বন্ডিং

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:৪২:০৭ সকাল



------

দুনিয়াতে মানুষ পরষ্পরের সহচর্য্য ছাড়া চলতে পারেনা। একের সাথে অন্যের নানান কারনে বন্ডিং বা বন্ধন তৈরী হয়। এর কিছু স্থায়ী আর কিছু ক্ষণস্থায়ী। আজকে আমরা সবথেকে শক্তিশালী বন্ধনটা নিয়ে কথা বলব। দেখে নেই দুনিয়াতে কি কি বন্ধন রয়েছে:

১. বংশগত বা রক্তগত বন্ধন: এটা পৃথিবীর প্রাচীন বন্ধন। পিতা-মাতা-সন্তান সংক্রান্ত বন্ধন। রক্তের সাথে রক্ত,অন্তরের সাথে অন্তরের সম্পর্ক এটি। আপাত দৃষ্টিতে এই বন্ধনটিকে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে হলেও, এটি তা নয়। একই রক্তের ধারা থেকে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় তৈরী হয়। সকলের ভেতর একটা পারিবারিক,আত্মীক সম্পর্ক থাকে। কিন্তু এতে বংশ বাড়তে থাকলে আত্মীক বন্ধনও শিথিল হয়ে আসে। যত বেশী ডালপালা বিস্তার করে,তত বেশী সম্পর্ক ফিকে হতে থাকে। তবে স্বার্থের সম্পর্ক থাকলে বন্ধনটি চাঙ্গা থাকে।

প্রাচীন আরবে এবং আরও বহু এলাকায় এরকম রক্তগত বন্ধন থেকে গোত্র তৈরী হত এবং গোত্রীয় আইন-কানুন দ্বারা তারা শাসিতও হত। এটা ছিলো একপেশে,সবকিছু উক্ত গোত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। যেকোনো মূল্যে গোত্রের স্বার্থ রক্ষিত হত। অন্যরা উপেক্ষিত হত। এই বন্ধনের মাধ্যমে ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি সঠিকভাবে নিরূপিত হয়না গোত্র বা বংশ প্রীতির কারনে। রসূল(সাঃ) এরূপ বন্ধনের ভিত্তিতে ঐক্য তৈরী হারাম ঘোষণা করেছেন। এটা হল বংশ বা গোত্রগত জাতিয়তাবাদ। তবে পারষ্পরিক সুসম্পর্ককে ইসলাম উৎসাহিত করেছে বেশী।

২. ভাষাগত বন্ধন: আমরা যারা একই ভাষায় কথা বলি, তাদেরকে নিয়ে একতাবদ্ধ থাকা,ঐক্যমত তৈরী, আর এই ঐক্যমতের ভিত্তিতে ন্যায়-অন্যায়,ভালো,মন্দের মাটকাঠি তৈরী করা এক কথা নয়। এর অর্থ হল, আমরা যারা একই ভাষায় কথা বলি তারা সব এক, অন্যরা বঞ্চিত। একই ভাষাভাষী মানুষেরা পরষ্পর ভাব বিনিময় করবে এবং এক থাকবে, এটি বৈধ। কিন্তু এই ভাষাগত ঐক্য তৈরী করে তার ভিত্তিতে মানুষকে পরিচালনা করা ও এটাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহন করে বিধান তৈরী করা অন্যায়। এই ভাষাগত জাতিয়তাবাদকে ইসলাম হারাম করেছে। যেমন বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ যদি আমাদের চিন্তার উৎস্য হয়, তবে একই ভূখন্ডে অবস্থিত অন্য ভাষার লোকেরা বঞ্চিত হবে। কিন্তু বিষয়টি ব্যক্তি পর্যায়ের আবেগের ভেতর থাকলে সেটি বৈধ হবে। যেমন তুমি আমার ভাষার মানুষ, এসো দুজন চা খাই, এতে সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি আমার ভাষার মানুষ, এ কারনে এই চাকুরীটা তোমাকে দেওয়া হবে, এটা করলে অবৈধ হবে।

