ক্রয় বিক্রয় এবং ওজন নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন লিখেছেন বুড়া মিয়া ১৬ অক্টোবর, ২০১৪, ০৭:২৪:৫৫ সন্ধ্যা

এর আগের দুইটা পোষ্টে লাভ এবং প্রাইস নিয়ে কিছু আলোচনা করেছিলাম। সেখানে আউটসোর্সিং এর জন্য প্রাইসিং এর পলিসি কি সেটাও বলেছিলাম। প্রত্যেকটা সাধারণ মানুষও আসলে এভাবেই প্রাইসিং এর ডিসিশন নেয়। যেমনঃ আমি যখন কোন কিছু কিনতে যাই (এটাই আউটসোর্সিং), তখন দুইটা জিনিস চিন্তা করি – কষ্ট (নিজে বানালে বা করলে কি হয়) এবং বেনিফিট (আরেকজনকে দিয়ে কষ্টের কাজটা করিয়ে, সেই সময় আমি অন্য কিছু করলে কি হয়)।

কষ্ট এবং বেনিফিট সমান সমান হওয়ার কথা অনেকেই বলে, কিন্তু বাস্তবতা পুরোই ভিন্ন। সবাই কষ্ট দিবে অবশ্যই তার প্রাপ্য বেনিফিট এর চাইতে কম এবং মার্কেটের প্রায় সবকিছুই এভাবে নির্ধারিত হয়ে বসে আছে মানুষের এই চরিত্রের কারণে। আমি কিংবা যে কেউ যখন বাজারে গিয়ে চাল/ডাল/আলু/লবণ কিনি তখন চিন্তা করি দুই ভাবেঃ

১/ প্রথম চিন্তা করিঃ আমারই তো ক্ষেত খামার আছে, আমি করেই তো খেতে পারি ওকে প্রাইস দিবো কেন? একটু সময় দিলেই তো হয়।

২/ পরক্ষণেই চিন্তা করি ঐগুলা করে খেতে আমার যে সময় লাগবে, সে সময় যদি আমি ছলিমের গোলামী করি, ওইগুলোর বাজারমূল্যের চাইতে বেশী ইনকাম করতে পারি।

এই চিন্তা মনে হয় সাধারণ সব মানুষেরই বৈশিষ্ট, এটা মানুষের কোন যৌক্তিক বৈশিষ্ট কি-না, তা এখনও ভালো মতো বুঝতে না পারলেও, এটা বুঝতে সমস্যা হয় নি যে, মানুষের মানসিকতা লাভ করার। এছাড়াও এটাও বুঝতে পারি নাই, কেনো আল্লাহ বললোঃ ওজনে কম বেশী করো না!

কেননা এক পাল্লায় সময় শ্রম দিলে যা পাচ্ছি আরেক পাল্লায় সেগুলো রাখলে তার চাইতে বেশী পাচ্ছি কি-না তার হিসাবে মত্ত আমরা! এবং বেশীটা হিসাব করে নিয়ে কমটা আরেকজনকে দিচ্ছি! আমরা সবাই কি এতে করে ওজনে কম বেশী করছি?

আরও একটু বিশ্লেষনে আসবো আরও কিছু আমার নিজের কাছে পরিস্কার করার জন্যঃ এই যে কষ্ট ও বেনিফিট, এটা আসে সোজা দুইটা জিনিস থেকে, মানুষের শ্রম এবং মানুষেরই সময়। এজন্য, অনেকেই মানি বা ভ্যালু বা মূল্য বলতে বুঝিয়েছে, এই সময় এবং শ্রমের প্রোডাক্টকে, মানে মানুষের সময় এবং শ্রম যেখানে না লাগে ওইগুলা হীরকখন্ড হলেও মূল্যহীন! ওগুলো শ্রম লাগিয়ে বহন করে নিয়ে আসতে হবে প্রথমে, তারপর সাইজ করে অন্যদের কাছে ফেরী করতে হবে, বা অন্যদের অসুস্থ করে তুলতে হবে যাতে আমার কাছে এসে তা পাবার আকাঙ্খা করে তাদের অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের জন্য!

আমি ক্ষেতের কাজে সময় এবং শ্রম দিলাম না বেনিফিট ছলিমের ওখানে তাই। আমার মতো লাখ লাখ লোক একই কাজ করলো একইভাবে ডিসিশন নিয়েই। আমি যেমন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষেতের জিনিসের মূল্যের সাথে ছলিমের দেয়া বেনিফিটের পার্থক্যের মাধ্যমে কিছু ব্যক্তিগত লাভ করলাম, আমার মতো প্রত্যেকেই এরকম ব্যক্তিগত লাভ করলো। ছলিমও একই কিছিমের, তবে ওর হিসাব একটু আলাদা, কারণ ও নিজের ব্যক্তিগত লাভ সংগ্রহ করে, অন্য আমার মতো অনেক ব্যক্তিসমষ্টির লসের সমষ্টি হিসেবে, ঠিক যেভাবে আমরা নিজেদের কষ্ট বেনিফিট হিসাব করে ক্ষেতের কামলাকে লস দিয়েছিলাম!

