হুইসলার গন্ডোলা

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৯ জুলাই, ২০১৯, ১১:৩২:১৬ সকাল

হুইসলার গন্ডোলা !

---------------------

কাকতালীয়ভাবে এক ঘটনা ঘটল। প্রথম কানাডা ভ্রমন করেছিলাম ২০১৬ সালে এবং তারিখ ছিলো ২৭শে মে-৩০শে মে। এবং এরপর যথাক্রমে ২০১৭,২০১৮,২০১৯ সালের ভ্রমন হয়েছে ২৭শে জুলাই-৩০শে জুলাই। একই তারিখে সবগুলো ভ্রমন, এটা ইচ্ছাকৃভাবে হয়নি। ব্যাপারটা মজার।

নিউইয়র্কের বন্ধু আইমান হামিদ গত বছর বলেছিলো ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার হুইসলার ভিলেজ হল অত্যন্ত সুন্দর স্থান,সে খানে না গেলে জীবনই বৃথা। সেবার সবে এখান থেকে ফিরেছি, মনে মনে পরিকল্পনা ছিলো সেখানে যাবার। আজ সকালে হাইওয়ে ৯৯(কানাডা-১) ধরে যাত্রা শুরু করলাম হইসলার ভিলেজের দিকে। ভাড়া বাড়ি থেকে এটার দূরত্ব ১২৬ কিলো মিটার। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চললাম। লোকে বলে যারা ড্রাইভ করে তাদের কার সিকনেস বা নসা কাজ করেনা, কিন্তু বিষয়টি আমি ৩বার ভুল প্রমান করেছি। মনে হল এত প্যাচের রাস্তায় যদি সমস্যা হয় তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সেভেন ইলেভেন নামক এক চেইনশপ থেকে এন্টি ভমিটিং ওষুধ কিনলাম। অল্প কটা ট্যাবলেট নিল ১০ ডলার, ভাবা যায় ! এখান থেকে তেল নিলাম। প্রতি গ্যালন তেল পড়ল ৬ ডলার(আমেরিকান ৫ডলার এর বেশী), অথচ ওরেগনে অকটেন কিনেছি মাত্র ২.৬৯ডলার/গ্যালন। এখানে সবকিছুর দাম অনেক বেশী। চলতে শুরু করলাম।

রাস্তায় এক পর্যায়ে এসে দেখী অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেখানে লাল রঙের কোন বসিয়ে দুটো লেন তৈরী করেছে, কারন বাইক রেস হচ্ছে। প্রতি বছর বিশাল বাইক রেস হয় এদিকে। তখন অন্তত ৫০কি:মি: রাস্তার এক পাশ এভাবে বন্ধ করে দেয়। হইসলার ভিলেজ থেকে ভ্যাঙ্কুভারে আসার রাস্তা দুপুর ২টা পর্যন্ত বন্ধ, কেবল এদিক থেকে ওদিকে যেতে পারবে। ধীর গতিতে চলতে শুরু করলাম। শত শত বাইকার রাস্তায় রেস করছে,দেখতে ভালই লাগে। এটা এমন রেস,যেখানে এরা বাইক চালাবে,তারপর কিছুদূর সাতার কাটবে, এরপর দৌড় দিয়ে অভিযানের সমাপ্তি টানবে। সকাল প্রায় ১০টার দিকে হুইসলার ভিলেজে পৌছলাম।