৩. অঞ্চলগত বন্ধন: আমরা একই এলাকার মানুষ,ফলে আমরা সব এক। একই দেশ বা দেশের ভেতর জেলা ভিত্তিক বা উপজেলা বা পাড়া ভিত্তিক মানসিকতার ভিত্তিতে মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন করা নাজায়েজ। কারন এখানে ন্যায়,অন্যায়,আইন কানুনের ভিত্তি হল উক্ত এলাকা। ওই লোকটি আমার এলাকার নয়, ফলে সে পরিতাজ্য হবে, এই মানসিকতা ও আইন অবৈধ। এমনকি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলপ্রীতি কাজ করাটা হারাম। তবে একই অঞ্চলে বসবাস করার কারনে পরষ্পরের ভেতর ভালোবাসা,সৌহার্দ্য,সহানুভূতী থাকা বৈধ এবং এটি প্রশংসনীয়। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে বৈধ। যেমন, কোনো মন্ত্রী তার পকেটের টাকা দিয়ে তার জন্মস্থানের লোকের সেবা করতে পারেন, কিন্তু সরকারের টাকা দিয়ে সেবা করতে চাইলে রাষ্ট্রের সকল স্থানের প্রতি সমান আচরণ করতে হবে। আবার আমার পাশের রাষ্ট্রে যুলুম হচ্ছে, আমি যদি বলি- ওটা তার নিজের বিষয়, আমি তাকাবো না। এটা করলে অবৈধ হবে। বরং তাকে নিজের সীমানার উর্ধ্বে উঠে ন্যায়,অন্যায়ের ভিত্তিতে কথা বলতে হবে। অঞ্চলগত জাতিয়তাবাদ কেবল নিজ দেশ বা এলাকাকে নিয়ে ভাবতে শেখায়, যা ইসলাম বৈধ বলেনি।

৪. স্বার্থগত বন্ধন: দুনিয়াতে এই বন্ধটা সবচেয়ে বেশী আকর্ষনীয় এবং সবচেয়ে বেশী ক্ষণস্থায়ী। পরষ্পরের স্বার্থ নিয়ে এই বন্ধন তৈরী হয়। যতক্ষন স্বার্থ থাকে ততক্ষন বন্ধন সুদৃঢ় থাকে,আর স্বার্থ শেষ হলে সম্পর্ক শেষ হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক দেশের সাথে আরেক দেশের যে সম্পর্ক,সেটা সম্পুর্ণরূপে স্বার্থগত বন্ধন। ব্যক্তি পর্যায়েও এটি রয়েছে সবচেয়ে বেশী। এটি সবচেয়ে বেশী আকর্ষনীয় কারন ব্যক্তি তার স্বার্থসিদ্ধীর জন্যে এই বন্ধনকে ব্যপক চাঙ্গা রাখে। এরপর হঠাৎ স্বার্থ ক্ষুন্ন হলে মুহুর্তেই বন্ধন ছিন্ন হয়।

৫.বর্ণগত বন্ধন: এটি হল গায়ের রং অথবা কোনো কারনে এক শ্রেনীর মানুষকে বাহ্যিক কারনে শ্রেষ্ঠ মনে করে তার ভিত্তিতে বন্ধন তৈরী করা। যেমন আমরা সাদা,আমরা সকলে আলাদা। বা আমরা অভিজাত, আমরা আলাদা। অথবা আমরা ব্রাক্ষন,আমরা সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি এমন কিছু, যা ইচ্ছা করলেই অর্জন করা যায় না এবং এটি ব্যক্তির জ্ঞানগত বা পরিশ্রমগত কোনো অর্জন নয়। এর ভিত্তিতে তৈরী বন্ধন হল চরম অবৈধ এবং হারাম। আর এটি ক্ষুদ্রতা।

৬. বিশ্বাসগত বন্ধন: এটাই একমাত্র বন্ধন যা ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে। সকল নবী-রসূলগনও একই শিক্ষা প্রদান করেছেন। এই বন্ধনটি দুনিয়াতে সবচেয়ে সজবুত এবং চীরস্থায়ী। এই বন্ধনের কাছে উপরোক্ত সকল বন্ধন তুচ্ছ। এই বন্ধনের ভিত্তিই হল আদর্শ এবং চিন্তা। সেই আদর্শ তৈরী হয় পারষ্পরিক কমন বিশ্বাস থেকে। বিশ্বাস থেকে আসে নীতি ও আদর্শ। এরপর সেই আর্শের সাথে মনের একান্ত বিশ্বাস থেকে যারা একমত হয়, তারা পরষ্পর ঐক্যমত তৈরী করে,বন্ধু হয়,কাছে আসে। এই চিন্তা ও বিশ্বাসগত বন্ধন থেকে যে আইন-কানুন তৈরী হয়, তা আসে সকলের জন্যে। এখানে রক্ত,গোত্র,ভাষা,এলাকা সবই অর্থহীন। ইসলামের ক্ষেত্রে এটাকে বলা হয়-"আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা,আল্লাহর জন্যেই ঘৃণা।"

