চুল পড়া বন্ধ হওয়ার দোয়া

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১০:৩৯:৩৫ সকাল

আজকের লেখাটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ করছি। ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখলাম "চুল পড়া বন্ধ হওয়ার দোয়া"। খুব খেয়াল করে দেখলাম এবং শেষ পর্যন্ত দেখলাম কিন্তু এই দোয়াটার হাদিসীক সূত্র পেলাম না। কিন্তু সেখানে দেখালো এটি আল-কুরআনের সূরা বাকারার ৭১ নাম্বার আয়াতের একটি অংশ। এটি পড়ে তেলে ফু দিয়ে সেই তেল মাথায় নিয়মিত মালিশ করতে হবে। যেহেতু কুরআনের আয়াত,তাই অনেকে চোখ বুঝেই আমল করতে পারে,কিন্তু তারা ভেতরের বিষয়টি অনুধাবন করবে না। এবার আয়াতটা দেখব:

সে(মূসা আঃ) বলল, ‘তিনি(আল্লাহ) বলছেন, তা এমন এক গরু যা জমি চাষে ও ক্ষেতে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়নি বরং সুস্থ ও নিখুঁত’। তারা বলল, ‘এখন তুমি সত্য প্রকাশ করেছ’। তারা তাকে যবহ করল যদিও তাদের জন্য সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল।(সূরা বাকারা,আয়াত ৭১)

দেখুন এখানে কিন্তু চুল নিয়ে কোনো কথাই নেই, এমনকি আকারে ইঙ্গিতেও কিছু বলা হয়নি, তাহলে এটাকে চুল পড়ার দোয়া কেন বানানো হল ? আপনাদেরকে এবার একটি হাদীস বলব,যা সহি বুখারীতে এসেছে।

"একবার এক সফরে, যখন বহু সাহাবী রসূলের(সাঃ)সাথে ছিলেন, তারা দূরের একটি স্থানে তাবু ফেললেন। ঘটনাক্রমে সেখানে কিছু বেদুইন বসবাস করত। তাদের গোত্রপতিকে বিষাক্ত সাপে কামড়েছিলো এবং লোকটা মৃতপ্রায় ছিলো। ওদের এক লোক একজন সাধারণ সাহাবীকে ডেকে নিয়ে গেল সাহায্যের জন্যে। ওরা মুসলিমদের সম্পর্কে খুব সুধারনা রাখত। ওই সাহাবী সূরা ফাতেহা ছাড়া আর কিছুই জানত না। তখন সে ওটা তিলাওয়াত করে ফু দেয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে কাজ হয়। লোকটা পুরো সুস্থ্য হয়ে যায়। তখন খুশী হয়ে গোত্রপাতি তাকে কিছু বকরী উপহার দেয়। সাহাবী এসে এই ঘটনা রসূল(সাঃ)কে বলেন, তখন রসূল(সাঃ) হেসে ওঠেন এবং বলেন, আরে তুমি কিভাবে জানলে যে, সূরা ফাতেহা আশ শিফা(রোগ নিরাময়কারী) ? এরপর বলেন, তোমার বকরীর ভেতর আমার জন্যেও একটা ভাগ রেখো।"

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল:

১. এই সাহাবী জানত না যে আল-কুরআনের আয়াতে শিফা আছে বা থাকতে পারে। স্রেফ বিশ্বাস করেই ওই কাজটা আন্দাজে করেছিলো।

২. সূরা ফাতেহায় সাপের কথা নেই,তার কামুড়ের কথাও নেই। অন্য রোগের শিফার কথাও নেই।

তাহলে ওই সূরা রোগ নিরাময়ের দোয়া হয় কিভাবে ? এটা কিন্তু বিরাট এক প্রশ্ন।

রসূল(সাঃ) বলেন, আল কুরআনের প্রত্যেক আয়াতের দুটো ভিন্ন অর্থ রয়েছে।....তবে সেই ভিন্ন অর্থ রসূল(সাঃ) আমাদেরকে বলেননি। তার প্রয়োজনও নেই। আল কুরআন হল আমাদের গাইড লাইন। আমরা সেটা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করব এটাই উদ্দেশ্য। কিন্তু এর থেকে অন্য সুবিধাও পাওয়া যায়, যেটা এর উদ্দেশ্য নয় কিন্তু উপকৃত হওয়া যায়।

তবে কি এই চুল পড়ার দোয়াটা ঠিক আছে ?

উ: অবশ্যই নয়। এটা দোয়া হিসেবে ঠিক নেই। কারন কোনো বিষয়কে দোয়া হতে হলে বা নিয়মের অধিনে এসে কাজ করতে হলে, সেখানে হাদীসের রেফারেন্স লাগবে বা আল্লাহর রসূলের অনুমোদন লাগবে। পূর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং আল্লাহর রসূল (সাঃ) অনুমোদন করেছেন, সেটা হাদীসের অন্তর্ভক্ত হয়ে গেছে। ওটা ওভাবে অনুসরণযোগ্য। কিন্ত সেসব ঘটনার সূত্র ধরে আমরা কোনো কিছুকে নিওমের অধীনে আনলে সেটা বিদাত হবে।

