‘তায়েফ’-এর পার্বত্য অধিত্যকায় কিছু সময়

লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ১২ জুলাই, ২০১৩, ১২:১৮:৪৫ রাত



ঐতিহাসিক নগরী তায়েফ পরিভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯৮৫ সালে হজ উপলক্ষে সৌদি আরব গিয়েও তায়েফ যাওয়া হয়নি। ২৬ বছর পর ওমরা পালনের উদ্দেশে মক্কা পৌঁছে সিদ্ধান্ত নিলাম, যে কোনো উপায়ে তায়েফ যেতে হবে। জেদ্দা-মক্কা-মদিনার বাইরে হাজীদের যাওয়া আইনত নিষিদ্ধ। পথে পথে রয়েছে চেকপোস্ট। পৃথিবীর কোনো দেশের ভিসা পাওয়া গেলে একজন পর্যটকের সে দেশের যে কোনো স্থান পরিভ্রমণ করতে সরকারি বাধা থাকে না। ব্যতিক্রম কেবল সৌদি আরব, মিয়ানমার অথবা এ ধরনের দু’চারটি রাষ্ট্র। হজ ও ওমরা পালনকারীদের জন্য সৌদি আরবের সব শহরে যাওয়া-আসার সুযোগ অবারিত থাকলে বহু ঐতিহাসিক স্থান দেখার সুযোগ যেমন সৃষ্টি হতো, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও ব্যবস্থা হতো। অবশ্য ভিজিট ভিসা থাকলে সৌদি আরবের যে কোনো স্থানে যেতে বাধা নেই। সাধারণ পর্যটকদের পক্ষে ভিজিট ভিসা জোগাড় করা রীতিমত কঠিন।

আমার অনুরোধে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত অনুবাদক অনুজপ্রতিম হাফিয সাদিক হোসাইন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি স্বাক্ষরিত একটি অনুরোধপত্র এনে দিলে আমি অনেকটা স্বস্তি বোধ করি। দৈনিক কয়েক হাজার যানবাহন তায়েফ-মক্কা-তায়েফ মহাসড়কে চলাচল করে থাকে। নির্ধারিত চেকপোস্টে গাড়ির গতি শ্লথ করা বাধ্যতামূলক। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ইচ্ছে করলে সন্দেহভাজন গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রীদের আকামা, ভিসা, পাসপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেন অথবা হাত নেড়ে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। দুপুরে কড়াকড়ি তুলনামূলক কম। সম্ভবত গ্রীষ্মের দাবদাহের তীব্রতা, দ্বিপ্রহরের খাবার গ্রহণের তাড়া এবং নামাজের প্রস্তুতির কারণে কিছুটা শৈথিল্য দেখা দেয়। গাড়িতে শিশু ও মহিলা থাকলে অনেক সময় বিশেষ ছাড় পাওয়া যায়। সৌভাগ্য বলতে হবে, সে সুযোগটুকু আমরা পেয়েছি।

দিনটি ছিল জুমাবার। ছুটির দিন হওয়ায় গাড়ির চলাচল একটু বেশি। কাবাগৃহে জুমার নামাজ আদায়ের অব্যবহিত পর দু’টি গাড়ি নিয়ে আমরা তায়েফের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ছোট ভাই হাফিয সাদিক হোসাইন, তাঁর স্ত্রী আশিকা আনসারী, মেয়ে আফিফা, ছেলে আবরার, ফুফাতো ভাই মাওলানা নু’মান, ছোট ভাই মাওলানা জাহিদ হোসেনের স্ত্রী কিশওয়ার হাসিনা, মেয়ে আরিয, ইমতিনান, আফনান ও ছেলে আহমদ ছিল আমার সফরসঙ্গী। আমি ছাড়া সফরসঙ্গীদের সবার আকামা থাকায় তারা প্রত্যেকে ছিল উত্ফুল্ল ও ফুরফুরে মেজাজে। চেকপোস্টের অজানা ভয়ে কাঁপছিল আমার তনুমন। অনেক সময় সৌদি পুলিশ অনুরোধপত্রের তোয়াক্কা করে না। নানা কারণে বাংলাদেশীদের তারা সম্মানের চোখে দেখে না। ধীর লয়ে আমাদের গাড়ি চেকপোস্টের অর্গল যে মাত্র পেরিয়ে গেল, আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তায়েফ ভ্রমণের ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে।