এখানে দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের চাইতে আমাদের জন্য ছলিমের গোলামী করা লাভজনক বিধায়, আমরা ছলিমের গোলামীর জন্য প্রস্তুত এবং এটাই আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় কঠিনভাবে শিখেছি এবং সব গোলামরা মিলে প্রতিযোগীতা করছি ছলিমদের গোলামীর জন্য, এটাই আমার মতে দাসত্ব!

দাস দাসী বলতে আমি যা বুঝেছি, তা হচ্ছে নিজের ক্রয়-বিক্রয়ের (ব্যবসার) কোন ক্ষমতা নেই এবং জায়গা-জমিও নেই, তাই মানুষের গোলাম হয়ে মনিবকে ক্রয়-বিক্রয়ে বা তার যে কোন কাজে সহায়তা করে যাওয়া সামান্য ভাত-কাপড় (বেতন) এর বিনিময়ে! আমাদের অবস্থাও আসলেই কি তাই? আমরা ডিম-চাল-ডাল মাথায় করে বেচার বা এগুলো চাষাবাদের অপশন থাকতেও কি আমরা এ দাসত্ব বরন করি নাই? কিন্তু আমরা কান্নাকাটি করে জিজ্ঞেস করিঃ আমরা কি স্বাধীন? আমরাতো দাস! পরাধীনতা মেনেই নিয়েছি কষ্ট-বেনিফিট হিসেব করে, তাহলে কেনো কান্নাকাটি করি আবার স্বাধীনতার প্রশ্নে? বেনিফিট কি কোথাও দিয়ে কম হয়ে যাচ্ছে কারও? অবশ্যই মনে হয়!

আমার মুসলিম ভাই বোনদের কাছে জিজ্ঞাসাঃ আপনার আমার জন্য হালাল করা হয়েছে ক্রয়-বিক্রয়, এটা কি ক্রয় বিক্রয়ঃ পণ্য (চাল, ডাল ইত্যাদী) না-কি সময় ও শ্রম? আমরা ছলিমদের ওখানে বেতনের বিনিময়ে যা বিক্রি করি তা হচ্ছে আমাদের সময় (ফিক্সড একদম ৯-৫ টা) আর শ্রম (এই সময়ে ছলিম খুশি মনে ব্যবহার করবে আমাদের), এটা তো প্রকাশ্য দাসত্ব; না-কি অন্য কোন ব্যাখ্যা আছে এটার ইসলামের আলোকে? স্বাধীন-স্বাধীনা কি ক্রয়-বিক্রয়ের অপশন থাকা সত্ত্বেও এরকম দাসত্বের দিকে যাবে? এছাড়াও ইসলামের ক্রয় বিক্রয়ের সাথে আমাদের এই সময় এবং শ্রমের ক্রয় বিক্রয়ের যোগসূত্র কি? এখানে হিসাব হবে কিভাবে?

ক্রয়-বিক্রয়ের প্রশ্ন তোলায় আমি অনেকের কাছেই জেনেছি সেটা পালা-পাথরে ওজন এবং শুধুই পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য। যেমন এই পাল্লায় ১ কেজি খেজুর হলে ওই পাল্লায়ও ১ কেজিই হতে হবে। সময় আর শ্রম বেচার ক্ষেত্রে ওজন কেমনে হবে? আমরা তো সময় আর শ্রম বেচতেছি একদম হিসাব করে এভাবে যেঃ আমার শ্রম-সময় ক্ষেতের পাল্লায় রাখলে যে ওজন (টাকা) হয়, ছলিম পাল্লায় রাখলে তার চাইতে বেশী হয়; তাই আমরা ক্ষেত বাদ দিয়ে চলে এসেছি ছলিমের কাছে! কেউ তো আমাকে ওজনে কম দেয় নি, আমিই দিচ্ছি, এবং আমার মতো এখন সবাই! এখানে হিসাবের কি কোন গড়মিল হচ্ছে বা আমরাই করছি?