আল্লাহর কসম ! এরকম স্থান আর হয়না ! পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল এলাকা জুড়ে একটা উন্নত পর্যটন এরিয়া গড়ে উঠেছে,যা দেখতে পুরোনো ধরনের। এখানে ব্যক্তিগত বাড়ি নেই, বরং হোটেল ,রিসোর্ট,রেস্টুরেন্ট আর বিনোদনের নানান রকমের কেন্দ্র। পাহাড়ের সৌন্দর্য্য,অসাধারণ লেক সবকিছু মিলে অসাধারণ। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্যে দারুন সব আয়োজনও রয়েছে। দুনিয়ার বহু স্থান থেকে লোকে এখানে আসে আরামে কিছু সময় কাটাতে। সাধারনত শীত কালেই সামারের জন্যে সকল হোটেল দখল হয়ে যায়। হোটেলের ভাড়ার কথা শুনলে চোখ মাথায় উঠে যাবে। কখনও কখনও মূল্য ছাড়ও দেওয়া হয়, সেটা হলে হোটেলের রুম দিন ৪০০ ডলারের একটু নীচে নেমে আসতে পারে,নইলে ৫/৬শত ডলার থেকে শুরু করে ৩/৪ হাজার ডলার মূল্যের হোটেল রয়েছে। তবে বেশী দামীগুলো হল স্যুট, যেখানে অনেকগুলো রুম রয়েছে। এক বা একাধিক পরিবারের জন্যে সেটা মানুষ নিয়ে থাকে। ভাবছিলাম পাগলা কুত্তায় কামড়ালেও এখানে রাত কাটাবো না। আমার এত সঙ্গতিও নেই। তবে সত্যিই অসাধারণ স্থান।

গন্ডোলার জন্যে টিকটে কাটলাম ৭৩ ডলারে। ভাবছিলাম এটা অনেক বেশী। কিন্তু পয়সা উসুল হয়েছে। গন্ডোলা বা কেবল কারের রুট এখানে অনেকগুলো পাহাড়জুড়ে এবং এটা না দেখলে বোঝা যাবেনা কতটা বিশাল। বহুদূর পর্যন্ত এটা বিস্তৃত নানান রকমের ক্যাবল কারে। প্রথম স্টেশন থেকে উপরে উঠে গেলাম ছোট সাইজের ক্যাবল কারে। চারিদিকের দৃশ্য খুবই সুন্দর। উপর থেকে নীচের পাহাড়,লেক,ভিলেজটি দেখতে দারুন। আরও উপরে উঠে গেলাম। এখানে পাহাড়ের মাথা থেকে কয়েকটি বাইক ট্রেইল নীচে নেমে গেছে। বাইকাররা চেয়ারের মত এক ধরনের খোলা ক্যাবল কারে সাইকেল নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে যায় এরপর প্রচন্ড গতি নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে নীচে নেমে আসে। এই সাইকেল রুটগুলো খুবই বিপজ্জনক,কিন্তু এটাই তাদের নেশা। তবে যেকোনো বিপদে এদের উদ্ধারকারী টিম রয়েছে। অনেকগুলো পাহাড়ের মাথা থেকে বাইকাররা বাইক নিয়ে নীচে নামতে পারে। আবার কিছু কিছু পাহাড়ে শীতকালে স্কী করে। ওরাও ক্যাবল কারে প্রায় ৭২০০ ফুট উচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে এবং গতি নিয়ে নেমে আসে। এটার পেছনে ওরা হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে।

