মনু মিয়া এক গরিব পিতা -----------------------------

লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ১৭ জুন, ২০১৯, ১১:৪৫:০০ সকাল



গরিব মনু মিয়া একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের সন্তান। পিতার রক্ত তার ধমনীতে প্রবাহিত,তাই শত দারিদ্রেও কখনও লোকের কাছে নিজের অভাব অভিযোগ প্রকাশ করতে পারেনা। সমাজে এমন লোকেরা খুব কষ্টে থাকে। তাদেরকে দেখলে ভেতরের অভাব বোঝা যায় না,তারা আচরনেও কখনও তা প্রকাশ করেননা। খুব কাছ থেকে না মিশলে বোঝার উপায় নেই। অথচ এদের চেয়ে কিছুটা উপরে থাকা লোকেরাও অবলীলায় অন্যের দাক্ষিন্য গ্রহন করে। অনেকে নিজেদের যা অবস্থা তার চাইতেও করুণভাবে তা প্রকাশ করে মানুষের সহানুভূতী গ্রহন করে। মনু মিয়া তাদের মত কখনও হতে পারেনি,আর সেটা না হতে পেরেই বরং সে গর্বিত, অবশ্য দারিদ্রের অহংকারও তার নেই। দারিদ্রের অহংকারের মত ভয়ঙ্কর কিছু ইহজগতে নেই। এটার মানে হল দারিদ্র নিয়েও অন্যকে অবজ্ঞা,তাচ্ছিল্য করা,অন্যকে পাত্তা না দেওয়া,ব্যক্তিত্বের আদিক্ষেতায় কারো দাওয়াত,উপহার গ্রহন না করা, স্বচ্ছল,ধনীদেরকে অভিশাপ দেওয়া,তুচ্ছজ্ঞান করা, দারিদ্রকেই মহান মনে করা এবং দারিদ্রের উপর এমনভাবে অবস্থান করা,যেন সম্পদশালী হওাটাই দোষের। এরকম অহংকারী,দাম্ভিক,কূটিল দরিদ্র না পায় দুনিয়া, আর না পায় অখিরাত। কিন্তু সরল সোজা মনু মিয়া নিরহংকারী এক মানুষ। সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। কারো উপকারের প্রতিদান দিতে না পারলেও কৃতজ্ঞা প্রকাশ করতে মোটেও কুন্ঠিত হয়না। পেছনে মানুষের প্রশংসা করে। এতে লাভ এটা যে, অন্যরাও গোপনে ও প্রকাশ্যে মনু মিয়ার প্রশংসা করে।

কিন্তু প্রশংসা দিয়ে তো আর পেট ভরেনা, কিন্তু লোকে তো মনু মিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানেনা। আর সেটা জানলে তারা সাহায্যে হাত বাড়াবে নিশ্চিত, কিন্তু মনু মিয়ার এটা পছন্দ না। সে পরমুখাপেক্ষী হতে চায় না।

মনু মিয়া হাইস্কুলে পড়েছে, হিসাব নিকাশ ভালোই বোঝে। আর সততার কারনে বাজারে এক কাপুড়ের দোকানে তার চাকুরিও হয়। কিন্তু বেতন খুবই সামান্য। ভাগ্যিস পৈত্রিক বাড়িটা ছিলো,নইলে এই বেতনে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দুসন্তান,স্ত্রী নিয়ে টেকা বোধহয় সম্ভবপর হতনা। টিনে দোচালা,বৃষ্টি আসলে নীচে কয়েক স্থানে বালতি রাখতে হয়,নইলে মাটির মেঝে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে।

মনু মিয়ার স্ত্রীও খুব ভালো ও চরিত্রবান। প্রথম দিকে অবশ্য আশপাশের ভাবীদের স্বচ্ছলতায় স্বামীর সাথে নানান দেনদরবার করে এটা সেটার বায়না করত। মনু মিয়াও চেষ্টা করত বৌয়ের আবদার রাখতে, কিন্তু যখন দেখলো লোকটা সংসারটা চালাতে জীবন পানি করে দিচ্ছে,তখন সে তার সাধারণ চাহিদার কথাও ভুলে গেল। এর ভেতর সন্তানের আগমনে এবং দূর্বল অবস্থায় স্বামীর সেবায় সে মনু মিয়ার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। তার ভেতর নতুন বুঝ তৈরী হয়। ভাবতে থাকে সবকিছু সকলের জন্যে নয়। তাদের সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় থাকতে হবে। এছাড়া সন্তানের আগমন মানে কিছু বাড়িত খরচ। স্ত্রী ভাবনায় পড়ে যায়,যেখানে দুজনেরই সংসার চলেনা, সেখানে নতুন অতিথীর আগমনে কি না কি হয় !