আশা করি ইসলামিষ্ট ভাই ও বোনেরা এ জিজ্ঞাসাগুলোর যুক্তিসঙ্গত উত্তর প্রদান করবেন।

বিষয়: বিবিধ

১৬৬৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

275069
১৬ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৯:২২
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৬ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:৪৯
219068
বুড়া মিয়া লিখেছেন : Happy
275095
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১২:২৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : Chalam. You have presented and explained your writing very nicely. Jajakallahu khair.
১৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৩৭
219430
বুড়া মিয়া লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ বৌ-মাকে ...
275119
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:২৬
সাদাচোখে লিখেছেন : আপনার লিখাগুলো চমৎকার চিন্তা/ভাবনা উদ্রেককারী। পড়ার পর মনে হয় - 'ইস কি ভাল হত যদি এক দল ব্যবসায়ী, ইকোনোমিস্ট, পড়ালিখা করা জানাশোনা আলেম, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি ও এ্যাকাডেমিক্স কে একটা প্লাটফর্মে এনে এ জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে ওপেন আলোচনা করতে পারতাম, পক্ষে বিপক্ষে মতামতগুলো লিখতে পারতাম, রিফ্লেক্ট করতে পারতাম - হয়তো জীবনকে আরো অনেক বেশী পরিপূর্ন ও তৃপ্তিকর করে তুলতে পারতাম এবং অন্যকেও ভোগবিলাস বিমুখ করে শান্তির বাতাবরন এ নিয়ে আসতে পারতাম'।

পড়ার পর আরো যা মনে হয়েছে - আলোচনায় আসলেই ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন তুলেছেন - ভিন্ন ডাইমেনশান হতে।

আমার তাৎক্ষনিকভাবে মনে হয়েছে আপনি সম্ভবতঃ এই ইক্যুয়েশানে - সোসাইটিতে শ্রমের যে বিভাজন এবং সে নিমিত্তে সৃষ্ট এক্সপার্টিজ এর জন্ম ও তা হতে উদ্ভুত নিত্য নতুন চাহিদার উদ্ভব হওয়া ও তার সম্ভাব্য যোগান কে বিবেচনায় আনেন নি।

মাইক্রো লেভেল এ - আমার মনে হয়েছে আল্লাহ আমাদেরকে অসমভাবে তৈরী করেছেন, চান যে আমরা অসম লেভেল এ থাকি (শ্রমের মূল্যমানের পার্থক্য সে জন্যই হালাল) এবং তারপর ইন্ডিভিজ্যুয়াল নিয়ন্ত্রন মেকানিজম দিয়েছেন - এবং তার উপর ভিত্তি করে কনস্টেন্ট মূল্যায়ন করছেন।

ম্যাক্রো লেভেল এ গিয়ে সে অসম মূল্যমান সামগ্রিকভাবে সমতা আনে - যা ইন্ডিভিজ্যুয়াল লেভেল এ করতে দিলে আমরা বুঝিবা ইনোভেটিভ হতাম না, সেল্প ড্রিভেন থাকতাম না - তার মানে উদ্ভাবন হতনা। স্থবির হতাম।
১৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৩৯
219431
বুড়া মিয়া লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ সাদাচোখ ভাইয়াকে যুক্তিসঙ্গত কিছু বিষয় উপস্থাপনের জন্য, এ নিয়ে আরও কিছু আলোচনা করেছি এই পোষ্টে
275128
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৩:২৪
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম।

কষ্ট এবং বেনিফিট কখনো কি সমান আদৌ হতে পারে? কখনো কম আবার কখনো বেশি হবে! আমাদের মানষিকতাই এমন আমরা কম কষ্টে অধিক বেনিফিট ভোগ করব এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকি, এটাও এক ধরনের বিলাাসিতায় পরিনত হয়েছে আজকাল!

ভালো পড়াশোনা ছাড়া আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়া অনুচিত! Loser

ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে আর সুদ হয়েছে হারাম! সুদ মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্হা চালু করা জরুরি মনে করি! আর প্রতিটি শ্রমের বিনিময় ঘাম শুকানোর আগেই দেয়া হাদিসের নির্দেশ কিন্তু এর বাস্তব প্রতিফলন সমাজ দেখা যায় খুব কম!

আপনার লিখায় একটা সুক্ষ প্রশ্ন সুপ্ত আছে!ছলিমের গোলামী তথা প্রকাশ্য দাসত্ব তথা চাকরি করা কে ইসলামের নিয়ম বহির্ভুত বিষয় মনে করা হচ্ছে? Loserআমার ইন্টারপ্রিটেশন ভুল হতে পারে! Thinking?

অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের বিষয়ের জন্য! Day Dreaming
১৮ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৪২
219432
বুড়া মিয়া লিখেছেন : হ্যা আপু, তত্ত্বগতভাবে কষ্ট-বেনিফিট সবসময়ই সমান সমান, কম-বেশি হওয়ার কোন চান্স নেই। আপনার মতো সুদ ছাড়া অর্থনীতির দোয়া আমারও এবং মানুষের মানবিক মানসিকতা উন্নত হোক এ কামনাও করি।

আপনার ইন্টারপ্রিটেশনে ভুল হয় নিঃ যখনই আমি নিজে ক্রয়-বিক্রয় করে খাওয়া বাদ দিয়ে অন্যের সেবা করে নিজের খাওয়া পড়া চালাতে যাবো, সেটা কি দাসত্বের মধ্যে পড়বে না?
১৯ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:৪৩
219745
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : Crying Crying Crying

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File