংচুর রাজনীতির চিরচেনা পরিভাষা। সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে যোগ হয়েছে নতুন উপসর্গ ‘পেট্রোল বোমা’। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখায় একজন বা একাধিক মানুষের জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে। যারা রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছেন তাদের মধ্যে গুটি কয়েক ব্যক্তি বাদ দিলে বাকীগুলো সাধারণ, নিরীহ ও খেটে খাওয়া মানুষ। রাজনীতির সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। পেটের দায়ে রাস্তায় বের হওয়া ছাড়া তাদের জীবিকার বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। এ সাধারণ দরিদ্র মানুষগুলো রাজনীতির কোন সুবিধাভোগীতো নয় বরং রাজনৈতিক খেলার কোন পক্ষ-বিপক্ষও নয়। অথচ নির্বিচারে তাদের মরতে হচ্ছে। এর কিন্তু কোন বিচার নেই। ক্ষতিপূরণ নেই। রাজনীতির অর্থ যদি জনকল্যাণ হয় তবে ‘পেট্রোল বোমা’-এর অর্থ কী ? এর দায় দায়িত্ব সরকারী দল ও বিরোধী দল কোনক্রমেই এড়াতে পারেন না। আজকে যারা সরকারে আছেন কাল তাঁরা বিরোধী দলে গেলে তাঁরাও সমানভাবে ‘পেট্রোল বোমা’-এর আশ্রয় নেবেন। নিহত মানুষের মিছিল প্রলম্বিত হতে থাকবে এভাবে। ২০১৩ সালে সহিংসতা ও দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছেন ২ হাজার ৪৬৬জন। আমরা আর কত মৃত্যু দেখবো ? স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি না থাকলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা আমাদের অভিশাপ দেবে।

রাজনৈতিক কর্মিগণ গাড়ী ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও ‘পেট্রোল বোমা’ ছুঁড়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। গার্মেন্টসে বেতন-ভাতা নিয়ে মালিক-শ্রমিকের বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে শ্রমিকগণ রাস্তায় নেমে নির্বিচারে গাড়ী ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। জগতের সব ক্রোধ-আক্রোশ গাড়ীর উপর। কেন নিরীহ গাড়ী চালক, সাধারণ যাত্রী ও মালিক সহিংসতার শিকার হয়ে সর্বস্ব খোয়াবেন ? কী তাদের অপরাধ ? এটা কোন ধরনের রাজনীতি ? ক্ষমতার মোহাবিষ্টতা প্রলয়ের জন্ম দিচ্ছে ক্রমশ। রাজনৈতিক সহিংসতায় যত বেশী মানুষ মরুক তাতে কী? সরকারের বা বিরোধীদের এতে ঠনক নড়বে বলে মনে আপাতত মনে হয় না। আন্দোলন করতে হয়, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে হয়; এটা স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। মানুষ হত্যা ছাড়া বিরোধীদের প্রতিবাদের কী আর কোন ভাষা বা পদ্ধতি নেই ? বিরোধীদের দমনের জন্য সরকারের হাতে বন্দুকের নল ছাড়া কী বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। নিজ দেশের আইন শৃঙ্থলা বাহিনীর হাতে স্বদেশীরা নির্মমতার স্বীকার হবেন, এর চাইতে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে? ভিন্ন মত থাকা রাজনৈতিক সংস্কৃতির দর্শন।ভিন্নমত ছাড়া গণতন্ত্র অর্থবহ হতে পারে না। বর্তমান রাজনীতিতে সহনশীলতা নেই, আছে দ্বেষ ও প্রতিহিংসা। এখনকার রাজনীতি স্বল্পতম সময়ে টাকা বানানোর নির্লজ্জ খেলা। ন্যালসন ম্যান্ডেলা বা মাহাথির মুহাম্মদের মতো কোন অতি উচ্চমানের রাজনৈতিক নেতার জন্ম কী আমাদের দেশে হবে না ?

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছররে ২৪ ডিসেম্বের পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছেন ৪৯২ জন। ৮১৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আহত হয়েছেন আরও ২২ হাজার মানুষ। আর এর মধ্যে ৯৪ জন আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছেন। প্রথম আলোর পরিসংখ্যান বলছে, ২৫ নভম্বের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ৩০ দিনের মধ্যে সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি চলেছে ২৪ দিন। এই দিনগুলোতে অন্তত ১২০ জন মানুষ সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। মানুষ মরছে গুলিতে, বোমায়, আগুন, দুর্ঘটনায়।

উপরিউক্ত পরিসংখ্যান আমাদের রাজনৈতিক দেওলিয়াপনারই খন্ডচিত্র। যারা ক্ষমতার রাজনীতির স্বাদ নিচ্ছেন এবং যারা ক্ষমতার রাজনীতির স্বাদ নিতে আগ্রহী তাদের মধ্যেও আমরা পরস্পরিক সহনশীলতা ও সম্প্রীতির চর্চা দেখতে চাই। রাজনীতিবিদ ও দেশের সচেতন মানুষকে যৌথ প্রয়াস চালাতে হবে যাতে ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতা এড়ানো যায় এবং আন্দোলনে মানুষ হত্যা বন্ধ করা যায়। রাজনীতিতো মানুষের জন্য। কোন মায়ের কোল যেন আর খালি নয়। অন্যথায় সন্তানহারা মা ও স্বামীহারা বিধবার আর্তনাদে রাজনীতিকদের জীবন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File