জানালার কাচ দিয়ে মক্কা-তায়েফ মহাসড়কের দু’পাশের বিস্তীর্ণ পর্বত, কন্দর ও উপত্যকার দৃশ্য উপভোগ করতে থাকি। আল্লাহ তায়ালার কী লীলাখেলা! গাছপালাবিহীন পর্বতমালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বহনকারী ল্যান্ডক্রুজার ক্রমান্বয়ে পাহাড়ের কোলঘেঁষে উপরে উঠতে লাগল। সৌদি আরব সরকার কঠিন পাহাড়ের গা কেটে দ্বিমুখী রাস্তা (Two way traffic) তৈরি করেছে, যাতে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। একেক পাহাড়ের চূড়া থেকে অন্য পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত রয়েছে বেশ কটি ওভারব্রিজ। ১৯৬৫ সালে বাদশাহ ফয়সাল এ পার্বত্য সড়ক নির্মাণ করেন। পার্বত্য পথে রয়েছে ৯৩টি বাঁক। সড়কের নির্মাণশৈলী আধুনিক ও মনোমুগ্ধকর।

প্রস্তরপূর্ণ সমতল ভূমি থেকে সর্পিল পথে যতই উপরে যাচ্ছি, শিহরিত হচ্ছি। নিচের দিকে তাকালে রক্ত হিম হয়ে যায়। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে প্রলম্বিত কেশরধারী বানরের ঝাঁক চোখে পড়ার মতো।

সাইনবোর্ডে লেখা আছে (Beware of Monkey) ‘বানর থেকে সাবধান’। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা এক ধরনের উদ্ভিজ্জ ফলমূল তাদের একমাত্র খাবার। এসব বন্যখাদ্য অপ্রতুল বলেই হয়তো অনেক সময় তারা লোকালয়ে অথবা পর্যটকদের ওপর হামলে পড়ে। শিশুদের হাতে রাখা খাবার অনেক সময় বানর ছোঁ মারতে পারে—এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এরই মধ্যে আমরা ‘আল হাদা’ নামের অধিত্যকায় উপনীত হয়েছি। মক্কার সমতল ভূমিতে যেখানে প্রচণ্ড গরম, আল হাদার পাহাড় চূড়ায় শীতল হাওয়ার পরশ। আল হাদা ভূমি থেকে ১৮৭৯ মিটার উচ্চতায় তায়েফ পর্বতমালায় অবস্থিত ছোট্ট শহর। নবাগত পর্যটকরা ব্যায়াম, সিঁড়ি আরোহণ অথবা ভারী দ্রব্যসামগ্রী বহনের সময় অক্সিজেন-স্বল্পতা অনুভব করে থাকেন।

তায়েফ মক্কা প্রশাসনিক প্রদেশের ঐতিহাসিক একটি শহর। সারওয়াত পর্বতমালা সংলগ্ন উপত্যকা থেকে এর উচ্চতা ৬.১৬৫ ফুট। ৫ লাখ জনঅধ্যুষিত তায়েফ আঙুর, আনার, গোলাপ ও মধু উত্পাদনের বিখ্যাত কৃষি অঞ্চল। প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমের প্রচণ্ড দাবদাহে সৌদি কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম তায়েফ থেকে পরিচালিত হয়। তায়েফের জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ হাম্বলি ও মালিকি মাজহাবের অনুসারী। বিভিন্ন আরব দেশ, তুরস্ক ও এশিয়ার বংশোদ্ভূত বেশ কিছু সংখ্যক বিদেশি জনগণও তায়েফে বসবাস করেন। তায়েফকে বলা হয় ‘হেজাজের বাগান’। তায়েফে রয়েছে একটি আধুনিক বিমানবন্দর। জেদ্দা, রিয়াদ এবং পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল করে। তায়েফ অঞ্চলের বেদুইনরা কঠোর পরিশ্রমী। শস্যচাষ ও পশুপালন তাদের মূল পেশা। সমতল ভূমি বেশ উর্বর। সৌদি আরবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতমালা ‘ইবরাহিম জাবল’ তায়েফ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পর্যটনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী স্থান।