পাহাড়ের বহু উপরে একটা অসাধারণ সবুজ লেক দেখলাম,আসলে পুকুরও বলা যায়। আরও একটা ছোট পুকুর দেখেছিলাম আরও উপরে। এই পার্বত্য অঞ্চলটা আগ্নেয়গিরীর অগ্নুৎপাতে তৈরী। এখানে সুপ্ত আগ্নেয়গিরী রয়েছে। উঠলাম অলিম্পিক পার্ক নামক স্থানে,যা ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায়। এখান থেকে ট্রেইল ধরে আরেক পাহাড় থেকে খোলা ক্যাবলকারে উঠে গেলাম অনেক উঁচুতে , এটার নাম ৩৬০ পাহাড়। এর মাথার উপর ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে যা খুবই আকর্ষনীয় এবং শক্তিশালী। ব্রিজটা সমুদ্র সমতল থেকে ৭২০০ ফুট উঁচুতে। এখানে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় এবং তাপমাত্রা নীচের চেয়ে ৫ডিগ্রী কম। বাতাসে সাসপেনশন ব্রিজ কাপতে থাকলে অনেকে ভয় পায়, অবশ্য এটা এমনভাবে তৈরী যাতে ভয় পাওয়ার কারন নেই। পাহাড়ের দুই খাড়া মাথায় এটা ফিট করা হয়েছে। এখান থেকে চারিদিকে দেখা যায়। সুন্দর সুন্দর লুকআউট তৈরী করা হয়েছে এখানে। চারিদিকে পাহাড় আর পাহাড়। দূরে সবুজ লেক দেখা যায়, যার নাম গ্রীন লেক। কিছু পাহাড়ে দেখলাম বরফ পড়ে আছে, তবে সেগুলো গলছে। এই পাহাড়গুলোর বরফ প্রায় গলে শেষ। এখানে এসে চারিদিকে তাকালে ভালো লাগবেই। এখানে এবং প্রত্যেকটি পাহাড়ের মাথায় রেস্টুরেন্ট,সুন্দর টয়লেট,সুপেয় পানি,সূভ্যেনীরের দোকান সবই রয়েছে। এবার ট্রেইল ধরে আরেক পাহাড়ে গিয়ে বিশাল সাইজের ক্যাবল কারে চড়লাম। এখানে এক ধরনের ক্যাবল কার রয়েছে যার নীচের অংশটাও স্বচ্ছ ফাইবার গ্লাসের তৈরী, ফলে সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। এটা ২২সিটের ক্যাবল কার এবং এটার টেকনোলজী ভিন্ন। অন্যগুলো ক্যাবলের সাথে আটকানো থাকে এবং বিশাল মেশিনে ক্যাবল ঘোরানো হয়, কিন্তু এটা সম্পুর্ণ ভিন্ন রকম। এটায় ৩টা ক্যাবল থাকে যার একটা ঘুরতে থাকে নির্দিষ্ট গতিতে কিন্তু অন্য ক্যাবল দুটো কারের উপরের চাকা-মোটরের সাথে যুক্ত থাকে এবং এটা নিজে নিজে চলে।

এবার এই ক্যাবল কারে করে দূরের এক সবুজ পাহাড়ের দিকে চললাম। বিশাল উপরে একা একা একটা ২২সিটের ক্যাবল কারে চড়ে দূর পাহাড়ের মাথায় গেলে অন্য রকম অনুভূতি হয়। মনে হচ্ছিলো দুনিয়াতে আমি একা। রসূল(সাঃ) বলেছেন,উপরের দিকে উঠলে আল্লাহু আকবার বলতে,আর নীচের দিকে নামলে সুবহানাল্লাহ। উপর নীচ করলে এটা আমার মনে থাকে। ক্যাবল কারে পাহাড় থেকে পাহাড়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্চিলো দুনিয়াতে আমি একা। আল্লাহকে শ্মরণ করলাম। চারিদিকের দৃশ্য দেখে ভাবছিলাম জান্নাত তাহলে কত সুন্দর ! সেটার সৌন্দর্য্য মানুষ কল্পনাও করতে পারেনা। আল্লাহ আসলেই দুনিয়াকে খুব সুন্দর করে তৈরী করেছেন। ব্লাক কম্ব নামক পাহাড়ের মাথায় আসলাম। এখান দূরে কালো রঙের পাহাড়ে মসৃণ সাদা বরফের সৃবিন্যস্ত অবস্থান দেখলে ইমানদাররা সেজদায় লুটয়ে পড়বে। সে দৃশ্য ভোলার মত না। মনে হচ্ছে কোনো শিল্পী তার তুলি দিয়ে বরফ ছড়িয়েয়েছে। কিছু মেঘ উপরে,কিছু মেঘ পাহাড়ের নীচে। এখানে পাহাড় ও সাগরের উপর ঘোরার জন্যে হেলিকপ্টার পাওয়া যায়। ২০ মিনিট চড়লে ২০০ ডলার গুনতে হয়, আর পুরো হেলিকপ্টার ৪৫ মিনিটের জন্যে ভাড়া করলে ১৯০০ ডলার। আমার স্ত্রী আসলে তাকে হেলিকপ্টারে এবং সি-প্লেনে চড়াবো ইনশাআল্লাহ।

