স্প্রাইটলি দ্বিপপুঞ্জে যুদ্ধের মহড়া!!

লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৭ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৫৭:২৯ রাত

দক্ষিন চিন সাগর এর মাঝে। চিন এর দক্ষিনে। ভিয়েতনামের দক্ষিনপূর্বে। তাইওয়ান এর দক্ষিন দিকে। মালয়শিয়ার উত্তরে। একলক্ষ পঁচিশ হাজার বর্গমাইল এর একটি অগভির সমুদ্র। এলাকাটা ৭৫০ টিরও বেশি অতি ক্ষুদ্র দ্বিপ,প্রবাল প্রাচির, ডুবোপাহাড় ও ডুবোচর এ ভর্তি। এই বিশাল এলাকার মধ্যে সবসময় পানির উপরে জেগে থাকে এইরকম বসবাসযোগ্য মাটির পরিমান হলো ১.৫ বর্গমাইল! মানে এক হাজার একরের ও কম। এই টুকু ভুমি নিয়ে এখানে যুদ্ধের মুখোমুখি এখন চিন, তাইওয়ান,ভিয়েতনাম,ফিলিপাইন ও মালেয়শিয়া। ভিন্ন উদ্দেশ্যে নতুন পক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছে বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্র।

১০ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ১১৪ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশকে কেন্দ্র করে এই বিশাল এলাকা জাহাজ চলাচল এর জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। স্মরনাতিত কাল থেকেই মালয় এবং চিনা বানিজ্য জাহাজগুলি সাধারনত এই এলাকা এড়িয়ে যেত। মাত্র অল্প কয়েকটি দ্বিপে পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় বলে কোন জনবসতি গড়ে উঠেনি এখানে। কালে ভদ্রে ভাল মেীসুমে কখনও মাছ ধরা নেীকা আসত এখানে। সত্যিকার অর্থে এর কোন মালিক ছিলনা।

আশেপাশের দেশগুলির ইতিহাসে এই অঞ্চলের উল্লেখ্য বারো শতক থেকেই পাওয়া যায়। কিন্তু ১৯ শতকের দিকে বৃটিশ তিমি শিকারি জাহাজ এর ক্যাপ্টেন রিচার্ড স্প্রাইটলি এই দ্বিপগুলি আবিস্কার(!) এর দাবি করেন এবং এর নাম করন করা হয় স্প্রাইটলি দ্বিপপুঞ্জ। সেসময় চিন ছাড়া এর আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চলগুলি ছিল ইউরোপিয় উপনিবেশবাদিদের হাতে। পরবর্তিতে এই দেশগুলি স্বাধিন হলেও এই আপাত নিষ্ফলা অঞ্চল টি নিয়ে লিপ্ত আছে যুদ্ধের মহড়ায়!

এই এলাকা নিয়ে প্রথম বিরোধ সৃষ্টি হয় চিন, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামের মধ্যে। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তাইওয়ান এর মার্কিন মদদপুষ্ট কুমিনটাং সরকার এই এলাকার উপর মালিকানা দাবি করে। ভিয়েতনামও তাদের উপকূল এর নিকটবর্তি কয়েকটি এলাকার দাবি জানায়। এরপর এই মহড়ায় জড়িয়ে যায় ফিলিপাইন যারা পুরা দ্বিপপুঞ্জটির মালিকানা দাবি করে। ১৯৬০ সালে মালয়শিয়াও সাবেক বৃটিশ উপনিবেশ এর মালয়শিয় অংশ থেকে শাসিতহওয়ার যুক্তিতে এই দ্বিপপুঞ্জের দক্ষিন অংশের মালিকানারদাবি করে। এই ভাবে এই বিশাল অথচ বসবাসএর অযোগ্য অঞ্চল নিয়ে শুরু হয় যুদ্ধের মহড়া।