তবে একটা বিষয় আছে। ওই হাদীস অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে আমল করা যাবে। যেমন কেউ আলকুরআনের যে কোনো আয়াত তিলাওয়াত করে পানিতে ফুদিয়ে বা অন্যভাবে কিছু করে উপকৃত হতে পারে। এটা একান্ত ব্যক্তিগত হলে তা বিদাত হবেনা। কিন্তু যদি সে উপকৃত হবার পর অন্যকে বলে, এই আয়াতটি এতবার পড়ে, এভাবে ব্যবহার করলে এই এই উপকার পাওয়া যায়, তখন এটা পালন করা বিদাত হবে, কারন সে এই ব্যক্তিগত উপকৃত হওয়ার বিষয়টি একটি নিয়মের অধীনে এনেছে। এরপর মানুষ এটা অনুসরণ করলে বিদাত চালু হয়ে যাবে। বিদাত ইবাদতের মতই দেখতে কিন্তু ইবাদত নয়। আর এভাবে বহু বিষয় সমাজে চালু হয়েছে,যা শুরুতে ব্যক্তি পর্যায়ে ছিলো কিন্তু না বুঝে সেটাকে নিয়ম কানুনসহ সমাজে চালু করে দেওয়া হয়েছে।

সূরা বাকারার ৭১ আয়াতটা উক্ত লোক যদি নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত অথবা আশপাশের মানুষের মাথায় ফু দিত প্রচার না করে, তাহলে সেটা বিদাতের পর্যায়ে থাকত না। কিন্তু এতে উপকার পেয়ে সে যখন পুরো বিষয়কে নিয়মের অধীনে এনে প্রচার করলো,তখনই বিদাত হল। আর আমরা ভাবি, আরে এই দোয়ার তো রেফারেন্স আছে, এটি তো কুরআনের আয়াত...! কিন্তু এখানেই চরম একটা ধোকাও আছে যা বুঝিনা। কোনো কর্মকান্ডকে ইবাদত হতে হলে শরিয়তের দলিল লাগবে। রসূল(সাঃ)এর অনুসৃত বা অনুমোদীত পদ্ধতি হতে হবে। এর বাইরে ব্যক্তিগত আমলকে হাদীসের মত করে প্রচার করা যাবেনা। নিয়মের অধীন করা যাবেনা।

এক লোকের রক্ত জমাট বাধা রোগ ছিলো। তার কয়েকটা শিরায় রক্ত জমে গিয়েছিলো। সেই লোক প্রত্যেক মাগরিবের নামাজের পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দোয়া দুরুদ পাঠ করে ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করত। এভাবে ৭দিন নফল নামাজ আদায় করে সেজদায় আল্লাহর কাছে রোগমুক্তি কামনা করল। ৭দিন পর দেখা গেল সে সুস্থ্য। পরিক্ষা করে দেখা গেল তার শিরা পুরো পরিষ্কার,ওই রোগ তার আর হয়নি।

এখানে এই ব্যক্তি যে আমলটা করেছে সেটা নফল এবং এটা ব্যক্তি তার ইচ্ছামত করতে পারে শরিয়তের কিছু বিধিনিষেধ মেনে। আর সেজদায় বান্দা তার নতজানু অবস্থার চূড়ান্ত রূপ প্রদর্শন করে এবং এ সময়েই আল্লাহর কাছে চাইতে হয়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করবেন অথবা করবেন না। তিনি কখনও কবুল করেন কিন্তু প্রদান করতে দেরী করেন অথবা আখিরাতে এর সর্বোত্তম বিনিময় দেন ,আবার কখনও সঙ্গে সঙ্গে কবুল করে তাৎক্ষনিকভাবে প্রদান করেন। সবই করেন ওই বান্দার মঙ্গলের জন্যে।

তো এই বান্দা যদি অন্যকে এভাবে বলে-" আমার রক্ত জমাট বেধে যেত, তখন আমি মাগরিবের নামাজের পর নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতাম রোগমুক্তির। আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। তিনি আরোগ্য দান করেছেন। তোমাদের যাদের শারিরীক মানসিক সমস্যা আছে,তোমরাও নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে পারো। তার এই বক্তব্য এভাবে হলে বিদাত হবেনা। কারন সে এখানে সে নতুন নিয়ম কানুন তৈরী করেনি এবং উক্ত নামাজকে "রক্ত জমাট বাধার রোগের" ক্ষেত্রে খাস করেনি।

কিন্তু যদি সে বলে, রক্ত জমাট বাধার লোগের চিকিৎস্যা হল এই যে, প্রত্যেক মাগরিবের নামাজের পর ২ রাকাত নফল পড়তে হবে,সেজদায় আল্লাহর কাছে কামনা করতে হবে, পরপর ৭দিন এটা করতে হবে,তবে রোগ মুক্তি ঘটবে। এই বক্তব্য পুরোপুরি বিদাত হবে। কারন তার এই শর্তসমূহ আরোপ করার নিজস্ব অভিজ্ঞতা,উপলব্ধী ছাড়া আর কিছুই নেই। এটা সকলের ক্ষেত্রে ঘটবে এরকম কোনো বক্তব্য আল্লাহর রসূল(সাঃ) তাকে জানাননি। স্রেফ নিজের একটি অভিজ্ঞতাকে সে সকলের জন্যে নিজের পদ্ধতিতে খাস করে ফেলেছে। এটাই বিদাত, যা ইবাদতের মত দেখতে কিন্তু ইবাদত নয়।

আর রসূল(সাঃ) বলেন, প্রত্যেক বিদাতই হল গোমরাহী আর গোমরাহীর পরিনাম জাহান্নাম। (-বুখারী)

বিষয়: বিবিধ

২১৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File