পরিশুদ্ধ জীবন ও সমাজ গঠনে রোজা

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ১৭ জুলাই, ২০১৩, ০১:৩৯:০৬ দুপুর



পবিত্র রমজানে মাসভর সিয়াম সাধনা সৎ, শুদ্ধ এবং সুন্দর জীবন ও সমাজ গঠনের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। মহৎ চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন ও সততাবোধকে জাগ্রত করতে এ সময়ের সংযম ও কৃচ্ছ্রের ভূমিকা ব্যাপক। সিয়াম মানে বিরত থাকা। সব ধরনের কুকর্ম ও কুচিন্তা এবং ইন্দ্রিয় পরিচর্যা পরিহার করে আলোকিত মন-মগজ-মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া রোজার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। 'রমজান'-এর শাব্দিক অর্থ দগ্ধ করা। সিয়াম সাধনার উত্তাপে, ধৈর্যের অগ্নিদহনে মুসলমান মাত্রই এ মাসে কুপ্রবৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমজানুল মোবারক দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধি প্রশিক্ষণের মাস। দিনের বেলা রোজা এবং রাতের বেলা ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ দেহ-মনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এ পবিত্র মৌসুমে।

আত্মার পরিশুদ্ধি : রোজার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওযি (রহ.) বলেন, 'মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর। একদিকে তা মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে তাকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে; অন্যদিকে নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্থতা অর্জন করে।' মাসব্যাপী রোজা পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনুষ্যত্ব ও রুহানিয়ত সজীব ও সক্রিয় হয়। এভাবে রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। রোজার মাধ্যমে মানুষ সৎকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে। অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার মানসিকতা দূর হয়।

দৈহিক পরিশুদ্ধি : অতি ভোজন স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে রোজা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাসব্রতের কারণে দেহের ভেতরে অ্যান্টিবায়োটিক এক বিরাট শক্তি অর্জিত হয়, যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। ধারাবাহিক এক মাস রোজা পালনের উদ্দেশ্যে দিনের বেলা যখন পানাহার বন্ধ থাকে, তখন পাকস্থলী ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলোকে বের (Purgation) করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, রোজার অদৃশ্য আগুনে তা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, রক্ত শুদ্ধ হয়, শরীর বিষমুক্ত হয়। একজন রোজাদার রমজান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ বিশেষত হাত, পা, চোখ, মুখ, পেটকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোজার প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার মহান শিক্ষা দেয় রমজানুল মোবারক।

নৈতিক পরিশুদ্ধি : রমজানুল মোবারক শুরু হলে মহান আল্লাহ জান্নাতের দরজা খুলে দেন, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন। এসব কারণে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার, তেলাওয়াতে কোরআন, কৃচ্ছ্র সাধন ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের জান্নাতি পরিবেশ তৈরি হয়। কেবল পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না। সঙ্গে সবদিক থেকে অন্তরকে পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত করতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসায় ভরপুর করতে হবে। জীবন পরিচালনার বাহ্যিক দিকগুলোতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। তবেই রোজা মুমিনের জীবনে অফুরন্ত রহমত ও বরকত হয়ে উঠবে। সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরিফে উল্লেখ আছে, মহান রাসুল মুহাম্মদ (সা.) বলেন, 'তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে, সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে কটু কথা বলে তাহলে সে পাল্টা কটু কথায় উত্তরের বদলে যেন বলে, আমি রোজাদার। রোজা ধৈর্য, সংযম ও নৈতিক উৎকর্ষ শিক্ষা দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমজানের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা।

সামাজিক পরিশুদ্ধি : শুদ্ধতার এ পবিত্র মাস সাধনায় সাফল্য লাভ করার বিশাল সুযোগ। সিয়ামের দাবি তাকওয়ার অনুশীলন। তাকওয়ার অনুশীলন মানেই অপরাধমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ তৈরির কার্যকর কৌশল। রমজানুল মোবারক সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র ভাষায় 'সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের মাস রমজানুল মোবারক'। ধনী ও বিত্তশালীরা সারা দিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার জ্বালার যন্ত্রণা বুঝতে সক্ষম হয়। ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা, দান-খয়রাত করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, 'আয়েশা! অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিও না। একটি খেজুর টুকরো টুকরো করে হলেও তা দান কর। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাস এবং কাছে টান। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।' মাসভর রোজা পালনের ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের বাকি ১১ মাস অনুশীলন করতে পারলে সহজেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

http://www.kalerkantho.com/print_edition/?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1306&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=10#.UeZGP6yUkfs

বিষয়: বিবিধ

১৭৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File