মক্কা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত তায়েফ প্রাচীনকাল থেকে ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে আসছে। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের মানুষ তায়েফের নারী দেবী ‘লাত’ মূর্তির পূজা করত। সে যুগে এখানে বাস করত ছাকিফ গোত্র। উরওয়াহ ইবন মাসউদ, আবদ ইয়া লায়ল ইবন আমর, উসমান ইবন আবুল আস ছিলেন সে যুগের নামকরা গোত্র অধিপতি। ৬৩০ সালে তায়েফের কাছে সংঘটিত হয় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে হুনায়েনের যুদ্ধ।

অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে যিয়াদ বিন আবি সুফিয়ান (রা.), মুগিরা ইবন শো’বা (রা.), হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ, আল মুখতার, ইরাকের বাদশাহ ফয়সাল, নায়িফ ইবন আবদুল আযিয, হজরত উসমান ইবন আফফান (রা.), মুতলাক হামিদ আল উতায়বী, ব্রুনাই দারুসসালামের তৃতীয় রাষ্ট্রপ্রধান সুলতান শরীফ আলী অন্যতম।

বহু বিখ্যাত ব্যক্তি জীবনের একটি অংশ তায়েফে কাটিয়েছেন। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম, খোলাফায়ে রাশেদিনের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান ইবন আফফান (রা.), তুর্কি উসমানি খিলাফতের সংবিধান রচয়িতা আহমদ শফিক মিফহাত পাশা (১৮২২-১৮৮৪), মুহাম্মদ মুহসিন খান, হজরত আবদুল ইবন আববাস (রা.)। তায়েফ মানে প্রদক্ষিণকারী, তাওয়াফকারী। ছুটির দিনে এটা সর্বস্তরের মানুষের পর্যটন ও মিলনকেন্দ্র।

তায়েফ থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে প্রাক-ইসলামী যুগের ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে বার্ষিক মেলা বসত। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সর্দাররা রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্য বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। এখানে গদ্য সাহিত্য ও কবিতা প্রতিযোগিতার আসর বসত। শ্রেষ্ঠ কবিতা পর্বতগাত্রে উত্কীর্ণ করে রাখা হতো। এখনও ব্যাসালটিক পাথরে এসব স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত আছে। এর পাশে অবস্থিত তুর্কি দুর্গ। এখানে বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বেশ কিছু কবরের চিহ্নও বিদ্যমান। কথিত আছে, ১৯১৭ সালে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া এখানে যুদ্ধরত ছিলেন। আল হাদা ও শেরাটন হোটেলের মাঝখানে রয়েছে জীবন্ত বন্যপ্রাণী, পাখি ও বনজ-ফলদ গাছগাছালির সংগ্রহশালা। পর্বতচূড়া থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য বড়ই মনোহর।

এ তায়েফ শহরের সঙ্গে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের এক বেদনাবিধুর স্মৃতি বিজড়িত। এখানে দশদিন অবস্থান করে তিনি আল্লাহর বাণী প্রচারে প্রয়াসী হন। কিন্তু বিপথগামী তায়েফবাসী প্রস্তর নিক্ষেপ করে তাঁকে শহর থেকে বিতাড়িত করে দেয়। অপমান ও লাঞ্ছনা সহ্য করেও তিনি তায়েফবাসীকে অভিসম্পাত করেননি।