মনু মিয়া শান্তনা দেয়, যিনি সন্তান প্রদান করছেন, রিজিকের ব্যবস্থা তিনিই করবেন। তাকে আমরা রিজিক দিচ্ছিনা, বরং সে তার নিজের রিজিক নিয়েই আগমন করছে। পুরো প্রক্রিয়া আমাদের উপর দিয়েই যাবে,কিন্তু উপায়হীন হয়ে পড়বে না। আর যদি আল্লাহ রিজিক না রেখে থাকেন, তবুও আপত্তি নেই, নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে কেউ ওপারে যাবেনা, সকলের জন্যেই সময় নির্ধারিত। মনু মিয়া তেমন ধার্মিক কেউ নয়, কিন্তু আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস তাকে অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিন্ততা প্রদান করেছে, তার স্ত্রী সেটাই নিয়মিত শেখার চেষ্টার করে,অনুধাবন করে। একটা প্রায় নি:স্ব মানুষ কিভাবে এত মানসিক শক্তি পায় ! মনু মিয়ার স্ত্রী ভেবে কূল পায়না।

মনু মিয়া মুখে যতই সাহসই দেখাক,মনে মনে দিশাহারা হয়ে পড়ে, কিভাবে সংসার চলবে। ওদিকে বেতন তো বাড়েনা,বরং প্রতিদিন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে, টাকার মূল্যমান কমছে। কাপুড়ের দোকানের বিক্রীও তেমন ভালো না। ভয়ে মালিককে কখনও বেতন বাড়ানোর কথাও বলতে পারেনা সে। বদ রাগী মালিক যদি চাকুরী থেকে ছাটাই করে দেয়,তাহলে ঘটনা আরও ভয়াবহ হবে। এমনিতেই মালিকের নিকটাত্মীয়রা তার দোকানে চাকুরী পাওয়ার জন্যে নানান দেনদরবার করে। স্বল্প শিক্ষিত মনু মিয়ার পক্ষে প্রচলিত চাকুরীর বাজারে প্রতিযোগীতা করা যথেষ্ট কষ্টকর। বহু শিক্ষিত যুবকই অশিক্ষিতদের চাকুরী করছে। পাশের বাড়ির মাস্টার্স পাশ করা ছেলেটাই তো ঢাকায় দারোয়ান হিসেবে কাজ করছে। তবে মনু মিয়ার বিশ্বাস আছে যে আল্লাহ তাকে মারবেন না, শেষ পর্যন্ত সে টিকে যাবে,কিন্তু তার কেমন যেন ভয় ভয় করে। মাঝে মাঝে ভাবে শহরে গিয়ে সিএনজি, রিক্সা চালাবে কিন্তু গ্রামের মায়া তাকে যেতে দেয়না। গ্রামে নানানভাবে অন্যের উপকার করে সে। অন্যের সেবা করতে তার ভালো লাগে। গ্রামের মানুষের সাথে সে মনে প্রানে মিশে গেছে। পানি ছাড়া মাছ যেমন বাঁচেনা, মনু মিয়া গ্রামের সরল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়াও শহরের জীবন কল্পনা করতে পারেনা। তার মনে হয় যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

একজন পিতা'ই জানে নতুন সন্তানের আগমনে তার ভেতর কেমন তোলপাড় হয়। সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই দুজন নানান সব পরিকল্পনা করতে থাকে। স্ত্রী তার বাচ্চার কাঁথা তৈরী করে। নিজ হাতে বাচ্চার কিছু জামাও তৈরী করেছে। এত দুশ্চিন্তার ভেতর তাদের আনন্দেরও একটি স্থান আছে। নতুন সন্তানকে নিয়ে নানান সব সুখময় চিন্তায় তারা বিভোর থাকে। কত রাত জেগে গল্প করে দুজন অনাগত ভবিষ্যৎকে নিয়ে ! মনু মিয়া পূর্বের নানান কথা ভাবতে থাকে।

হাসপাতালে সন্তান প্রসব করানোর সঙ্গতি তাদের নেই,তবুও বিষয়টি মনু মিয়া মাথায় রেখেছে। জরুরী অবস্থা বিবেচনায় বৌয়ের কিছু গহনা বিক্রীর চিন্তাও তার মাথায় ঘোরে। এছাড়া টাকার অন্য কোনো উৎস্য তার নেই। গ্রামের বুড়ি মার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সে। সে নিজেও এই বুড়িমার হাত ধরে দুনিয়াতে এসেছে।

ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসে। মসজিদের হুজুরের কাছে যায় সে পানিপড়া নিতে। হুজুর তাকে বলে, কিছু সদাকাহ করো, আল্লাহ তোমার স্ত্রীর উপর রহম করবেন আশা করা যায়। মারাত্মক প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে বুড়িমার কাছে রেখে মনু মিয়া বহু কষ্টে পকেটে জমানো কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে উপযুক্ত প্রার্থীকে প্রদানের আশায়। রাস্তায় যাকে দ্যাখে,তাকেই তার নিজের চাইতে বেশী অবস্থাসম্পন্ন মনে হয়। কষ্টের টাকাগুলো যেন অপাত্রে না যায়,তার জন্যে তার মন অস্থির। একবার ভাবে সে নিজেই তো এ এলাকার সবচেয়ে গরিবদের একজন, তবে কি নিজেই টাকাটা খরচ করবে ! আবার ভাবে যদি তার সন্তানের কোনো ক্ষতি হয় ! দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে মনু মিয়া বাজারের রাস্তায় এক বুড়োকে অল্প কিছু তরকারী নিয়ে বসে থাকতে দ্যাখে।

মাগরিবের পর এখানে তো কোনো লোকের এভাবে বসে থাকার কথা না। কাছে গিয়ে জানতে পারে লোকটি তার গাছের ময়লা মলিন চেহারার কাচকলা আর কিছু পাতি/কাগজী লেবু বিক্রী করতে এসেছে, কিন্তু কেউই তার পণ্য কিনছে না। বুড়োর শরীরের শক্তি যেন আর অবশিষ্ট নেই। চোখে মুখে বিরক্তি আবার এক ধরনের নিশ্চিন্ততার আভা দেখা যাচ্ছে। মনু মিয়া কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে এই রাস্তায় এই সময়ে বসে থাকার কারন জানতে চায়। বুড়োর সাথে কিছুক্ষন আন্তরিকতার সাথে কথা বলে।

বুড়ো বলে, সন্তানরা জমিজমা লিখে নিয়ে তাকে পরিত্যাগ করেছে। পরের জমিতে ছাপড়া তুলে বসবাস করছে বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে। কোনো রকমে চলে। অল্প কিছু কলা আর অপরিপক্ক কিছু লেবু নিয়ে বসে আগে ক্রেতার আশায়। কিন্তু সারাদিনে একজন ছাড়া আর কেউ কিনেনি। মনু মিয়া নিজের চাইতেও করুন অবস্থায় একজনকে পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বলে উঠলো-আলহামদুলিল্লাহ ! তার মনে হল,আজ এই লোকটির এই সামান্য উপকারে আরশের মহান অধিপতি অনেক বেশী খুশী হবেন এবং আশু পরিক্ষা থেকে তাকে উদ্ধার করবেন। আল্লাহর উপর সদা আস্থাশীল মনু মিয়ার আস্থা আরও বহু গুণ যেন বেড়ে গেল। তার মন ডেকে বলছে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই উদ্ধার করবেন।

মনু মিয়া বৃদ্ধের কাছে সকল পন্যের দাম জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো এটা তার সদাকা করতে চাওয়া টাকার অংকের অর্ধেক। তখন সে বৃদ্ধকে বললো, আমি আপনার আচরনে খুব খুশী হয়েছি। আমি যদি আপনাকে পিতৃস্থানীয় মনে করে কিছু টাকা দিতে চাই,আপনি কি তা গ্রহন করবেন ? অপনি গ্রহন করলে আমার মত খুশী আর কেউ হবেনা। তার বিনয়পূর্ণ আবদারে বৃদ্ধ খুব খুশী হয়ে চোখ মুছতে লাগল। তার ৭৮ বছর বয়সে এরকম ঘটনা কখনই ঘটেনি। হয়ত তার কোনো নেক কাজ আল্লাহ কবুল করে দুনিয়াতে একটি পুরষ্কার দিল, এমনই ধারনা বৃদ্ধের মনে বদ্ধমূল হল। বৃদ্ধ মনু মিয়াকে জড়িয়ে আদর করে বাড়ির দিকে রওনা হল।

(দু:খিত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আজ শেষ করতে পারলাম না। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ বাকীটা লিখব। রাতের ডিনার তৈরীর কারনে লেখা সম্ভব হলনা। আগামী কালই শেষ করব ইনশাআল্লাহ। )

বিষয়: বিবিধ

৫৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File