চিন্তাগত বন্ধনে ব্যক্তি দুনিয়ার যেই প্রান্তেই থাকুক তারা এক ও অভিন্ন। রক্তের সম্পর্কও ছিন্ন হতে পারে কিন্তু যতক্ষন বিশ্বাস জিবীত থাকে ততক্ষন এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়না। এই চিন্তা ও বিশ্বাসের গভীরতার উপর নির্ভর করে বন্ধনের মজবুতী। বর্তমান দুনিয়াতে এবং পূর্বের সময়েও এই বন্ধনটি মুসলিমদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী কার্যকরী ছিলো,আছে। এর কারন হল সবচেয়ে শেষে আসা রসূল মুহাম্মদ(সাঃ) এই বিশ্বাসগত বন্ধনের বিষয়ে সরাসরি আল্লাহর থেকে বানী বিতরণ করেছেন। আর এই চিন্তা,আদর্শ,বিশ্বাসগত বন্ধনটি জিবীত রাখার ভেতর দুনিয়া ও আখিরাতের সুবিধাসমূহ এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে বিশ্বাসীরা এই বন্ধনের জন্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জীবন পর্যন্ত উৎস্বর্গ করে। বিশ্বাসের এত গভীরতা ও তার উপর ভিত্তি করে জীবন বিসর্জন দেওয়ার প্রবনতা অন্যদের ভেতর তেমন প্রবল নয়। কারন তাদের সেই বিশ্বাসগুলো যেসব উৎস্যের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে,তা স্রেফ এলাকা বা দেশ,ভাষা,বর্ণ,রক্ত,গোত্র সংক্রান্ত, যার বন্ধন শিথীল। আর পুরোনো কিতাবসমূহ বিকৃত হওয়ার কারনে সেটার উপর তাদের আস্থা,বিশ্বাস প্রবল নয়, ফলে বন্ধনও শিথীল। এক্ষেত্রে আল-কুরানিক বিশ্বাসে বিশ্বাসীরা এগিয়ে। কারন এরা বিশ্বাস করে এটি অবিকৃত কিতাব এবং এদের কাছে উদাহরণ,সূত্রসমূহ জীবন্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে বন্ধন কখনও ফিঁকে হলেও ছিড়ে না। উৎস্যের নিকটবর্তী হলেই বন্ধনটি প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

এই আদর্শগত বন্ধনটিই সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী। আর এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষদেরও শক্তিশালী হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্বাসে মুনাফেকীর কারনে বাহ্যিকভাবে এই বিশ্বাসীরা ধোঁকাগ্রস্ত। মজার ব্যাপার হল দুনিয়ার সকল মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা পক্ষপাতমূলক আচরণ করে কিন্তু সর্বশেষে আসা ওহীভিত্তিক চিন্তা বিশ্বাস থেকে আগত আদর্শটি সারা দুনিয়ার সকল মানুষকে এক করে ভাবে এবং সকলকে সমানাধিকার প্রদান করে ঐক্যবদ্ধ করে। এটিই একমাত্র বৈধ বন্ধন যাকে ইসলামী জাতিয়তাবাদ বলা যায়। এর বাইরে বংশগত,গোত্রগত,বর্ণগত,ভাষাগত,অঞ্চলগত বা রাষ্ট্রগত সকল জাতিয়তাবাদ হারাম,পরিত্যজ্য এবং অভিশপ্ত। এসকল জাতিয়তাবাদকে কবর দিয়ে রসূল(সাঃ) ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। তবে উক্ত বন্ধনসমূহের ব্যক্তিগত আবেগকে ইসলাম সমীহ করে ও উৎসাহিত করে।

অর্থাৎ লোকটি আমার এলাকার,ভাষার,বংশের ফলে তাকে কদর করব ব্যক্তিগতভাবে। তাকে ভালোবাসব। আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করব। কিন্তু যখন সমষ্টির প্রসঙ্গ আসবে এবং ন্যায় বিচার করার প্রয়োজন হবে, তখন সেসব ব্যক্তিগত সম্পর্ক সেখানে ভূমিকা রাখবে না। তখন কেবল আদর্শ থেকে আসা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা হবে।

বিষয়: বিবিধ

৪৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File