আকারে বিশাল হলেও এই এলাকার সবচেয়ে বড় বসবাসযোগ্য দ্বিপটির আয়তন মাত্র ১১০ একর। চিন সরকার মূলত তাইওয়ান কে বাধা দিতে তাইপিং আইল্যান্ড নামের দ্বিপ টিতে নেীঘাঁটি তৈরি করে। অবশ্য এখানে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই জাপান একটি সাবমেরিন বেস ও এয়ারফিল্ড তৈরি করেছিল। চিনের আগ্রাসন এর আশংকা করে ভিয়েতনাম ও তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। এই ঘটনাগুলির শুরু ষাটের দশকে। ভিয়েতনাম নিজেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে গেলে এই অঞ্চলে তার প্রভাব কমে যায় কিন্তু খেলায় প্রবেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মালয়শিয়া আগে মেীখিক দাবি ছাড়া বিশেষ কোন তৎপড়তা না দেখালেও ১৯৮০ সালে মাহাথির মুহাম্মদ প্রধানমন্ত্রি হয়েই এই অঞ্চলে নেীঘাঁটি স্থাপন এর আদেশ দেন। সোয়াল রিফ নামে মাত্র ১৫ একর আয়তন এর একটি চরে এই ঘাঁটি স্থাপন করা হয় এবং মাহাথির নিজে সেটা পরিদর্শন করেন।সম্ভবত তিনিই বিবাদমানদেশগুলির মধ্যে একমাত্র সরকারপ্রধান যিনি এই অঞ্চলে এসেছেন। এই দ্বিপটি সমুদ্র ভরাট এর মাধ্যমে বর্তমানে আরো বড় করা হয়েছে এবং এটি একটি টুরিষ্ট স্পট হিসেবেও ব্যাবহৃত হচ্ছে। ফিলিপাইন ও তাদের নিয়ন্ত্রিত অংশে ঘাঁটি স্থাপন করে।

১৯৭৪ সালে তৎকালিন দক্ষিন ভিয়েতনাম এর সাথে চিনের একটি খন্ড নেী যুদ্ধ সংগঠিত হয় এই দ্বিপগুলির মালিকানা নিয়ে। ফলশ্রুতিতে ভিয়েতনামের নামমাত্র নিয়ন্ত্রনে থাকা বেশকিছু এলাকার নিয়ন্ত্রন চিন এর হাতে চলে যায়। চিন এরপর থেকেই এই অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়। যার মধ্যে অন্যতম টি হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র দ্বিপকে কেন্দ্র করে কৃত্রিম দ্বিপ নির্মান করে সেখানে নেী ও বিমান ঘাঁটি তৈরি করা। নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে চিন এই এলাকায় তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।

কিন্তু চিনের এই প্রভাব বৃদ্ধি ও সামরিক উপস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হয়ে উঠেছে চিন্তার কারন। ফিলিপাইন এর ঘাঁটিগুলি ত্যাগ করার পর বর্তমানে হাওয়াই ও চিন এর মধ্যে ওকিনাওয়া ছাড়া আর কোন বড় মার্কিন ঘাঁটি নেই। যদিও দক্ষিন কোরিয়া ও ফিলিপাইনে এখনও মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আছে। চিন কৃত্রিম দ্বিপগুলিতে যে মানের রানওয়ে ও সাবমেরিন বেস স্থাপন করেছে সেগুলি বর্তমানে হাওয়াই এর মার্কিন ঘাঁটির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান বিশ্বে চিনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এর প্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে চিনের তৎপরতাকে সহজ চোখে দেখছেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র চিনের ঘাঁটির বারো নটিক্যাল মাইল এর মধ্যে ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস লাসেন কে প্রেরন করে এবং এই অঞ্চলে একটি বিমানবাহি জাহাজ টাস্কফোর্স মোতায়েন করেছে। দুইদেশের মধ্যে ইতঃমধ্যে এই নিয়ে প্রচুর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। চিন দ্বিতিয়বার তার পানিসিমায় মার্কিন জাহাজ প্রবেশ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা কোন আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে না কারন এই কৃত্রিম দ্বিপগুলি পানিসিমা নির্ধারন আইন অনুসারে গ্রহনযোগ্য নয়। চিন এর হুমকি সত্বেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই এলাকায় নেীবহর মোতায়েন রাখার ঘোষনা ও দিয়েছে। বর্তমানে এখানের টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।