আবু তালিবের মৃত্যুর পর রাসুলুুল্লাহ (সা.)-এর ওপর কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পায়। আবু লাহাব ও অন্যান্য দুশমন মনে করল, তার ওপর চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্বের স্নেহছায়া উঠে গেছে। এখন তাঁকে রক্ষা করার কেউ নেই। নিন্দাবাদ ও নিগ্রহের মধ্যেও রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বীনি দাওয়াতের প্রয়াস অব্যাহত রাখেন আল্লাহ্ তায়ালার ওপর ভরসা রেখে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাসুলুল্লাহ (সা.) যায়দ ইবন হারিছাকে সঙ্গে নিয়ে তায়েফ রওনা হন। তায়েফের জনগণের অন্তরে ইসলামের দাওয়াত প্রভাব ফেলতে পারে—এ প্রত্যাশা নিয়ে তিনি ছাকিফ গোত্রের তিনজন প্রতাপশালী নেতার ঘরে উপস্থিত হন। তারা হচ্ছেন আবদু ইয়া লাইল, আবদু কালাল এবং হাবীব। মাতৃকুলের দিক থেকে তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আত্মীয়। তিনি তাদের সঙ্গে ইসলাম প্রচার এবং ইসলামের প্রতিপক্ষ শক্তির মোকাবিলায় তাদের সহায়তা কামনা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে নিতান্ত অভদ্র

ও অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বসে। প্রথম জন বলল, তোমাকে কি আল্লাহই পাঠিয়েছেন? দ্বিতীয় জন বলল, রাসুল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আল্লাহ আর কাউকে পাননি? তৃতীয় জন বলল, খোদার শপথ! তোমার সঙ্গে আমরা কথা বলব না; কারণ তোমার দাবি অনুযায়ী যদি তুমি সত্যিকার অর্থে আল্লাহর রাসুল হয়ে থাক, তা হলে সওয়াল-জওয়াব ও তর্ক-বিতর্কের জন্য আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। আর যদি নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার হও, তাহলে তোমার মতো মানুষের সঙ্গে আমাদের কথা বলা অনুচিত।

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বক্তব্য শুনে সম্যক বুঝতে পারেন যে, তায়েফের পরিস্থিতিও অনুকূল নয় এবং এখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করা সমীচীন নয়। তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় ছাকীফ গোত্রের দলপতিদের অনুরোধ করলেন, যেন তার এখানে আসার খবর গোপন রাখা হয়। কেননা কুরাইশরা যদি তার তায়েফ সফরের সংবাদ জানতে পারে, তা হলে নির্যাতনের মাত্রা আরও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উন্নীত হবে। উত্তরে দলপতিরা বলল, তোমার যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পার; তবে আমাদের শহরের চৌহদ্দির ভেতরে থাকতে পারবে না। অতঃপর তারা আল্লাহর রাসুলের পেছনে তাদের দাস ও সমাজের লুচ্চা-লোফারদের লেলিয়ে দেয়। তারা চিত্কার করে গালি দিতে লাগল। ইত্যবসরে রাসুলুল্লাহ ( সা.)-এর চলার পথের চারিদিকে লোক জমায়েত হয়ে গেল। প্রত্যেকে একযোগে তাঁর প্রতি পাথর ছুঁড়তে লাগল। প্রস্তরাঘাতের ধকল সইতে না পেরে তিনি যখন বসে পড়তেন, শত্রুরা হাত ধরে আবার দাঁড় করে দিত। এতে আঘাতের পর আঘাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। জুতাদ্বয় রক্তে ভরে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বাঁচাতে গিয়ে যায়দ ইব্ন হারিছার মাথা কয়েক স্থানে ফেটে যায়। অবশেষে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁরা দু’জন নিকটবর্তী আঙুরের বাগানে আশ্রয় নেন। বাগানের মালিক ছিল উতবা ও শায়বা—ইসলামের প্রতি যাদের শত্রুতা ছিল সর্বজনবিদিত। কিছুক্ষণ পর ওই স্থান তিনি ত্যাগ করেন। এরই মধ্যে জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে একদল ফেরেশতা এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেন, আপনি যদি হুকুম করেন, তাহলে এ অপরাধীদের দু’পাহাড়ের মাঝখানে রেখে আমরা পিষ্ট করে ফেলব। প্রতিউত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘না, আমি আশা রাখি আল্লাহ তায়ালা তাদের সন্তানদের মধ্যে এমন লোক পয়দা করবেন, যারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং শিরক করবে না।’ শত্রুর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ক্ষমা ও মহানুভবতা দুনিয়ার বুকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাঁর এ প্রত্যাশা আল্লাহ তায়ালা অপূর্ণ রাখেননি। পরে তায়েফের প্রতিটি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। প্রতিপক্ষের সঙ্গে মানবিক আচরণের ধারাবাহিকতা মদিনার সমাজ জীবনেও বরাবর অব্যাহত থাকে (সীরাতে হালাবীয়া, ২খ, পৃ. ৪৩৭-৪৫০; ইব্ন হিশাম, সীরাতুন্নবী, ১খ, পৃ. ৪৬৮-৪৭০; তারীখে তাবারী, ১খ, পৃ. ১০৮-১১০)।