ব্লাক কম্ব পাহাড়ের মাথায় বিশাল এক রেস্টুরেন্ট। ক্ষুধা লাগল অনেক। গাড়িতে খাবার রেখে এসেছি। সাধারনত ব্যাকপ্যাকটা সাথে রাখি,ওর ভেতর অনেক কিছু থাকে, কিন্তু ভুলে রেখে এসেছি আর তারপর থেকেই শুধু খেতে ইচ্ছে করছে। রেস্টুরেন্ট গিয়ে দেখী খাবারের দাম অনেক, শেষে শুধু ফ্রেন্স ফাই আর সফট ড্রিংক নিলাম তাও অনেক দাম। গরিব মানুষের কোনো মূল্য নেই দুনিয়ায় !

আগে ক্যাবল কারে চড়া যে অভিজ্ঞা হয়েছিলো, এখানে এসে তা বদলে গেল। এটা এমন না যে, এখান থেকে ওখানে ক্যাবল যোগে চলে গেলাম, বরং এটা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেকগুলো দূরের পাহাড়ের সাথে সংযুক্ত। বাইকার ও স্কিয়ারদের জন্যে আলাদা ক্যাবলকার এবং সেটাও অনেকগুলো পাহাড়ে বিস্তৃত। এছাড়া সকল পাহাড় থেকে পায়ে হাটা ট্রেইল চলে গেছে নীচে। যাদে রস বেশী ওরা অনেক ঘন্টা ব্যয় করে পাহাড়ে চড়ে বা নামে ওদকি দিয়ে। নীচে নেমে আসলাম, কারন গ্রীন লেকে যাব।

ক্যাবল কার হুইসলার ভিলেজের ভিন্ন একটি অংশে নামিয়ে দিল। দেখী হাজার হাজার পর্যটক। আমার মানুষ দেখতে খুব ভালো লাগে। ভিলেজের নানান সব দোকানপাট,রেস্টুরেন্ট এর ভেতর দিয়ে হাটছিলাম। শিশুরা খেলা করছে, কেউ ম্যাজিক দেখাচ্ছে,কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাচ্ছে,কেউ খেলা দেখাচ্ছে,কেউ খাচ্ছে,কেউ নাচছে। খানিক পর দেখী পুলিশেরা রাস্তা বন্ধ করেছে দৌড়বিদদের জন্যে। চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। আমি এবার গ্রীন লেকের দিকে যেতে চাইলাম, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখী রাস্তা পুরো বন্ধ। এরপর ফিরতি পথ ধরলাম।

রাস্তায় কিছু মোটর হোম ছিলো, যা খুব দীরে চলছিলো এবং পেছনে বিশাল গাড়ির বহর,মানে ওর কারনে ধীর গতির হয়ে গেছে। বাইকারদের কারনে রাস্তার অর্ধেক বন্ধ,ফলে সাইড দিতে পারছে না,জোরেও যাচ্ছেনা। বহুদূর পর টান দিলাম আযান দিয়ে। রাস্তায় স্লো ট্রাফিক ও ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে গতি সীমার বহু উপর দিয়ে স্ট্যানলী পার্কে আসলাম। এরপর অতি অসাধারণ সমুদ্রের সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। এরপর শেষ বিকেলে এক হালাল রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। বহু দূর ঘরে এসে দেখী এটা সেই রেস্টুরেন্টে যেখানে গতবার এসে তওবা করেছিলাম আর না আসার। খাবার মজার না। আরও অনেকক্ষন ধরে চলে আরেক ভারতীয় হালাল রেস্টুরেন্টে এসে দেখী ভেড়ার গোস্ত শেষ,গরুও নেই.... মনের দু:খে বাসায় ফিরে গরুর গোস্ত,ডাল ভাত টানলাম।

বিষয়: বিবিধ

৪৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File