আপাতদৃষ্টিতে এই অঞ্চলে কোন সম্পদ না থাকলেও এই অগভির সামুদ্রিক অঞ্চলে হাইড্রোকার্বন তথা তেল পাওয়ার সম্ভাবনার কথা শোনা যায়। এছাড়া ল্যান্ড রিক্লেমেশন তথা সমুদ্র থেকে ভুমি উদ্ধার বা ভরাট করার মাধ্যমে প্রচুর জমি পাওয়ার ও সম্ভাবনা আছে। যেটা বিশাল জনসংখ্যার চিনের জন্য বেশ উপকারি হবে। অস্থির বিশ্বে এই অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি নতুন দুঃশ্চিন্তার সৃষ্টি করল।



স্প্রাইটলি দ্বিপপুঞ্জ এর বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে থাকা এলাকা। (ম্যাপ-উইকিপিডিয়া থেকে)

বিষয়: বিবিধ

২৩৫০ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

348731
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০১:০৮
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০০
289481
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ
348736
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০১:৪৬
আফরা লিখেছেন : দুঃশ্চিন্তার কোন কারন নেই সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হবে ।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০০
289482
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কিন্তু উলু খাগড়ার প্রান ও যাবে! সেটাই চিন্তার।
348737
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৩:৪২
কাহাফ লিখেছেন :
জানা হল এ বিষয়ে!
ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইর!!
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০১
289483
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
348754
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সকাল ১০:০৮
দ্য স্লেভ লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ। অনেক কিছু জানলাম
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:০১
289484
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
348762
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:১৭
আবু জান্নাত লিখেছেন : অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ সবুজ ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪০
289535
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
348763
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৪১
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি। কোন পক্ষের অতি উৎসাহী আক্রমণ হতে শুরু হয়ে যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপান যেমন পার্ল হারবার আক্রমণ করে শুরে করেছিল। যদি তেমনটা হয়ে যায় ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবীর বড় বড় কয়েকটি রাষ্ট্র। আর মাশুল দিতে হবে সমগ্র পৃথিবীবাসীকেই।
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪১
289536
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : যুদ্ধ লাগবে বলে মনে হয়না। মার্কিন উদ্দেশ্য চিনকে একটু চাপে রাখা। চিন বিরোধি হলেও যারা এই অঞ্চলের দাবিদার তাদের মধ্যে ফিলিপাইন ছাড়া কারো সাথে মার্কিন সম্পর্ক যুদ্ধে মিত্রতার পর্যায়ে নয়।
348764
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪১
289537
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এ্কই নিউজ আনন্দবাজারে ও দিয়েছে।
348775
০৭ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:০১
আব্দুল গাফফার লিখেছেন : খুব ভাল লাগলো পড়ে। অনেক ধন্যবাদ
০৭ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৪২
289538
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
348855
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:২৮
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : নতুন একটি দ্বীপকে আমাদের সামনে তুলে ধরে ভৌগলিক জ্ঞানের সীমানাকে আরো দুরে নেয়ার জন্য!
০৭ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪৪
289556
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : একটা আস্ত দ্বিপ তুলে ধরলাম!! আমি কি ভাই সুপারম্যান!!
১০
348963
০৮ নভেম্বর ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:১৯
দিল মোহাম্মদ মামুন লিখেছেন : দাদাগীরি দেখাতে হলে অনেক কিছুই করা লাগে, যদিও সেটা সামান্যকিছু হয় তাতেও কিছু যায় আসেনা..
ধন্যবাদ আপনাকে।
০৮ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:১৮
289680
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : সমস্যা হলো দাদাগিরি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File