কিছুক্ষণ আল-হাদায় অবস্থান করে তায়েফের সর্বোচ্চ পবর্তশৃঙ্গে আরোহণ করি, যেখানে বর্ষাকালে মেঘমালা মানুষের শরীরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। প্রশস্ত সড়কে উঁচু-নিচু উপত্যকা অতিক্রম করতে বেশ ভালো লাগে। চারদিকে সবুজের সমারোহ। বিস্তীর্ণ ভূমিতে খেজুর, আনার, আঙুর, পিচ (খোখ), আঞ্জির, আখরোট ও শাক-সবজির বাগান। অনেকটা দেখতে বাংলাদেশের মতো। পথের ধারে গাছের ছায়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুপুরের খাবার গ্রহণের দৃশ্য বনভোজনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরাও বনবীথিপূর্ণ একটি মনোরম স্থান বেছে নিই আহার ও বিশ্রামের জন্য। নৈসর্গিক শোভা ও শীতল হাওয়ার পরশ পথের ক্লান্তিকে পরাভূত করে। আবীরের আম্মা (ভাই হাফেজ জাহিদের স্ত্রী, কিশওয়ার) বিরিয়ানি, স্প্রাইট, মিনারেল ওয়াটার, শীতল পাটি, গামছাসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সঙ্গে আনার কারণে আমাদের অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ক্যাফেতে আরবীয় খাবার বাংলাদেশীদের কাছে অনেক সময় উপাদেয় মনে হয় না। আশপাশে প্রচুর আধুনিক কটেজ পর্যটকদের ভাড়া দেয়ার জন্য সুসজ্জিত অবস্থায় রয়েছে। এ দেশের জনগণ গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জন্য তায়েফকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন।

আছরের নামাজ আদায় করলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ মসজিদে আব্বাসে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বিশাল আয়তনের মসজিদ। এর পূর্বে অবস্থিত রইসুল মুফাসসিরিন হজরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.)-এর সমাধি। নামাজ শেষে আমরা তাঁর কবর জিয়ারত করি। সমাধিগাত্রে একটি ঘটনা উত্কীর্ণ আছে—

‘হজরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) তায়েফে ইন্তেকাল করেন। জানাজার নামাজের জন্য তাঁর লাশ বের করা হলে চলার পথে একটি পাখি তাঁর কাফনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পাখিটি আর বের হয়নি। এ রকম পাখি আগে আর কোনো দিন দেখা যায়নি। কবরে যখন তাঁর লাশ দাফন করা হয়, কবরের প্রান্ত থেকে (‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল হয়ে যাও, আর প্রবেশ করো আমার জান্নাতে’ আল ফজর: ২৭-৩০) তেলাওয়াত করতে শোনা যায়। তেলাওয়াতকারীকে দেখা যায়নি।

[(ক) আহমদ ইবনে হাম্বল, ফাযায়িলুস সাহাবা, মুআসিসসাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবনান (প্রথম সংস্করণ: ১৪০৩ হি. = ১৯৮৩ খ্রি.), খ. ২, পৃ. ৯৬২, হাদিস : ১৮৭৯, (খ) কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী, আত-তাফসীরুল মাযহারী, মকতাবায়ে রশিদিয়া, করাচি, পাকিস্তান (১৪১২ হি. = ১৯৯১ খ্রি.), খ. ১০, পৃ. ২৬৩, (গ) আত-তাবারানী, আল-মু’জামুল কবীর, মাকতাবাতু ইবনে তায়মিয়া, কায়রো, মিসর, খ. ১০, পৃ. ২৩৬, হাদিস : ১০৫৮১]

একটি ব্যাপার লক্ষণীয় যে, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.)-এর সমাধিটি বেশ উঁচু দেয়াল দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে, যেন কবরটি চোখে দেখা না যায়। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই উঁচু দেয়ালের আড়ালে কবর আছে। আলিমের পোশাকধারী এক ব্যক্তির কাছে যখন এ সাহাবির কবরের লোকেশন সম্পর্কে জানতে চাইলাম, তিনি অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, কেন? কবর দিয়ে কী করবেন? সৌদি আলেম ও সৌদি সরকার বিদআত প্রতিরোধের নামে কবর জিয়ারতকেও নিরুত্সাহিত করে থাকে। ঠিক একই দৃশ্য বদরের প্রান্তরেও দেখেছি। বদরের শহীদরা যে প্রান্তরে সমাহিত, তার চারদিকে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে সুউচ্চ দেয়াল, যেন কবরের মাটি জিয়ারতকারীদের চোখে না পড়ে। কিছুক্ষণ পর পর মোবাইল পুলিশ এসে জিয়ারতকারীদের তাড়ায়; দাঁড়াতেই দেয় না। এ দৃশ্য আমাদের অবাক করে। অথচ কবর জিয়ারত সুন্নাতে রাসুল (সা.) ও সুন্নাতে সাহাবা (রা.)। তুর্কিরা যখন হিজাজের শাসন ক্ষমতায় ছিল, তখন তাঁরা কবরের ওপর দরগা তৈরি করে অনেক বিদআতের প্রচলন করে। অপরদিকে বর্তমান সৌদি সরকার কবর জিয়ারতের অনুমতি দিতেও কুণ্ঠিত। আমার বিবেচনায় উভয়ের গৃহীত পদক্ষেপ বাড়াবাড়ি।

তায়েফের যে স্থানে পাথর ছুঁড়ে আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল, সেখানে একটি ছোট ইবাদতখানা গড়ে ওঠে। সূর্যাস্তের সময় আমরা সেখানে পৌঁছে মাগরিবের নামাজ আদায় করি। উঁচু পাহাড়ের ঢালুতে পাথরটি অলৌকিকভাবে ১৫০০ বছর ধরে আটকে আছে। রাতের তায়েফ যেন এক স্বপ্নপুরী। ডানে-বাঁয়ে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানি। পাহাড়ের অধিত্যকা থেকে চোখ ফেললে যেন মনে হয় চারদিকে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলছে। রাতে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি পথে না এসে রিয়াদ-মক্কা মহাসড়কের (সায়লুল কবির) সমতল ধরে জেদ্দার উদ্দেশে তায়েফ ত্যাগ করি। তায়েফ পরিভ্রমণের পবিত্র সুখানুভূতি স্মৃতির তটরেখায় অনেক দিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।



বিষয়: বিবিধ

৩৮০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File